ইবাদতে অপচয়

ব্রিটেনের পপুলার টেলিভিশন চ্যানেল- চ্যানেল ফোরের অন্যতম জনপ্রিয় প্রোগ্রাম “Don’t tell the bride”। এই প্রোগ্রাম টার সাথে পরিচয় এক ইংলিশ কলিগের মাধ্যমে (তখন জব করতাম)। প্রোগ্রাম টি তে ছেলেটা (বর) অসম্ভব পরিশ্রম করে তার বিয়ের দিনটা জাঁকজমক পূর্ণ হবার জন্য যাতে তার সহধর্মিনী কে মনমত ড্রিম ওয়েডিং উপহার দিতে পারে।

সন্ধ্যার পর আমাদের শপে কাস্টমার কম হতো বলে কলিগ মেয়েটা টিভি ছেড়ে রাখতো এই প্রোগ্রাম দেখার জন্য। একদিন তাকে কৌতুহল বশতঃ জিজ্ঞাসা করলাম, কেন সে এই প্রোগ্রাম এত মনযোগ দিয়ে দেখে। জবাবে বললো, সেও মনে মনে কল্পনা করে তার বিয়ের দিনটা এরকম হবে। আমি যতদুর জানতাম তার একটা বাচ্চাও আছে আর জব ছুটি শেষে একটা লোক তাকে পিক করতে আসে মাঝে মাঝে।

সে কথা মেয়েটাকে স্মরন করাতে স্মিত হাসি হেসে বললো, লোকটা তার বয়ফ্রেন্ড আর বাচ্চাটাও ওদের দুজনের। ওরা একসাথে এক বাসায় থাকে কিন্তু বিয়ে করেনি কারন লোকটা এখনও তাদের ড্রিম ওয়েডিং এর জন্য যথেষ্ট পরিমানে টাকা জমাতে পারেনি। মেয়েটা আশায় আছে একদিন তার বয়ফ্রেন্ড এসে তাদের ড্রিম ওয়েডিং এর সুসংবাদ দিবে!

আমি তাকে বললাম, একদিনের এত জাঁকজমকের জন্য বছর ধরে এত অপেক্ষা। জবাবে সে বললো, বিয়ের দিনটা জমকালো না হলে পারিবারিক ও সামাজিক গ্রহনযোগ্যতা কমে যায়। তার কাজিন সিস্টার আর ক্লোজ কিছু ফ্রেন্ডদেরও অনেক হাইফাই বিয়ে হয়েছে। সেও তাই আশায় আছে তার বিয়ের দিনে সে তাদেরকেও ছাড়িয়ে যাবে।

ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাস আমাদের দেশে বিয়ের সিজন। এ সময়টাতে আত্মীয় অনাত্মীয় কল্যানে অনেকের বিয়ের ছবি ফেসবুক ফিডে ঘুরে। গত কয়েক বছরের এইসব সো কল্ড ‘ওয়েডিং ফটোগ্রাফি’ দেখে যা বুঝলাম, আমরা সবচেয়ে বেশি অপচয় করি বিয়ে শাদী সংক্রান্ত অনুষ্ঠানগুলো তে। আরেকটু গভীরে গেলে যা অনুধাবন করা যায় তা হলো, এইসব অপচয়গুলো বেশির ভাগই হয় শো-অফ করতে গিয়ে। এই শো-অফের প্রবনতা নিয়ে যাচ্ছে কম্পিটিশনের দিকে (আমার সে কলিগের মত) যার নেগেটিভ ইম্প্যাক্ট এখন ঘরে ঘরে ।

কুরআনে সুরা আল ক্বাসাসের শেষ ভাগে ‘কারুন’ নামে একজনের কথা বর্ননা করা হয়েছে। যিনি ছিলেন নবী মূসা আলাইহিস সালামের গোত্রের অর্থাৎ বনী ইসরাইলের একজন। কারুন কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা অনেক সম্পদ দান করেছিলেন। সে যখন ব্যাপক চাকচিক্যের সাথে তার সম্প্রদায়রে সামনে বের হতো তখন লোকেরা রীতিমত আফসোস করে বলতো, কারুনের মত সৌভাগ্যবান যদি তারাও হতে পারতো!

এই কারুন কে তার সম্প্রদায়ের মধ্য হতে কিছু সৎকর্মশীল লোকেরা একটি উপদেশ দেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা শুধুমাত্র এই উপদেশটি উম্মতে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (আমাদের) কে জানানোর জন্য কুরআনে কারুনের ঘটনা বর্ননা করেন।

“কারুন ছিল মূসার সম্প্রদায়ভুক্ত। অতঃপর সে তাদের প্রতি দুষ্টামি করতে আরম্ভ করল। আমি তাকে এত ধন-ভান্ডার দান করেছিলাম যার চাবি বহন করা কয়েকজন শক্তিশালী লোকের পক্ষে কষ্টসাধ্য ছিল। যখন তার সম্প্রদায় তাকে বলল, আনন্দিত হয়ো না, আল্লাহ তাদের কে ভালবাসেন না যারা (অন্যায়ভাবে) আনন্দিত হয়।

আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন, তদ্বারা পরকালের গৃহ অনুসন্ধান কর, এবং ইহকাল থেকে তোমার অংশ ভুলে যেয়ো না। তুমি অনুগ্রহ কর, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ অনর্থ সৃষ্টিকারীদেরকে পছন্দ করেন না।” [ সুরা আল-ক্বাসাস, ৭৬-৭৭]

৭৬ নং আয়াতের শেষের অংশ “আনন্দিত হয়ো না, আল্লাহ তাদের কে ভালবাসেন না যারা (অন্যায়ভাবে) আনন্দিত হয় ” – এই অংশটি আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা তাঁর বান্দাদের আনন্দিত হওয়া পছন্দ করেন না কিন্তু ব্যপারটি মোটেও তা নয়।

এই আয়াতের তাফসীর পড়লে যেটা পরিস্কার হয়ে যায়, কিছু কিছু আনন্দ মানুষের জন্য স্বস্তি এনে দিলেও তা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লার অসন্তুষ্টির কারন হয়ে যায়। যে আনন্দ আপনার কাছে নিছক আনন্দ উচ্ছ্বাসের, সে একই আনন্দ আপনার রবের নিকট অন্যায় ও জুলুমের।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিয়ে করাকে দ্বীনের অর্ধেক পূরণ হওয়া বলেছেন আর আমরা এখন বিয়ের মত ইবাদাত টা দুঃখজনক ভাবে শুরুই করি নানা ধরনের শো-অফ আর নন মুসলিমদের রিচ্যুয়ালের অনুকরণে যার আল্টিমেট আউটকাম – বেশুমার অপচয় ।

যে বিয়ের মাধ্যমে আপনার অন্তরের সুকূন বা স্বস্তি (জীবন সঙ্গীর) খুঁজে নেবার কথা ছিলো কিন্তু আপনি তা খুঁজে নিচ্ছেন বিয়ের যাবতীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে । কারুনের সম্প্রদায়ের সেই উপদেশটা তবে আপনার জন্যই ।

“ ……আনন্দিত হয়ো না, আল্লাহ তাদের কে ভালবাসেন না যারা (অন্যায়ভাবে) আনন্দিত হয়।”

ইবাদতে অপচয়
– নুসরাত জাহান

(২২/০১/২০১৯)