তুমি একজন মুসলিমাহ

তুমি এক জন ‘মুসলিম নারী’…

এই পৃথিবীতে একজন মুসলিমাহ কেন এসেছে? তার কাজটাই বা কি?।।

কেউ বলবেন, সৃষ্টিগত ভাবে মেয়েরাও বুদ্ধিমত্তা, ন্যায় অন্যায় বোধ, ব্যাক্তিত্ব ইত্যাদির অধিকারী।

অতএব মেয়েরা কেন গৃহকোনে বন্দী থাকবে? তাদেরও উচিত ঘর থেকে বের হয়ে এসে, সমাজের নানা ক্ষেত্রে অবদান রাখা, ও নিজের স্বাধীন স্বত্বার, মেধার পূর্ণ বিকাশ ঘটানো!

কেউ কেউ বলবেন চাকরী করা বা না করা সেই মেয়েটির ব্যাক্তিগত সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। যার অর্থ নারী ইচ্ছা করলে যেমন ঘরে বসে থাকার স্বাধীনতা রাখে, আবার ইচ্ছা করলে চাকরি করার ক্ষমতা রাখে। কার বাপের সাধ্য একজন স্বাধীনা নারীকে বন্দী করে রাখে!

আবার অনেকে বলেন মেয়েদের জীবনের মূল লক্ষ্য হল একজন ভালো কন্যা, বোন বা স্ত্রী হওয়া। এবং একজন ‘মা’ হয়ে ভবিষ্যতের জন্য সুযোগ্য মুসলিম সন্তান গড়ে তোলা।

উপরে বর্ণীত সকল মতের মানুষের কাছে আমার প্রশ্ন হলঃ

যেসব মেয়ে রা শিক্ষিত বা সক্ষম নয়, তারা কিভাবে সমাজে অবদান রেখে দুনিয়া কাঁপিয়ে দেবে?

যেসব মেয়েদের কখনো বিয়ে হয় নি, তারা কিভাবে একজন উত্তম স্ত্রী হবে?

কিংবা যে নারী এখনো মাতৃত্বের স্বাদ পায় নি, তার জীবনটা কি থমকে যাবে?

আমরা তো অর্থনীতি বই এর কোন হাইপোথেটিকাল সমাজে বাস করি না, যেখানে সমাজের সকল পরিস্থিতি সকলের জন্য এক্কেবারে মাপ ঝোঁক করা নিখুঁত হবে!!

শরীয়া আইন মেনে চলে এমন কোন দেশেও বাস করি না, যেখানে একজন মহিলা বিধবা হলে, স্বামী পরিত্যাক্তা হলে বা নিঃস্ব হলে তাকে সরকার দেখবে।

কিংবা প্রতিটি পুরুষ ইনকাম করবে, যেন তাদের স্ত্রী রা ঘরে থাকতে পারে।

বাস্তবতার নিরিখে চিন্তা করলে আমরা দেখতে পাব, পৃথিবীতে কখনোই প্রতিটি মানুষের জীবনের চাওয়া, পাওয়া, দুঃখ- কষ্ট এক হবে না। এ সমাজে সব সময়েই এমন মানুষ বাস করে যাবে, যাদের জীবনের পরিস্থিতি হয়তো ভিন্ন থাকবে।

যেমন আমি এমন মহিলাকে চিনি যার স্বামী মারা যাবার পর এমন কোন পুরুষ অভিভাবক ছিল না, যার ছায়ায় গিয়ে বাকী জীবনটা নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিতে পারতেন। হয়তো অর্থের জন্য তাকে ঘর থেকে বের হতে না হলেও, অন্যান্য কাজে ঠিকই ঘর থেকে বের হতে হয়েছে। সন্তানদের প্রতিপালন, বাজার করা, ঘর দেখা, বাহির দেখা… সবই করতে হয়েছে।

আবার আমাদের বাসায় যেসব বুয়ারা কাজ করে, তাদের সিংহ ভাগকে দেখা যায়, তারা হয় স্বামী পরিত্যাক্তা, কিংবা তাদের স্বামীরা কোন কাজই করে না, কেবল বসে বসে খায়!! অতএব মহিলাটিকে বাধ্য হতে হয়েছে চাকরি করে সংসারের হাল ধরতে! এখন যদি আমি এই মহিলাটিকে গিয়ে বলি, আপনি ঘরে বসে থাকেন, তাহলে তো সে না খেয়ে মারা যাবে!

আবার উপরের পরিস্থিতির মত ঘটনাবলী কে এক্সকিউয হিসাবে দেখিয়েই সমাজের অনেক নারী তাদের ক্যারিয়ায় গড়ে তুলতে গিয়ে ঘর সংসার উচ্ছন্নে দিতে বসেছে।

কারণ নারীবাদীরা তো এসব যুক্তি দেখিয়েই বলে, “নারী যদি বিপদে পড়ে, তখন কে তার পাশে এসে দাঁড়াবে? তাই সব নারীর উচিত আর্থিক ভাবে সাবলম্বী হওয়া।”

***************************************

যারা ইসলাম মেনে চলতে চেষ্টা করেন। তাদের একটি বড় অংশকে দেখা যায় এধরণের ইস্যুতে সম্পূর্ণ দুই মেরুতে বসবাস করতে!

উত্তর মেরুর লোকেরা বলেন, ইসলাম মেয়েদের পরাধীন করেনি! মেয়েরা স্বাধীন। শুধু পরিবারের সেবা করে তাদের সময় নষ্ট করা উচিত না। সব মেয়েরই উচিত ঘর থেকে বের হয়ে এসে সমাজে অবদান রাখা।

দক্ষিণ মেরুর লোকেরা বলেন, স্বামী ও সংসারে খেদমত করে, উত্তম ভাবে সন্তান প্রতিপালন করাই কেবল জীবনের সফলতা অর্জনের চাবি কাঠি!

************************************************

কিন্তু ইসলাম তো শুধু চাকরিজিবী নারী, সন্তানবতী মা অথবা আদর্শ স্ত্রীদের একার সম্পত্তি নয়! ইসলাম শুধু কোন স্বপ্নের সমাজের জন্যও নয়।

আমার স্বল্প জ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারি, ইসলাম একটি অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ “জীবন ব্যাবস্থা”! আবারো বলছি এটি শুধু ধর্ম নয়। এটি পৃথিবীর একমাত্র ‘ধর্ম’, যা কিনা স্পিরিচুয়ালিটির সাথে জীবনকেও কানেক্টেড করেছে! জীবনের সকল সমস্যার, সমাধান এই দ্বীনে আছে।

ইসলাম নারীদের ঘরের ভেতর একেবারে বন্দীও করে দেয় নি, আবার বল্গা ছাড়া ঘোড়ার মত স্বাধীনও করে দেয় নি!

সত্যি কথা বলতে কি, ইসলামে নারী বা পুরুষ কেউই স্বাধীন নয়। আবার পুরুষদের জন্যও যেমন ঘরের কাজ করা নিষেধ নয়, তেমনি মেয়েদের জন্যও বাইরে কাজ করা নিষেধ নয়।

ইসলামের দৃষ্টিতে নারী পুরুষ উভয়কেই আল্লাহ্ এর নির্দেশিত বিধি নিষেধের প্রতি আত্মসমর্পণ করে, পরম করুনাময়ের দাসত্ব স্বীকার করে নিতে হবে। ও সেই নিয়ম অনুযায়ী কাজ করতে হবে। একজন মুসলিমের জন্য স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারী জীবন যাপনের কোন সুযোগ নেই।

আর ইসলামে নারীদের গন্ডি কতটুকু তা বুঝতে হলে, আগে আমাদের জানতে হবে নারী পুরুষ নির্বিশেষে আমরা কেন পৃথিবীতে এসেছি?

আল্লাহ্‌ বলেছেন, “আমি জ্বীন ও মানবজাতিকে শুধু আমার ইবাদতের উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করেছি”।

সুরাহ আয যারিয়াতঃ৫৬

অর্থাৎ আল্লাহ্‌ এর ইবাদত করার মাঝেই নিহিত রয়েছে মূল সাফল্য! এবং এটিই আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য। সুতরাং বিয়ে না হলে, মা না হলে বা ক্যারিয়ার না হলে জীবন ধ্বংস হয়ে যায় না।

আসল কথা হলঃ আল্লাহ্‌ আজাওয়াজ্জালের ইবাদত না করা হলেই জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়!!

***********************************************

চলুন এবার আসি, ইসলাম নারীদের কতটুকু স্বাধীনতা দিয়েছে সেই বিষয়ে। ইসলাম নারী-পুরুষ উভয়ের জীবনে বেশ কিছু প্রায়োরিটি বা উদ্দেশ্য নির্ধারন করে দিয়েছে। প্রায়োরিটি লিস্টের উপরের কাজগুলো সব সময় নিচের কাজের চেয়ে ইম্পরট্যান্ট! মহিলাদের জন্য এই লিস্টটা অনেকটা এরকম-

উদ্দেশ্য ১ঃ আল্লাহ্‌ এর ইবাদত করা। (নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য বাধ্যতামূলক !)

উদ্দেশ্য ২ঃ জ্ঞান অর্জন করা, সৎ কাজ করা, সৎ কাজের আদেশ দান ও অসৎ কাজ থেকে অন্যকে নিষেধ করা। (নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য!)

উদ্দেশ্য ৩ঃ মা, কন্যা, বোন, বান্ধবী, স্ত্রী, পুত্রবধু, ননদ, ভাবী, জা, প্রতিবেশী এক কথায় প্রতিটি ভূমিকায় তার উপর অর্পিত দায়িত্বগুলো সঠিক ভাবে পালন করা।

উদ্দেশ্য ৪ঃ সন্তানদেরকে রাসুল (সাঃ) এর উপযুক্ত উম্মত হিসাবে গড়ে তোলার জন্য জান প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করা।

উদ্দেশ্য ৫ঃ যাদের স্বামী বা সন্তান নেই, অথবা নিজস্ব দায়িত্ত্বগুলো পালন করার পরও হাতে প্রচুর সময় রয়েছে, সেই সময়ে তারা নিজেদের আশে পাশের মানুষদের জীবনের উন্নতিতে বা সমাজের উন্নতিতে কাজ করতে পারে।

যেমন অন্যদের শিক্ষা দান করা, নানা ভাবে সাহায্য করা ইত্যাদি।

উদ্দেশ্য ৬ঃ গৃহের সদস্যদের প্রতি, বিশেষত সন্তানদের প্রতি দায়িত্ব পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পালন করতে পারলে ‘অতঃপর’/ ‘অথবা’ কোন উপায় না থাকলে, নারীরা অবশ্যই চাকরি করতে পারবে। তবে “অতি অবশ্যই” সেই চাকরি হতে হবে শরীয়তের বাউন্ডারির অন্তর্ভুক্ত!!

এই লিস্ট আরো লম্বা করা যায়। কিন্তু লিস্টের মূল বক্তব্য হল, একজন নারী জীবনের যে পরিস্থিতিতেই থাকুক না কেন, তার মূল লক্ষ্য হতে হবে, আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি অর্জন।

পড়াশোনা, বিয়ে, সন্তান- এসব জীবনের বিভিন্ন ধাপ ছাড়া কিছুই নয়। রাব্বুল আলামিন মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন তাকে পরীক্ষা করার নিমিত্তে। জীবনের একেক ধাপে তাই একের রকম পরীক্ষা থাকে মানুষের জন্য।

আল্লাহ্‌ বলেছেন,

“তোমার জেনে রাখো যে, পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক, জাঁকজমক, পারষ্পরিক অহংকার প্রকাশ, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ব্যতীত আর কিছুই নয়……।” সুরাহ হাদীদঃ ২০

“…… ধনঐশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের শোভা। আর সৎকার্য, যার ফল স্থায়ী, ওটা তোমার প্রতিপালকের নিকট পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং আশা প্রাপ্তির ব্যাপারেও উৎকৃষ্ট।” (সূরা কাহফ ৪৫-৪৬ )”

“এ পার্থিব জীবন তো খেল-তামাশা ছাড়া কিছুই নয়। আর পরলৌকিক জীবনই তো প্রকৃত জীবন; যদি ওরা জানত”। (সূরা আনকাবূত ৬৪ আয়াত)

এই খেল তামাশার জীবনের পরীক্ষায় ভালো করাই সবার জীবনের উদ্দেশ্য! কারন এখানে পাশ করলে যেমন রয়েছে অসামান্য পুরষ্কার আর তেমনি ফেল করলে রয়েছে ভয়াবহ আযাব।

তাই যে নারী স্বামী, সন্তান বা সংসারকে নিয়ামত হিসেবে পান নি, তাদের বলছি, “আপনাদের জন্যও আল্লাহ্‌ নানা সৎ কাজের ও ইবাদতের অপশন খোলা রেখেছেন। “

আবার যেসব বোনেরা ক্যারিয়ার গড়ে নিজের নাম উজ্জ্বল করতে চান, ক্যারিয়ার না গড়তে পারলে জীবনকে ব্যর্থ মনে করেন, তাদের বলছি, “এই দুনিয়াই আখেরি গন্তব্য নয়। দুই দিনের এ জগতে লোকে আমাকে চিনল কিংবা না চিনলো তাতে কিছুই আসে যায় না।

তাই দুনিয়াবী ব্যর্থতাকে ব্যর্থতা হিসেবে না নিয়ে, দুনিয়ার সাফল্যকে সাফল্য হিসাবে না নিয়ে, আল্লাহ্‌ আমাদের কেন দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন সেই চিন্তা করা উচিৎ। এবং উনি সফলতার যে মাপ কাঠি নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেই মাপকাঠি পর্যন্ত পৌঁছানোর চেষ্টা করে যাওয়া উচিৎ।

আবারো বলছি, নারীদের চাকরি করা অথবা ঘরে বসে স্বামী সন্তানের খেদমত করা, কোনোটাকেই আমি ছোট করে দেখছি না। কারণ প্রত্যেকের জীবনের প্রেক্ষাপট ভিন্ন হতেই পারে! শুধু এটাই বলতে চাচ্ছি, যেকোন কাজ করার আগে আমাদের নিয়ত হতে হবে আল্লাহ্‌ কে সন্তুষ্ট করা। তাই আমাদের সকল কাজই হতে হবে ইসলামে নির্ধারিত করে দেয়া প্রায়োরিটি লিস্টের ভিত্তিতে!!

সবশেষে,

আমরা যে আল্লাহ্‌র দাস এবং আমরা উনার নিয়মের কাছে পরাধীন, এই সত্যটা মেনে নেয়া জরূরি!

জীবন যখন যেমন, তখনের জন্য আল্লাহ্‌ কি বিধান দিয়েছেন ও দায়িত্ব কর্তব্য দিয়েছেন সেগুলো জানতে হবে।

আল্লাহ্‌ যেন আমাদেরকে জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য বোঝার ও তাঁর ক্ষমা লাভের সুযোগ দেন। আমিন।

————————–

তুমি একজন মুসলিমাহ

হাসনীন চৌধুরী