ফরজ হয়ে যায়নি তো!

সেদিন বেড়াতে গেলাম এক আত্মীয়ের বাসায়। ভাবি আমার প্রায় বছর দশেক বড়। আমাকে বলছিলেন, “এত অল্প বয়সে হজ্জ করে ফেললা, ভালোই করেছো। আমার তো এখনো ফরয হয় নাই, শুধু যাকাত ফরয। আমার শুধু গয়না আছে। আমিতো চাকরি করিনা আর কোন ক্যাশ টাকাও নাই। আর আমার ছেলেরা আমাকে ছাড়া এক মিনিটও থাকতে পারেনা।”

সেদিন ভাবির কথা শুনে বুঝলাম, হজ্জ ফরযের ব্যাপারটা তার কাছে পরিষ্কার না। সত্যি কথা, আমারো জানা ছিল না। আমরা নামাজ, রোজা, যাকাত, কুরবানি এসবের নিয়ম যতটা জানি; সে তুলনায় হজ্জের ব্যাপারে তেমন কিছু জানিনা।

এর পিছনে যে কারন আমার মনে হয় যেহেতু হজ্জ একবারই ফরয, বেশিরভাগ মানুষ ভেবেই নেন শেষ বয়সে হজ্জ করবেন। আর সে সময় জানলেই চলবে।

আচ্ছা, শেষ বয়স কার কবে সেটা কি কেউ বলতে পারে? আমরা হজ্জে যাওয়ার কিছুদিন আগে আমার শ্বশুরের বন্ধু এবং প্রতিবেশী, দুজনা একই বয়সি – শুক্রবার বাজার করতে যাচ্ছিলেন। বাসা থেকে নেমে সিঁড়ির কাছে বসে পড়েন, কিছুক্ষনের মধ্যে মৃত্যু। আমার শ্বশুর যখন হজ্জে যান, তাকে খুব করে বলছিলেন যেন তিনিও হজ্জ করে নেন। কিন্তু তিনি জানালেন এত দ্রুত(!) হজ্জে যাবেন না, পরে করবেন। শেষ পর্যন্ত ফরয হজ্জ আদায় না করে মারা গেলেন। পরে পরে করতে করতে পরপারে চলে গেলেন। বিত্তবান ছিলেন, তার কোন কিছুরই কমতি ছিল না। সন্তানরা বাবার মৃত্যুতে শোক পালন করেছে ঠিকই, কিন্তু তারা কি তাদের বাবার হজ্জটা আদায় করে দেয়ার মানসিকতা রাখে?

সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলিম ব্যাক্তির জন্য হজ্জ করা অবশ্য করনীয় মৌলিক ইবাদাত। এ প্রসংগে আল কুরআনে বলা হয়েছে –

“মানুষের উপর মহান আল্লাহর অধিকার হল, যে ব্যক্তি বায়তুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার শক্তি ও সামর্থ রাখে সে যেন হজ্জ সম্পাদন করে এবং যে ব্যক্তি এ নির্দেশ অমান্য করে কুফরীর আচরণ করবে তার জেনে রাখা উচিৎ, মহান আল্লাহ বিশ্বজগতে কারো মুখাপেক্ষী নন।” (সূরা আলে ইমরান -৩/৯৭)

রসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যদি কোন ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে অস্বচ্ছল অবস্থায় না থাকে, কিংবা রোগগ্রস্ত না হয়ে পড়ে, অথবা কোন অত্যাচারী শাসকের পক্ষ থেকে কোন বাধা-বিপত্তি সৃষ্টি না হয়ে থাকে; তার পরও যদি সে হজ্জ সম্পাদন না করে, তবে সে চাই ইহুদি বা খৃষ্টানদের মত মৃত্যুবরণ করুক, তাতে কিছুই যায় আসেনা।

আরেক দল আছেন যারা জানেন না তাদের উপর হজ্জ ফরয কি না, কিন্তু তারা অন্যান্য ইবাদাতের বিষয়ে সিরিয়াস। অনেকেই হজ্জ এবং যাকাতের নিয়ম গুলিয়ে ফেলেন। কারো কারো ধারণা, অঢেল টাকাকড়ি থাকলে হজ্জ ফরয। আবার অনেকেই নিয়ম জানেন, কিন্তু একসাথে এত টাকা এখনি খরচ না করে পরে করবেন ভাবেন। তাদের সামনে অনেক খরচ, মেয়ের বিয়ে, নতুন বাড়ি, ইত্যাদি ইত্যাদি।

আরেকজনের কথা বলি। তিনিও বিত্তবান, সম্ভান্ত পরিবারের লোক। হজ্জ ফরয হয়েছে বহুদিন। কিন্তু মেয়ের বিয়ে না দিয়ে তিনি যাবেন না হজ্জে। মেয়ের বিয়ে হলো ঠিকই। কিন্তু ততদিনে তিনি হজ্জে যাবার আর্থিক সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছেন। হজ্জ দূরে থাক, অন্যের যাকাতের টাকায় তার সংসার চলে। কিন্তু মাথায় ফরয হজ্জ রয়ে গেছে।

আরেক দল আছেন, যারা ভাবেন মরার আগে হজ্জ করলে যেহেতু সব পাপ মাফ হয়ে যায়; তাই একবারে সব পাপ করে, মরার আগে ভালো হয়ে, নিষ্পাপ হয়ে মারা যাব। 

আমার মনে হয়, হজ্জের ব্যাপারে কম জানার কারণ অসচেতনতা। একজন মুসলিম যখন নামাজ না পড়েন, রমাদানে রোজা না রাখেন – আমরা তাকে ডাকি, বোঝাই এসবের গুরুত্ব। জেনে বুঝে একটা ফরয তরক করা বিরাট গুনাহের কাজ। অনেক আলেম বলেন, ফরয কাজ ছেড়ে দিলে সে আর মুসলিম থাকে না। আর হজ্জ এমনই একটা ফরয, যাকে আমরা মোটেই গুরুত্ব দিচ্ছিনা। যা একই মানের ফরয কাজ, ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি। পার্থক্য শুধু, নামাজ সবার উপর ফরজ আর হজ্জ শুধু বিত্তবানদের জন্য।

আমাদের দেশে যারা হজ্জ করেন, তাদের বেশির ভাগ বয়স্ক মানুষ। এই বছর যারা হজ্জ করেছেন তাদের প্রায় ৮০ ভাগ লোকের বয়স ৫০ এর বেশি। আমাদের ধারণা, হজ্জ বৃদ্ধ বয়সের ইবাদাত।

যারা এসব ধারণার মধ্যে আছেন, অনেক বড় ভুলের মধ্যে আছেন। এগুলো হজ্জ থেকে মানুষকে বিরত রাখার জন্য শয়তানের মহা ষড়যন্ত্র। 

মহিলারা আরো বেশি অসচেতন হজ্জের ব্যাপ্রারে। দেশে অসংখ্য মহিলার হজ্জ ফরয। এ বছর আমাদের দেশ থেকে যাওয়া মহিলা হাজি ৩৫ শতাংশ, যা পুরুষের প্রায় অর্ধেক। অথচ মহিলাদের হজ্জকে জিহাদতুল্য ইবাদাত বলা হয়েছে।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, “হে আল্লাহর রাসুল(সাঃ) আমরা জিহাদকে সর্বোত্তম আমল মনে করি। কাজেই আমরা কি জিহাদ করবো না? তিনি বললেন, না, বরং তোমাদের মহিলাদের জন্য সর্বোত্তম জিহাদ হল, হজ্জে মাবরূর। (সহীহ বুখারী_ হজ্জ অধ্যায়)

মহিলাদের হজ্জে যাবার অন্যতম বড় শর্ত মাহরাম। যদি স্বামী হজ্জে যেতে অক্ষম হন, সেক্ষেত্রে তিনি তার অন্য যে কোন মাহরামের সাথে হজ্জে যেতে পারবেন। (সহীহ বুখারী) 

এই লেখা পড়ার পর অনেকেই আবিষ্কার করবেন আপনার উপর হজ্জ ফরয হয়ে গেছে অনেকদিন আগেই।

আসুন জেনে নিই কত সম্পদের মালিক হলে হজ্জ ফরয হয়।

হজ্জ ফরজ হবার শর্ত, আপনাকে সে পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে হবে যতটুকু থাকলে মক্কায় যাওয়া আসা এবং সেখানে থাকার ব্যবস্থা হয়ে যায়। আর এই ক’দিন আপনার বাসার খরচপত্রাদীও থাকতে হবে।

এখানে আপনি চাকরি করেন না করেন কিছু যায় আসে না। আপনার মাসিক কোন ইনকাম শর্ত নয়। বর্তমানে যিনি অন্তত ৩-৪ লাখ টাকার সম্পদের মালিক তার উপর হজ্জ ফরয। সম্পদ ক্যাশ হতে পারে আবার অন্যকিছু। যেমন মহিলাদের গয়না, দেনমোহর এর টাকা ইত্যাদি। এমন জমি, বাড়ি, গাড়ি, ফসল যেটা তার নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচে লাগে না। যদি কেউ জীবনে কোন এক সময় এই সম্পদের মালিক হয়ে যান, কিন্তু পরে সেটা পরে খরচ হয়ে যায়, তাতেও হজ্জ ফরযই থেকে যাবে। সম্পদের মালিকানা এক বছর পূর্ণ হওয়া কোন শর্ত নয়। কারো একাধিক বাড়ি আছে যার একটায় তিনি থাকেন, অন্যটার ভাড়ায় সংসার চলে। আরো দুইটা বাড়ি আছে যা এক্সট্রা। হয়তো তার কোন ক্যাশ টাকা নেই। সেক্ষেত্রে সেই এক্সট্রা বাড়ি বিক্রি করেই তাকে হজ্জে যেতে হবে। একই কথা গাড়ি, আবাদযোগ্য জমি অথবা অন্য যে কোনো সম্পদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কেউ এই পরিমাণ সম্পদ ব্যবসায় লাভ করলেন অথবা রিটায়ার্ড হবার পর এককালীন টাকা পেলেন – যে টাকাটা না হলেও তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় কোন প্রভাব পড়ে না, তার উপর হজ্জ ফরয হয়ে যায়।

অনেকে পরিকল্পিতভাবে অর্থ হাতে আসার সাথে সাথে সেটা খরচ করে ফেলেন।
এতে যাকাত দিতে হবে না, যেহেতু এক বছর সেটা থাকে না। কিন্তু হজ্জ ফরয হয়ে যায়।

অর্থাৎ, এমন পরিমাণ সম্পদ, যা আপনার প্রয়োজনের অতিরিক্ত, নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে লাগে না। যা আপনার কাছে জীবনের যে কোন এক সময়ে হাতে এসেছিল, আছে বা খরচ হয়ে গেছে, কিন্তু হজ্জ ফরয রয়ে যাবে।

আপুদের জিজ্ঞাসা করি – যারা পর্দা করেন, কেন করেন? অবশ্যই বলবেন, পর্দা আল্লাহর হুকুম, এটা ফরজ। না মানলে গুনাহগার হতে হবে, তাই।

হজ্জের ব্যাপারটা একেবারে সেইম।

এবার বলেন, পর্দা যখন থেকে ফরয তখন থেকে করতে হবে, নাকি নিজের যখন মনে চাইবে, তখন করবেন? অবশ্যই পর্দা যখন থেকে ফরয তখনই শুরু না করলে গুনাহ হবে।

এবার পর্দার জায়গায় হজ্জ শব্দটা লাগান, কি বুঝলেন ?

ধরেন, রাস্তায় একটা মেয়ে বেপর্দা হেটে যাচ্ছে। আপনার কী মনে হয়, মেয়েটা পর্দা কেন করেনা? কারন হতে পারে সে জানে না, অথবা হতে পারে জেনেও মানেনা। এবার বলেন, সে জানেনা বা মানেনা এই দুটোর কোনটা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য? আপনার কি মনে হয়, এই “জানিনা” বলাটা আমাদের জন্য কতটা গ্রহণযোগ্য। আপনি কি জানেন এবার মিস ওয়ার্ল্ড কে হয়েছে? আমাদের দেশে এই নিয়ে কত কাহিনী হয়েছে? ফেসবুকের জনক কে? এখন পৃথিবীতে সবচেয়ে বড়লোক কে? সৌদি আরব একটা রোবটকে নাগরিকত্ব দিয়েছে, সে দেশে আসছে – তাও তো জানেন নিশ্চই? তাহলে আপনি যখন বলবেন, হজ্জ ফরয কি না জানি না, সেটা কি গ্রহণযোগ্য? জবাব নিজেকে দিন। হাতের সেটটা থেকে দুই চারটা টিপ দিলেই যে জরুরি জিনিশটা জানা যায়, সেটা আপনি না জানলে তার জন্য আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করবেন, তাই ভাবছেন?

এখনো সময় আছে, আসুন সচেতন হই।

ফরজ হয়ে যায়নি তো!
ফাহমিদা হুসনে জাহান
(২৯ ডিসেম্বর ২০১৭)