থার্টি ফার্স্ট

কড়া কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো মঈনের। সন্ধ্যা হতে চললো প্রায়। অনেকদিন পর দুপুরে একটা ভাত ঘুম দিলো মঈন। অবশ্য সেটারও কারণ আছে। আজকে ইংরেজী বছরের শেষ দিন। বন্ধুরা মিলে প্ল্যান করেছে থার্টি ফার্স্ট নাইট পালন করবে। সন্ধ্যায় শাহেদের মেসে চার বন্ধু একসাথ হয়ে টি এস সি’তে যাবে। বর্ষবরণ শেষে সবাই যাবে পিয়ালের রুফটপ পার্টিতে। জম্পেশ প্ল্যান … এবারের বছর শেষটা মনে হচ্ছে ভালোভাবেই কাটবে।

……………………

তড়িঘড়ি করে তৈরী হয়ে নিলো সে। 
– কোথাও যাচ্ছিস মঈন ? 
পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো তার একমাত্র বোন মিতু দাঁড়িয়ে আছে।

– কি রে আপা, কেমন আছিস? কখন এলি? 
– এই তো কিছুক্ষণ আগে।

মঈন খেয়াল করলো তার একমাত্র বোন মিতু কে কেমন যেন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।

– মঈন, তোর সাথে কিছু কথা ছিলো। 
– আপা, পরে শুনি ? এখন একটু তাড়া আছে রে। এক জায়াগায় যেতে হবে এখনই। ক’টা দিন তো থাকবি নাকি? কালকে কথা হবে তোর সাথে। কালকের দিনটা শুধু আমাদের দু’ ভাইবোনের। কথা দিলাম। 
……………

শাহেদের মেসে গিয়ে দেখে শুধু বাবলু আর শাহেদ। পিয়াল এখনও আসেনি। মঈন, বাবলু আর পিয়াল, স্কুল থেকেই ওরা তিন বন্ধু একসাথে। যদিও মঈন আর বাবলু একই সাথে ঢাকা কমার্স কলেজে একাউন্টিং এ অনার্স করছে, পিয়াল পড়ছে ঢাকা ইউনি’তে। সেখান থেকেই পরিচয় শাহেদের সাথে। শাহেদ মূলত পিয়ালের ক্লাসমেট হলেও গত দু’বছরে তাদের খুব ভালো বন্ধু হয়ে যায়। দিনাজপুরের ছেলে শাহেদ, পড়ালেখায় বেশ ভালো। আজিমপুরে একটা মেস বাড়ির এক রুমে সে শেয়ার করে থাকে মাহবুব ভাইয়ের সাথে। মাহবুব ভাই তাদের কয়েক বছরের সিনিয়র। চলনে বলনে পুরো দস্তুর হুজুর বলা যায়, তবে হুজুর হয়েও ইংরেজীতে দুর্দান্ত। তাই ইংলিশ মিডিয়ামের কয়েকটা ছেলেকে টিউশন দিয়ে মাস শেষে ভালোই চলে যায় উনার।

……………..

মাহবুব ভাইকে এমনিতে খুব পছন্দ মঈনের। বেশ মায়া করে কথা বলেন। তবে মাঝে মাঝে উনাকে ধর্মকর্ম নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি রকমের সিরিয়াস হতে দেখা যায়। আজ সকালে ফেসবুকে ঢুকে দেখে মাহবুব ভাইয়ের ‘নিউ ইয়ার’ পালন না করা সংক্রান্ত বিশাল একটা পোস্ট। না পড়ে স্কিপ করে চলে গেলো সে ফেসবুকে এত ধর্মীয় জ্ঞান ভালো লাগেনা!

ভাবতে ভাবতেই মাহবুব ভাই রুমে ঢুকলেন। চিরাচরিত সেই হাসি দিয়ে বললেন,

– কি, যাচ্ছো-ই তবে বর্ষবরণে!!
– হ্যাঁ।
– আহ! জীবনটা তোমাদের কাছে কতটা ছেলেখেলা! সারাদিন আড্ডা, ফূর্তি, খাওয়া দাওয়া – এসব কি জীবনের মানে হতে পারে? তোমাদেরকে দেখলে আমার ডাঙ্গায় ছটফট করা মাছের কথা মনে হয়। মাছ কি পানি ছাড়া বাঁচতে পারে? যে রাব্বের বান্দা হিসেবে একমাত্র তাঁর ইবাদত করতে দুনিয়ায় এসেছো, তাঁর দিক থেকেই মুখ ফিরিয়ে রেখেছো! উপরন্তু তাঁর এত ভালোবাসা স্বরুপ নি’য়ামতের মাঝে থেকে তাঁর অংশীদারিত্বতে আনন্দ উৎসব করতে যাচ্ছো?

-অংশীদারিত্ব কেমনে হয় ভাই? আমরা কি মুসলিম না? একটু আনন্দ করতে কি আমাদের ধর্ম বাধা দেয় – চটপট জবাব বাবলুর।

-ফেসবুকে আমার আজকের পোস্টটা পড়েছো? পড়লে অংশীদারিত্ব কেমনে হয় বুঝতে। যা হোক, আমার বলা দরকার তাই বললাম। বাকিটা তোমাদের উপর।

শাহেদ থামিয়ে দিয়ে বললো, পিয়ালের টেক্সট ম্যাসেজ এসেছে। ও নাকি আরও কিছু বন্ধু-বান্ধব নিয়ে টি এস সিতেই আছে। সরাসরি ওখানে চলে যেতে বললো। 
.
এরমধ্যেই হঠাৎ মঈনের ফোন বেজে উঠলো। মা কল দিচ্ছে। মা’কে বলা আছে আজ রাতে ফিরবেনা, তবুও কেন ফোন দিচ্ছে ভাবতে ভাবতেই ফোনটা ধরলো সে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর অন্যদের রেখে বাসা থেকে ছুটে বের হয়ে গেলো সে। 
.
রাত প্রায় সাড়ে তিনটা। হাসপাতালের বাইরে এসে খোলা আকাশের নিচে বসলো মঈন। সুইসাইড এটেম্পট, ডাক্তার বলেছে ভয়ের আপাতত কিছু নেই, মিতু ভালো আছে। মঈনের প্রবাসী দুলাভাই মানে মিতুর অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত হাসব্যান্ড ওখানে আরেকটা বিয়ে করেছে। আজ সকালে জানতে পেরেই মিতু শ্বশুরবাড়ী ছেড়ে চলে এসেছে। মিতু সুইসাইডের চেষ্টার আগে একটা নোট রাখে মঈনের উদ্দেশ্যে। শেষ অংশে মিতু লিখেছিলো,

“মেয়েরা সব পারে, শুধু স্বামীর ভালোবাসায় অংশীদারিত্ব* মেনে নিতে পারেনা। ভালো থাকিস আর মাকে দেখে রাখিস।” 
.
“অংশীদারিত্ব” শব্দটা সে আজকে বেশ কয়েকবার শুনেছে। কোথায় শুনেছে – এই মুহূর্তে মনে করতে পারছেনা। মিতু ভালো আছে এবং তার জন্য দোআ চেয়ে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিবে ভেবে ঢুকতেই মাহবুব ভাইয়ের পোস্টটা চোখে পড়লো। কী মনে করে পড়তে শুরু করলো মঈন। 
.
“ ১লা জানুয়ারী-কে “New Year’s Day” হিসেবে উদযাপনের ইতিহাসঃ 
‘ঈসা ইবনে মারইয়াম (আলাইহিস সালাম) এঁর জন্মের ৪৬ বছর আগে থেকেই ১লা জানুয়ারী কে “New Year’s Day” হিসেবে পালন করে আসছিল রোমক সম্রাটগণ। আধুনিক গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারও সেই ধারাবাহিকতায় ১লা জানুয়ারীকে বছরের দিন বা “New Year’s Day” হিসেবে পালন করে আসছে।
.
প্রশ্ন হচ্ছে কোথা থেকে ১লা জানুয়ারী এলো? ইতিহাসে বেশ কয়েকটা বর্ণনা পাওয়া যায় তবে সবচেয়ে পপুলার এবং সত্য যে বর্ণনা পাওয়া যায় এই বিষয়ে তা হলোঃ 
.
(১) রোমান সাম্রাজ্যের মুশরিকরা Janus (জানুস) নামে এক ঈশ্বরের ইবাদত করত যাকে তারা “God of gates, doors, and beginnings” বা “শুরুর স্রস্টা” হিসেবে মানতো। মূলতঃ তারা অনেক জন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী ছিল। তার মধ্যে Janus ছিল অন্যতম। Janus এর মূর্তির দুইটি মাথার একটি সামনের দিকে মুখ করা এবং অন্যটি পেছনের দিকে মুখ করা। দু’পাশে দু’টি মাথা দ্বারা নির্দেশ করে Janus সামনে ও পেছনে – সবদিকেই দেখতে পায়। প্রতীকী ভাবে এটি বুঝায় – Janus অতীত ও ভবিষ্যৎ দেখতে পায় ও ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা রাখে। এই Janus এর নাম অনুসারে বছরের প্রথম (beginning) মাসের নাম দেয়া হয় January। ১লা জানুয়ারী কে “New Year’s Day” হিসেবে পালন করার মূল উপাদ্য ছিল যাতে তাদের ঈশ্বর Janus খুশি হয়, যাতে তাদের বছরের যাত্রা শুভ হয়। স্বাভাবিক ভাবেই ৩১ ডিসেম্বরের আনন্দ উদযাপন সেই Janus এর প্রতি একটি ভালো যাত্রার আনন্দময় সমাপ্তির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অনুসঙ্গ হয়ে উঠত।

[সুত্রঃ
ক. The Calendar of the Roman Republic, Michels, A K. p. 97-98.
খ. Roman Religion, Warrior Valerie. p. 110]
______

“ তারা আল্লাহর যথোচিত সম্মান করে না। কেয়ামতের দিন সমগ্র পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোয় এবং আকাশমন্ডলী ভাঁজ করা থাকবে তাঁর ডান হাতে। পবিত্র মহান তিনি। তারা যাকে (তাঁর) অংশীদার করে তিনি তারঅনেক উর্দ্ধে।” [সূরা আয-যূমার, আয়াত ৬৭]” 
.
.
মঈনের মাথার ভেতর “অংশীদারিত্ব” শব্দটা চক্রাকারে বেজে চলছে। “অংশীদারিত্ব”! নিজের বোন তার স্বামীর ভালোবাসার বিষয়েই অংশীদারিত্ব মেনে নিতে পারে নি। একজন সৃষ্টি তার মতোই আরেকটি সৃষ্টির বিষয়ে “অংশীদারিত্ব” মেনে নিতে পারে নি। তাহলে আল্লাহর সৃষ্টি যখন স্বয়ং স্রষ্টার বিষয়েই অংশীদার সাব্যস্ত করে, মহিমান্বিত আল্লাহ কীভাবে সেটি মেনে নেবেন?
.
আর কিছুক্ষণ পর ভোর হবে। মঈন রিক্সায় উঠলো বাসায় যাবে বলে। নিজ এলাকায় ঢুকার পর মসজিদ থেকে আযানের শব্দ ভেসে আসলো মঈনের কানে। আযানটা আজ অন্য রকম সুন্দর লাগছে।

রিক্সাওয়ালাকে বললো মসজিদের সামনে থামতে। অযু করে ফজর পড়বে সে। অনেকখানি সময় জীবন থেকে নষ্ট হয়ে গেলো, আর না। মাহবুব ভাইয়ের ভাষায়, ডাঙ্গায় ছটফট করা মাছের আজ পানিতে নেমে যাবার দিন। ভাবতেই কেমন জানি অন্তরে প্রশান্তি ছেয়ে যাচ্ছে…

……………………………..

থার্টি ফার্স্ট
নুসরাত জাহান

……………..

* পরিশিষ্ট: আল্লাহ সুবহানা তা’লার যেকোন বিধানের ক্ষেত্রে পেইজের অবস্থান হচ্ছে শুনলাম, মেনে নিলাম। গল্পের স্বার্থে লেখককে সুইসাইডের মত ইস্যুর অবতারণা করতে হয়েছে যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।