নিছক বিনোদন

মোবাইল হাতে নিলাম। নিজের অজান্তেই কী সব ঘাটাঘাটি করলাম, অনেক সময় কেটে গেল কখন টেরই পেলাম না। যা দেখলাম সবই অপ্রয়োজনীয়, এককথায় “ফালতু দ্যা গ্রেট” ইনফরমেশন আমার না জানলেও চলত, বরং জেনেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।

সময় নষ্টকারী এই ফালতু জিনিসের ফলস্বরুপ মনে আখিরাতের স্মরনে ভাটা পড়ল, সারাদিন পর হঠাৎ কেন যেন এশার নামাজের ভেতর বারবার সেসব চোখে ভাসছিল, নামাজেরই সাড়ে সর্বনাশ!

কি ভয়ানক অস্থিরতা! আউ’যুবিল্লাহ!

সময় নষ্ট করে একগাদা গুনাহ কামালাম আর কি!এই সময়ে অনেকখানি ইলম/আমল হতে পারত। একজন মুমিনের জীবনে “টাইম পাস” বলে কোন জিনিসের অস্তিত্ব থাকার কথা না।

যে ব্যক্তি পরকালের প্রতি ঈমান এনেছে, সে অবশ্যই এই জীবনের সীমিত সময়কে আখিরাতের সফলতার জন্য to the point ব্যয় করবে। পরীক্ষার হলে বসে পরীক্ষার্থী কখনো অযথা বাঁশি ফুঁকে না।

ফেসবুক/ মোবাইল/ইন্টারনেট জিনিসগুলো
আপাতদৃষ্টিতে হয়ত অনেক উপকারী মনে হয়। কিন্তু এগুলো ভেতরে এক loss project সুড়ঙ্গ আছে, যার রাস্তা বহুদূর বহু নিচে।

শয়তান বড়ই হিকমত ওয়ালা। যে বদ পথে চলে তাকে বারবার ধোঁকা দেয়া দরকার নেই তার, একবারেই যথেষ্ট। কিন্তু যে আল্লাহর পথে চলার বাসনা রাখে তাকে ধোঁকা দিতে শয়তানকে নানা সময়ে নানা রুপে সাজতে হয়। নেক সুরতে পাক্কা মুমিনকে একটু একটু করে গুনাহের সুড়ঙ্গে টানতে হয়, সোজা আংগুলে ঘি না উঠলে শয়তান হাল ছাড়ে না কিন্তু !

যে মানুষটি ফরজ-সুন্নাত, হালাল-হারাম ঠিকমত মেনে চলার চেষ্টা করে, জান্নাতের আশা রাখে, শয়তান তার হাতে একখান মোবাইল ধরিয়ে ফেসবুকে বসিয়ে দেয় –

“নে বাবা; ফেসবুকে দ্বীন শেখ, মাস’আলা খোজ, উম্মাহর খবরাখবর রাখ। তার ফাঁকে দুইচারটা বিজ্ঞাপন দেখবি, মিউজিক তোর কানে যাবে, জগতের যত ফালতু খবর তোর চোখ এড়াবে না।

অযথা শাড়ি/কানের দুল থেকে শুরু করে বিড়াল তাড়ানোর মেশিনের যত বাজার আছে সব ঘুরে দেখবি। একসময় তুই দুনিয়ার মাঝে ডুবে যাবি! হাহা…”

এই হলো ধুরন্ধর শয়তানের প্ল্যান!

কিছুটা সময় রিলাক্সের জন্য ফেবুতে কিংবা মেবাইলে ঢু মারতে গিয়ে দুনিয়ার মাঝে ডুবে যাও, টাইম পাস কর, ইবাদত কমে যাক,কমে যাক উপকারী ইলম, ক্ষীন হয়ে যাক আল্লাহর স্মরন।

এটাই তো ইবলিসের সফলতা।

কেউ কেউ হয়ত দ্বিমত করবেন অথবা বিরক্ত হবেন এই লেখা পড়ে। অতিরঞ্জিত মনে হচ্ছে?
তেমনটা আসলেই না! সারাদিন একটা মানুষ যে সব জিনিসের মাঝে ডুবে থাকে,তার মাইন্ডসেট সেভাবেই হয়। চোখ যা দেখে, কান যা শোনে, ব্রেইনে ঠিক সেই রকমই রিফ্লেশন হয়। সারাদিন শাড়ি চুড়ির পেইজে ঘুরলে মাথায় এগুলোর চিন্তা ঘুরবে। কোনটা কিনব, কিভাবে সাজবো।

অপরদিকে সারাদিন জান্নাতের বর্ণনা শুনবেন, জান্নাতে যেতে ইচ্ছে হবে। আখিরাতের বর্ণনা শুনলে মন নরম হবে, নামাজে অটোমেটিক চোখ দিয়ে পানি বের হবে।

সারাদিন ফেসবুকিং করলে অমুক তমুক কে কী করেছে দেখতে দেখতে আপনার মনও দুনিয়াময় ঘুরবে। হাদিসে এসেছে — সবচেয়ে উৎকৃষ্ট স্থান মসজিদ আর নিকৃষ্টতম স্থান হলো “বাজার”। কিন্তু এই বাজারে ঘুরতে আর পায়ে হেটে যাওয়া লাগে না আমাদের। মোবাইলের ভেতর ঢুকে আমরা বাজারেই পড়ে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা!

আপনি দুই ঘন্টা মোবাইলে বাজার-নিউজ-শোবিজ-DIY ব্রাউজ করবেন আর আপনার ঈমান তরতাজা থাকবে, আযান হলেই আল্লাহর ভয়ে কাঁপুনি আসবে?

নেভার! নেভার নেভার। তখন নিজেই বুঝবেন — নামাজকে বোঝা মনে হবে, আলসেমি লাগবে, কুরআন পড়তে ইচ্ছে হবে না, মনে হবে সময় নেই। আল্লাহর জিকিরে মন বসবে না। একদিন হঠাৎ খেয়াল করবেন অন্তরে কী যেন নেই, কিসের যেন অভাব….সবকিছুতে অস্থিরতা! কিচ্ছু ভালো লাগেনা।
এমন হয় না? হয় হয়। হবেই মাস্ট!

হয়ত কেউ স্ট্রং ঈমানের মানুষ থেকে থাকবেন মা-শাআল্লাহ, এগুলোতে যারা বলতে পারেন তাঁদের কিছুই হয় না। নামাজে দাড়ালেই মনোযোগ চলে আসে, শতবার মোবাইলে দুনিয়াবি জিনিস ব্রাউজের পরও জিকিরে মনোযোগ থাকে, কুরআন খতম হয় মাসে একবার।

বারাকাল্লাহু লাহুম।

এই লেখাটা আমি তাদের কারো জন্য লিখছি না, লিখছি নিজের জন্য। নসীহা দিয়ে দিয়ে বিরক্ত করে কাউকে দ্বীন বোঝানো যায় না। লাভ নাই। বরং দ্বীন শেখাতে মমতা লাগে, আগে নিজের আত্মশুদ্ধি করা লাগে, তবেই না আন্তরিকতা আসে।

অনেকজন দ্বীনিবোনের কথা জানি যারা স্বামী/
সন্তান / ভাই-বোন / মা-বাবা কে একটু দ্বীনের পথে আনার জন্য আল্লাহর কাছে কত কান্নাকাটি করেন, কত্ত বুকফাটা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলেন, কত করে কত পথে বোঝাতে থাকেন। তাহাজ্জুদের কান্নায় দু’চোখ ভিজে যায়!

কেন কান্না আসে?

ভালবাসার জন্য। অনেক গভীরভাবে ভালবাসি বলে । একসাথে জান্নাতেও থাকতে ইচ্ছে জাগে বলে, প্রিয় মানুষটা শাস্তি পাবে বা জান্নাতীদের কাতারে পিছিয়ে যাবে তা কক্ষনোই চাইনা বলে। শুধু নিখাদ একটু ভালবাসার কারনেই তো!

ঠিক এইভাবে সন্তান, মা অথবা স্বামীর মত করে আমরা কয়টা মানুষকে ভালবাসতে পেরেছি? আর কাউকে না। আর কারো জন্য এত পানি চোখে আসে না যতটা প্রিয় মানুষটির জন্য আসে।

অথচ, হাজার বছর আগে…….একজন মানুষ
আমাদের প্রত্যেকের জন্য বুক ভাসিয়ে কেঁদেছেন, দিনে এবং রাতে। শতশত কোটি অনাগত অচেনা মানুষের জন্য বুক ভাসিয়েছেন। যার নসীহা, চেষ্টা, কান্না, অস্থিরতা, দু:খকাতরতা দেখে আল্লাহ নিজেই বলেছেন –
“…(মনে হচ্ছে) তুমি দুঃখে তোমার নিজের জান বিনাশ করে দেবে।”

এতটা মমতা আর কে পারে বুকে ধারন করতে? তবুও সেই সেরা মানুষটির নসীহা অনেকের বেলায়ই কাজে আসেনি। তাঁকে সারাজীবন আগলে রাখা প্রিয় মানুষটিই বাদ পড়ে গেছিলেন।

নসীহা বা উপদেশ বড় ভারী জিনিস, সবার যোগ্যতা হয়না দেবার। অযোগ্যের ভুল পন্থায় নসীহা কেবল বিরক্তিই বাড়ায়। তাই নিজেকেই বলি, লিখি…বারবার বলি।

অন্যকে উপদেশ ছোড়ার মত যে হতে পারিনি এখনো, তাউ শুধু নিজেকেই উপদেশ দেই –

ﻓَﺬَﻛِّﺮْ ﺇِﻥ ﻧَّﻔَﻌَﺖِ ﭐﻟﺬِّﻛْﺮَﻯٰ ﺳَﻴَﺬَّﻛَّﺮُ ﻣَﻦ ﻳَﺨْﺸَﻰٰ ﻭَﻳَﺘَﺠَﻨَّﺒُﻪَﺍ ﭐﻟْﺄَﺷْﻘَﻰ

“কাজেই তুমি উপদেশ দাও,যদি উপদেশ উপকার দেয়। যে ভয় করে সে উপদেশ গ্রহণ করবে। আর তা উপেক্ষা করবে যে চরম হতভাগা।”
[সুরা আল-আ‘লা : ৯-১১]

আমি হতভাগার দলে পড়তে চাইনি কখনো। অনেক বাধা সংঘাত কষ্টে ভরা দুনিয়ার পর একটুকরো জান্নাতের বাগান চাই, দুচোখ ভরে দেখতে চাই, স্বাধীন পাখির মত তাঁর সবুজকে ছুয়ে দেখতে চাই, প্রবল উচ্ছ্বাসে ছুটে চলা সাদা ঝর্নায় পা ভিজিয়ে সব গ্লানি ভুলে যেতে চাই।

আমি চাইনা কখনো অগ্রবর্তীদের দল থেকে পেছনে পড়ে থাকি কিংবা হেরে যাই। এই কষ্টের, গ্লানির, অভিনয়ের, অপমানের বুকভাঙ্গা দুনিয়ার পরে আরেকটা কষ্টের জগৎ চাইনা যে আর কিছুতেই।

আমার প্রতিটা মুহুর্তই যে আল্লাহর কাছে যাবার
একেকটা সুযোগ। ওই যে জায়নামাজ, আল্লাহর পাঠানো কুরআন, দু’এক বাক্যের জিকির, আরো কত দ্বীনি ইলমের বইগুলো…।

নিজেকে শুধরানোর জন্য কতগুলো মানুষের নেক সঙ্গ আমার সামনে বাকি পড়ে আছে। কবে আখিরাতের সম্বল গোছাবো আমি? সবই যে বাকি!

হে মু’মিন নফস,
নিছক বিনোদনের সময় যে আমার নেই!

………………………
নিছক বিনোদন
খাদিজা তাহিরা

এপ্রিল ২০, ২০১৮ইং