কাম ব্যাক

গরম কিছু একটা পড়েছে চোখে। চোখ মেলতে পারছি না। উফফ! অসহ্য যন্ত্রণা!! বেশ কিছুক্ষন পানি দেবার পরে কিছুটা ঠান্ডা হল চোখ। কিন্তু কেমন যেন ঝাপসা দেখছি চোখে। কি করি এখন? একটু পর পর অন্ধকার লাগছে চারপাশ। হচ্ছেটা কি? নাহ্, এভাবে থাকা যায়?

শহরের সবচেয়ে নামকরা চোখের ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছি। রিপোর্ট হাতে নিয়ে চশমার ওপর দিয়ে একবার আামার দিকে তাকালেন ড. বড়ুয়া। তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বোঝার চেষ্টা করছি রিপোর্টে খারাপ কিছু এসেছে কিনা। কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছি না। আমাকে জিজ্ঞাসু ভাবে তাকাতে দেখে গলা খাঁকাড়ি দিলেন ড. বড়ুয়া। কান খাঁড়া করে ফেললাম আমি।

‘মিথ্যা সান্ত্বনা দিতে চাই না আপনাকে মিস্টার নাঈম। আপনার জন্য দুঃসংবাদ আছে। ‘- ঠান্ডা গলায় বললেন ড.।

ছ্যাঁৎ করে উঠল আমার বুকের ভেতরে। দুঃসংবাদ মানে? কি দুঃসংবাদ? কেমন দুঃসংবাদ?

‘আপনার চোখের রেটিনা যে কোন মুহূর্তে ছিদ্র হয়ে যেতে পারে। হয়ত আপনি আর কিছুই দেখতে পাবেন না’। স্থির, ঠান্ডা সুরে কথাটা বললেন ড. বড়ুয়া।

তাকিয়ে আছি আমি। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। হঠাৎ অন্ধকার হয়ে এল চারপাশ। সত্যিই অন্ধ হয়ে গেছি! দেখতে পাচ্ছি না কিছুই। শব্দ শুনতে পেলাম কেমন একটা। শব্দ লক্ষ্য করে তাকালাম। সব অন্ধকার। এত ফাঁপড় লাগছে কেন? আমি কি মারা যাচ্ছি? মৃত্যু তবে এতটা অসহায় মুহূর্তে আসে?

হঠাৎ একটি কর্কশ কন্ঠ শুনতে পেলাম-

কেমন লাগছে, নাঈম?
কে আপনি? ভয়ার্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলাম আমি।
সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বল, কেমন লাগছে?
এটা কেমন প্রশ্ন? চিৎকার করে উঠলাম আমি। আমি দেখতে পাচ্ছি না কিছুই।

চিৎকার করো না। ধমকে উঠল কন্ঠস্বর। অভিযোগ করছ? কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছ? মহান আল্লাহ কি তোমাকে সুস্থ শরীর দেননি? দৃষ্টিশক্তি দেননি?

তবে কেড়ে নিলেন কেন?

কে এমন আছে যার কাছে আল্লাহ মুখাপেক্ষী? তিনি সকল জবাবদিহিতার উর্দ্ধে। বরং তোমাকেই তার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তুমি প্রস্তুত?

অজানা আতঙ্কে হাত-পা পেটের ভেতরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে আমার। প্রস্তুত মানে? আমি কি মারা গেছি?

না, না, আমি প্রস্তুত নই। চিৎকার করার চেষ্টা করলাম। আওয়াজ তেমন জোরালো হলনা।

আজ দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে অভিযোগ করছ? যখন দেখতে পেতে, আলো- বাতাস আর রবের নি’আমাতে পরিপূর্ণ এই পৃথিবী তখন কি একটিবারের জন্যও শুকরিয়া জ্ঞাপন করেছিলে?

না করা হয়নি কখনই। সত্যের স্বীকারোক্তি যেন চেপে বসেছে আজ আমার কাঁধে। অনুতপ্ত মন উৎকন্ঠিত হয়ে অপেক্ষা করছে পরবর্তী প্রশ্নের।

দৃষ্টির হেফাজত কতটুকু করেছিলে? অপাত্রে দৃষ্টি দাওনি? যেন চাবুক বসাল কন্ঠস্বর।

না, মানিনি। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম আমি।

আল্লাহর দেয়া এই বিশাল নি’আমাত কি কাজে লাগিয়েছিলে বল? তার দেখিয়ে দেয়া সীমা লঙ্ঘন করনি? বল!

কি বলব আমি? উত্তর হাতড়ে ফিরছি। না, নেই। উত্তর যে নেই।

কত রাত জেগেছ। কত পাপ করেছ। আল্লাহর দেয়া শ্রেষ্ঠ নি’আমাত চোখের কতটা খিয়ানত করেছ মনে পড়ে?

হ্যাঁ, পড়ছে। সব, সব মনে পড়ছে আমার।

কোরআন খুলে দেখেছ কখনো? কি লেখা আছে তাতে? আল্লাহর সৃষ্টি এই সুবিশাল প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে তার বিশালতার সামনে মাথাটাকে নুইয়ে দিয়েছিলে কখনো? কি চান তিনি? আনুগত্যই তো! তাই না?

হতাশা আর অনুতাপে বিধ্বস্ত এই আমি। এত পানি ঝরছে কেন চোখ দিয়ে?

যখন দৃষ্টিশক্তি ছিল তখন যদি রবের দরবারে গিয়ে দু ফোটা অশ্রু ঝরাতে? হতভাগা! দৃষ্টি শক্তির কি হক্ব আদায় করেছ? আফসোস! কিতাবুল্লাহ পড়ার সৌভাগ্য তোমার হল না। আর কখনই সুযোগ পাবে না। শুনতে পাচ্ছ নাঈম? এভাবেই বাকি জীবন কাটবে তোমার। অন্ধ জীবনই তোমার প্রাপ্য।

না, না, এমন হতে পারেনা। হে আল্লাহ আমি ভুল করেছি। আর একটিবার সুযোগ দাও আমাকে। আর একটিবার…..

ছটফট করতে করতেই ঘুম ভাঙ্গল। গোটা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। জিরো বাতির আবছা আলো তে মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরতে দেখলাম। আরেহ্… দেখতে পাচ্ছি! তবে?? স্বপ্ন ছিল? ও আল্লাহ, কি বাঁচাটাই না বাঁচলাম! আলহামদুলিল্লাহ। বুক চিরে স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরোল আমার। তবে যদি স্বপ্নটা সত্যি হত তবে কি ই বা করার ছিল আমার?

আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার
আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।

খাট থেকে নেমে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। মুয়াজ্জিন ডাকছে-

আস সালাতু খায়রুম মিনান্নাওম…

উত্তম রুপে অযু করে টুপিটা খুঁজে বের করলাম। পড়ে আছে অনেকদিন। ঝেড়ে নিলাম। চাবিটা পকেটে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালাম। গন্তব্য মসজিদ। তবে আজ ফজর থেকেই শুরু হোক আমার নতুন জীবনের যাত্রা।

অনেক হয়েছে ইচ্ছের দাসত্ব। ক্লান্ত আমি। মনে মনে বললাম। এবার থেকে রবের দাসত্ব করব আর সিরাত মুস্তাকীমের সন্ধান চাইব তারই কাছে।

“ It’s high time to come back”

কাম ব্যাক
– জাকিয়া সিদ্দিকী

(২৫/০১/২০১৯)