দিবস পালন ও ইসলাম

হ্যাঁ, আজ আমার জন্মদিন। কিন্তু আমি জন্মদিন পালন করিনা।

অনেকের কাছেই মনে হয়, আহারে, ইসলাম এত কঠিন ধর্ম, ইসলাম মানতে গেলে জীবনে কোনো আনন্দ-ফুর্তিই নেই!জন্মদিনের মতো এত বিশেষ একটা দিনে তুমি কোনো মজা করবে না? একটু সেলিব্রেট করবে না? একটু বার্থ ডে উইশ করলে কী হয়?

সমস্যাটা বার্থ ডে উইশের সাথে না। বিষয়টা আরও গভীর, আর খুবই basic.

অনেকগুলো কাঁচামরিচ দিয়ে মাখানো এক প্লেট ঝাল চানাচুরের পর আমাদের অন্তরটা যেমন পানির জন্য ছটফট করতে থাকে, তখন পানি খেতে মনে হয় যেন সুস্বাদু মিষ্টি কোনো পানীয়! জাহেলিয়াতের অন্ধকার থেকে ইসলামের আলো পাবার ব্যাপারটাও তেমন।

হঠাৎ করেই একদিন আপনার মনে হবে, এই যে আমার জীবন, এ জীবনের লক্ষ্য কী, উদ্দেশ্য কী? কী অর্থ এই বেঁচে থাকার? এই যে এত কাজ, এত আনন্দ-ফূর্তি, এই যে প্রাণের উচ্ছল জোয়ার বইছে চারিদিকে, এর মাঝে কী করছি আমি? কীসে এই জীবনের সার্থকতা?

আপনি হয়ত এই প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজতে গিয়ে আপনার রবকে খুঁজে পাবেন৷ এতদিনের হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কটা নতুন করে জোড়া লাগবে৷ আবার হয়ত আপনি এ সব প্রশ্নকে কোনোমতে দাফন করে দিয়ে আগের মতোই চলতে থাকবেন। কী দরকার এত কষ্ট করে ভাবাভাবি করার?

এখন আমরা আর কেউ ভাবতে চাই না। কেউ চিন্তা করতে চাই না। কেউ বদলে যেতে চাই না। শুধু সবাই যেমন চলছে, আমিও সেভাবেই চলতে চাই। সবাইকে দেখাতে চাই আমি সুখে আছি।

যখন কাছের কেউ মারা যায়, আমরা কদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাই। এই দুনিয়ারও একটা শেষ আছে। এই জীবনেরও শেষ আছে। এ কথাটা মনে করে আমরা অস্থির হয়ে উঠি! এরপর আবার সেই পুরোনো জীবন। সেই কাজকর্ম, সেই টাকা কামাইয়ের ধান্দা। সেই সেলফি আর হ্যাপি ফ্যামিলির শো-অফ। বছরে কয়েকটা বিশেষ বিশেষ দিন বানিয়ে নিয়ে আনন্দ উদযাপনের মহড়া করা, যদিও বাস্তবে সম্পর্কগুলো ছিঁড়ে যাওয়া পুরোনো সোয়েটারের উলের মতোই আলগা হয়ে চলেছে প্রতিদিন..

আমরা চিন্তা করি না। আমাদেরকে আমাদের মৃত্যু, আমাদের আখিরাতের চিন্তা, আমাদের কবর, আমাদের জান্নাত-জাহান্নামের ভাবনা নাড়া দেয় না। দিলেও খুব সামান্যই।

এই যুগের মতো এত জাহেলিয়াতি আর কোন যুগে ছিল আমার জানা নেই। ৩০-৪০ বছর আগেও জন্মদিন নিয়ে এত মাতামাতি ছিল না। মানুষ জানতোই না তার জন্মতারিখ ঠিক কবে! নানু-দাদুদের জন্মতারিখ নিয়ে প্রশ্ন করলে শুনতো, শ্রাবণের শেষ বিষ্যুদবার বা মাঘ মাসের প্রথম শুক্রবার– এভাবে একটা অজানা তারিখের দিকে নির্দেশ করা হতো। সাল নির্ধারণ করা হতো বিশেষ কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে৷ ঐ যে যেবার দেশে যুদ্ধ লাগলো, তার পরের বছর তুই জন্ম হলি…

এই বিশ-তিরিশ বছরে দৃশ্যগুলো একদম পাল্টে গেছে। আমার মনে আছে, কিশোর বয়স পর্যন্ত আমরাই কতো হৈচৈ করে জন্মদিন পালন করেছি! কখনও কেক না কাটলেও মনের কোণায় আশা থাকত, দেখি কে কে মনে করে বার্থডে উইশ করে, দেখি কে কী গিফট দেয়!

গত আট-দশ বছরে এক্সপেকটেশনটা বদলে গেছে। এখন জন্ম তারিখটা মনে রাখি শুধুই জরুরি কাগজপত্র আর ডাক্তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়ার জন্য। আমার বাচ্চাদেরকে ভুলেও এই দিনটাকে কোনো বিশেষ দিন হিসেবে শেখাই না। ওরা আমাদের দেখেই শেখে। ওদের কাছেও এই দিন যেন একটা সাধারণ দিনই হয়। চাই না, ওদের মুখের বোল ফুটুক হ্যাপি বার্থ ডে বলে, চাই ওদের মুখে থাকুক আল্লাহর যিকির। ওদের অন্তরে থাকুক অনন্ত আখিরাতের জন্য ভালোবাসা…

এই যে আল্লাহ তা’আলা এত সুন্দর একটা জীবন দিয়ে পাঠালেন, এত অনন্ত সম্ভাবনাময় একটা জীবন! কী করেছি এই জীবনটা দিয়ে? আমরা কতটুকুই বা আল্লাহকে স্মরণ করি, ক রাকাত নামাজ পড়ি, কতখানি ইবাদত করি? আল্লাহ বলেছেন, তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন শুধুই তাঁর ইবাদত করার জন্য। অথচ আমরা ইবাদত ছাড়া সবকিছুতেই পারফেকশন এনেছি।

আমরা একটা পারফেক্ট শট নেয়ার জন্য অগণিত ছবি তুলি, একটা পয়সা খরচ করার আগে একশ দোকান যাচাই করি, অথচ একটা ইবাদতের সময় কোনো চিন্তাই করি না৷ আমাদের নামাজ ছুটে যায়, কুরআনের মলাটে ধুলো জমে, আমাদের ইবাদতে অযত্ন-অমনোযোগের ছাপ প্রকট হয়। আমরা নিশ্চিন্তে গুনাহর কাজ করতে থাকি.. যেন আমাদের কাজের কোনো জবাবদিহিতা নেই, যেন আখিরাত বলে কিছু আমরা বিশ্বাসই করি না!

এই সব জন্মদিন, ভালোবাসা দিবস, মা দিবস, বাবা দিবস পালন করলে কী হয়? এগুলো খুবই তুচ্ছ, খুবই অপ্রয়োজনীয় একটা ব্যাপার। এই দিবসগুলো পালন না করেও ভালোবাসা প্রকাশ করা যায়, আনন্দ করা যায়, কেক খাওয়া যায়, মা-বাবার খেদমত করা যায়। বরং এগুলো আমাদের জীবনকে কয়েকটা অর্থহীন কাজে বেঁধে ফেলছে। সময় নষ্ট, টাকা খরচ আর শো-অফের উপায় মাত্র।

আনন্দ করার জন্য কোনো উপলক্ষ লাগে না। বাচ্চার হাসি দেখলেও আনন্দ হয়৷ একটা সূরা হিফজ করার আনন্দেও পোলাও-কোর্মা রাঁধা যায়। আপনি কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে আনন্দ করছেন, সেটাই তো বলে দেবে কার জন্য আপনার মন কাঁদে, কার জন্য আপনার অন্তর আন্দোলিত হয়!

আল্লাহর খুশির জন্য এই দিবসগুলো ছেড়ে দেওয়াটা খুবই খুবই সামান্য একটা কাজ। আমি এই কাজটা করেছি আল্লাহরই ইবাদত করার একটা অংশ হিসেবে। আমার আনন্দ এতেই যে আমার সন্তানরা তাদের মা’কে একজন মুসলিমাহ, একজন মুমিনা হিসেবে চিনুক। তারা যেন আমাকে দেখে জান্নাতের পথেই দৌড়ে ছুটতে চায়… এই দুনিয়াটা আর কয়দিনের বলুন?

দিবস পালন ও ইসলাম
-আনিকা তুবা

(২২/০২/২০১৯)