ইবাদতে গলদ

আল্লাহ তা’আলা আমাদের সৃষ্টি করেছেন তা মুসলিম হিসেবে আমরা সবাই মানি। এটাও মানি আমাদের সৃষ্টিকর্তা আমাদের কিভাবে চলতে হবে, কী কী করা যাবে আর কী কী করা যাবে না সব নির্দেশনা দিয়েছেন।

এমন কোন মুসলিম নেই যে জান্নাতে যেতে চায় না। আমরা সবাই চাই জান্নাতে যেতে তাই আমরা নামায পড়ি, পর্দা করি, কথায় কথায় আল্লাহর নাম নিই। আরো কতো কি করি। কিন্তু আমরা কি আসলেই জান্নাতে যাওয়ার যোগ্য?

মনে করেন আমার দুপুর ১টা থেকে ক্লাস আছে। শেষ হবে ৩টায়। আমি ভাবলাম ক্লাস শেষেও তো ১০/১৫ মিনিট জুহরের ওয়াক্ত থাকবে। তাই ক্লাসের পরেই সালাত পড়বো – যদিও ক্লাস শুরু হওয়ার আগে পড়ার সুযোগ ছিল। এখন সেদিন ম্যাডাম ক্লাস নিলেন ৩:১৫ পর্যন্ত, গেল আমার সালাত মিস হয়ে। ক্লাস শেষ করেই তাড়াহুড়ো করে সালাত আদায় করে নিলাম।

সবাই জানে আমি পাঁচ ওয়াক্ত সালাত পড়ি, নিজেও মনে মনে গর্ব করি। কিন্তু এভাবে প্রায়ই দুনিয়ার কারনে দেরি হয়ে যায়। হয়তো অন্য ওয়াক্তের সাথে একসাথে আগের ওয়াক্তের সালাত পড়ি। আল্লাহ যেখানে যুদ্ধের ময়দানে সালাত বাদ দেয়ার অনুমতি দেননি সেখানে দুনিয়ার ক্লাস, রান্না বা অন্যান্য সামান্য কারণে অজুহাত দেখিয়ে সালাত মিস করলে বা দেরি করলে তা কতোটা কবুল হবে আল্লাহই ভালো জানেন।

আমি পর্দা করি। এমনকি নিকাব পরি। সবাই আমাকে ভালো মেয়ে বলে। আমি নিজেও গর্ব করি। কিন্তু কাল অমুকের বিয়ে। আমি ভাবলাম একদিন পর্দা না করলে তো কিছু হবেনা, বিয়েতে সবাই সেজেগুজে যাবে। সেখানে আমি একা বোরখা পরলে ভালো লাগবেনা। তাই আমি হয়তো কামিজ বা শাড়ি পরে মাথায় স্কার্ফ দিয়ে সেজেগুজে গেলাম অথবা বোরখার সাথেই যতোটুকু মুখ দেখা যায় সুন্দর করে মেকআপ করে গেলাম। সবাই আমাকে সুন্দর লাগছে বললো।

পহেলা বৈশাখ, সবাই সাজবে। আমিও লাল সাদা বোরখা বা কামিজ পরে ঘুরলাম বন্ধুদের সাথে। মাথায় স্কার্ফ তো পরেছি।

কলেজে প্রোগ্রাম, একটা দিনই তো! সবাই শাড়ি পরবে আমি পরলে ক্ষতি কি। সব সময় পর্দা করলাম কিন্তু ওই একদিনের জন্য যে আমার এতোদিনের আমল নষ্ট হয়ে যায়নি — তা কি আমরা জোর দিয়ে বলতে পারবো? আল্লাহ কি বলেছেন ক্ষেত্র বিশেষে তোমরা ইসলামের নিয়মে ছাড় দিতে পারবে?

আমি জানি ওই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে গেলে নাচ গান হবে, ফ্রি মিক্সিং হবে। আমি নাচ গানে অংশ নিলাম না, ছেলেদের সাথে কথা বললাম না। বসে বসে অন্যদের কাজ কারবার দেখলাম। বাসায় এসে ভাবলাম ওরা কতো গুনাহগার! আর আমি কতো ভালো। আমি খারাপ কাজে অংশ নেইনি। কিন্তু আমি তো জেনে শুনে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি। হারাম কাজ দেখেও চুপ করে বসে ছিলাম। কাউকে নিষেধ করিনি। আমি কি নিশ্চিত যে আমার গুনাহ হয়নি? পার্টিতে যাওয়া, চুপ করে দেখা কি তাদের সাপোর্ট করা হলো না? না গেলে কি খুব ক্ষতি হতো? কুরআনে কিন্তু শুধু ছেলেদের না, মেয়েদেরও দৃষ্টি নত রাখতে আদেশ করা হয়েছে।

আমার সন্তানকে আমি পড়তে না বসলে ধমক দিয়ে পড়তে বসাই। ভালো রেজাল্ট করতেই হবে। ওর পড়ালেখা খাওয়া দাওয়া সব কিছু ঠিক রাখি। আমি নিজে সালাত পড়ি,পর্দা করি কিন্তু আমার ছেলে মেয়েকে সালাত না পড়লে রোজ বকা দিয়ে সালাত পড়াই না। পরীক্ষার দিন সকাল সকাল ডেকে তুললেও ফজরের সময় ডাকি না।

মেয়ে মাত্র টেনে পড়ে। বড় হলে পর্দা করবে,এখন তো ছোট তাই ওকে আধুনিক জামা পরিয়ে বাইরে নিয়ে যাই। ছোটই তো, সমস্যা কি! আচ্ছা আখিরাতে আমার ছেলে A+ পেয়েছে না ডাক্তার হয়েছে তার জবাবদিহি আমাকে করতে হবে কী? নাকি আমি নিজে জেনে, পালন করেও সন্তানকে ইসলাম শিক্ষা কেন দেইনি তার জবাব দিতে হবে?

আখিরাতে আমার সন্তান যে আল্লাহর কাছে বলবে না “আমার মা আমাকে পর্দা করতে বলেনি, সালাত পড়তে বলেনি, এসবের গুরুত্ব শেখায়নি তাই আমি জানতাম না বলে করিনি।” — এর কোনো নিশ্চয়তা আছে? মা হিসেবে আমার দায়িত্ব কি আমি ঠিকভাবে পালন করছি?

আমরা জান্নাতে যেতে চাই। খুব কষ্ট করে জান্নাতের জন্য বাসা বানাচ্ছি যাতে সেখানে থাকতে পারি। আল্লাহর ইবাদত করে একটা একটা করে ইট বসাচ্ছি বাসা বানানোর জন্য। কিন্তু সেই ইবাদতে যদি গলদ থাকে — দেখা গেল ইট বসিয়েছি কিন্তু সিমেন্ট লাগাইনি বা দেয়াল বানিয়েছি কিন্তু ছাদ বানাইনি। সে বাসায় কি থাকা যাবে আর?

কার জন্য আমরা আমাদের ইবাদত নষ্ট করি? দুনিয়ার সুখের জন্য? যে দুনিয়ার মূল্য আল্লাহর কাছে একটি মাছির ডানার সমানও নয়? আল্লাহ আমাদের বুদ্ধি বিবেক দিয়েছেন আর দিয়েছেন স্পষ্ট দিক নির্দেশনা। আসুন আমরা দুনিয়ার সুখ লাভের জন্য নিজের ইবাদতকে, আমলকে নষ্ট না করি। আল্লাহ সকলকে হেদায়েত দান করুন ও সঠিক পথে চলার তৌফিক দান করুন। আমীন!

……………………..
ইবাদতে গলদ
নাইলাহ আমাতুল্লাহ

এপ্রিল ১৩, ২০১৮ইং