নগরকৃষি

জান্নাতের বর্ণনায় অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে কোন শব্দগুলো? সবুজ, বাগান, গাছপালা, গাছের ছায়া, ফল, নহর। আমাদের রব্ব আমাদের হৃদয় সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। তিনি জানেন কিসের আমাদের হৃদয় প্রশান্ত হয়, চোখ শীতল হয়। যখন মন খুব বিক্ষিপ্ত থাকে, গাছপালায় ঘেরা সবুজ কোথাও হেটে আসলে আমাদের মন শান্ত হয়, অস্থিরতা কাটে। কিন্তু এই ইটকাঠের শহরে পার্ক বা বাগানের দেখা পাওয়া দুষ্কর। এখানেই সূচনা ঘটে ছাদ বাগান, ব্যাল্কনি গার্ডেনিং, ইন্ডোর প্ল্যান্টিং, নগরকৃষির মত টপিকের।

একদম কাঠখোট্টাবেরসিক না হলে, সবুজ সবাই ভালোবাসে, সবুজের মাঝে থাকতে পছন্দ করে। আগে যেখানে হাতেগোনা দুই একজন শৌখিন মানুষের বারান্দা/ছাদেই সবুজের দেখা মিলতো, আজ সেখানে শহরের বাড়িগুলোর বারান্দায় বারান্দায় লতাপাতা, সবুজের ছিটে দেখা মেলে। কেউ কেউ বারান্দা বা ছাদ সবুজে মুড়ে দিতে সফল তো কারো কারো অভিযোগ, “গাছ বাঁচে না।”

টবে গাছপালা লাগিয়ে একটু সবুজের প্রচেষ্টা করেছি স্কুলে পড়ার সময় থেকে। এক ঈদে আব্বুকে নিয়ে দোয়েল চত্বর থেকে অনেকগুলো গোলাপফুলের গাছ এনেছিলাম। গাছগুলো ফুলে ভর্তি ছিল। ফুলফুটলো, এরপর আস্তে আস্তে গাছগুলো মরে গেলো। বুঝিনি কেন মরে গেলো।

এরপরে নানা সময় নানা গাছপালা এনেছি, বাঁচেনি। শুধুমাত্র একটা মানিপ্ল্যান্ট, কাঁচের গ্লাসে বেসিনের উপর রেখেছিলাম। গাছটা বাড়েনি, আবার মরেওনি। বিয়ের পর যখন ফুলটাইম হোমমেকার ছিলাম, রোজ গাছে পানি দিতাম। গাছের পাতা হলুদ হয়ে যেতো, ফুল আসতো না, পাতা কুকড়ে যেতো।

কে যেন একবার বলেছিল, সবার হাতে গাছ হয় না। আমি বিশ্বাস করিনি। আমি জানতাম, আমি যত্ন নেওয়ার নিয়ম জানিনা। তাই বাঁচে না।

অবশেষে ঠিক করলাম গাছপালা নিয়ে একটু স্টাডি করবো, খোঁজ খবর নিবো। আগে এই বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের একমাত্র উপায় ছিল নার্সারির দোকানিরা। কিন্তু এই ইউটিউব – পিন্টারেস্টের যুগে জ্ঞানের দুয়ার খুলে গেলো আলহামদুলিল্লাহ।

টুকিটাক ঘাটাঘাটি করে যা বুঝলাম,

কিছু গাছ কড়া রোদে ভালো থাকবে। যেমন ফুল গাছ। এই গাছগুলোতে রোজ, মাটি শুকাবার আগেই পানি দিলে ফুল আসবে না। গাছগুলো ছেটে দিতে হবে। গাছ ছাটলে পাতা বাড়বে, ফুল আসবে। একে বলে প্রুনিং। আমার গোলাপ গাছগুলো মরে গিয়েছিল রোদ না পেয়ে আর অতিরিক্ত পানি দেওয়ায়। আর ডালগুলো ঠিক মত ছাটি নাই যেগুলো বেঁচে ছিল। ফলে ফুলও আসে নাই। গোলাপ গাছে সাত পাতার ডাল আসে যা পুরো উপরে ফেলতে হয়। কারণটা অন্য কখনো ব্যাখ্যা করব ইন শা আল্লাহ।

কিছু গাছ রোদে পাতা পুড়ে যায়। আলোতে ভালো থাকে, বাড়ে। ছায়ায় বেঁচে থাকে, বাড়ে না। যেমন মানি প্ল্যান্ট বা গোল্ডেন পথোস। এই গাছ পানিতেও বাঁচে, মাটিতেও। মাঝে মাঝে নির্দিষ্ট জায়গা থেকে শিকড় যেখান থেকে বের হয়, সেই জায়গা অক্ষত রেখে পানিতে রেখে দিলে কিছুদিনের মাঝে শেকড় গজায়। শেকড় গজানোর পরে সেটা মাটিতেও দেওয়া যায় আবার পানিতেও রাখা যায়। এই ব্যাপারটা হলো প্রোপোগেশন। পানিতে রাখলে গাছটা অস্বচ্ছ পাত্রে রাখতে হবে যেন শেকড়ে সূর্যের বা বালবের আলো সরাসরি না পৌছায়। মনে আছে আমার মানি প্ল্যান্ট বড় হচ্ছিলো না, এর কারণ ছিল, গাছটা স্বচ্ছ কাছের গ্লাসে ছিল।

গাছপালা নিয়ে গ্রুপে পোস্ট দেওয়ার পরে অনেক আপুই ইনবক্স করছে, বারান্দায় মিনি গার্ডেন করার শখ, কিন্তু গাছ বাঁচে না। এক্ষেত্রে আমার সাজেশন হবে,

১. প্রথমে ইন্ডোর প্ল্যান্ট দিয়ে শুরু করা, যেগুলো আলোতেই হয়। রোদ লাগে না। ওয়াশরুমে বেসিনের উপরে, বেসিনের উপরের গ্লাসে, ফ্লাশের উপর, ভেন্টিলেটরের জানালার কাছে ছোট ছোট পাত্রে গাছ রেখে দিন। ইন্ডোর প্ল্যান্ট কোন গুলো? মানি প্ল্যান্ট, স্নেক প্ল্যান্ট, লাকি বাম্বু, ফার্ন ইত্যাদি।

২. প্রথমেই মাটির গাছ দিয়ে শুরু না করে পানির গাছ থেকে শুরু করা। কেন? মাটি জোগাড় করা ঝামেলা। মাটিতে সার দিতে হবে। মাটি খুড়ে দিতে হবে। এত ঝামেলার পরে গাছ না বাঁচলে অনেক খারাপ লাগবে। গার্ডেনিং এর আগ্রহনষ্ট হয়ে যাবে। তার চেয়ে পানিতে এক দুইমাস গাছ রাখার পরে যখন সাহস হবে তখন মাটির গাছ লাগানো বুদ্ধিমানের কাজ। মানি প্ল্যান্ট, স্নেক প্ল্যান্ট পানিতে বাঁচে। তবে পানিটা ২/৩ দিন পরে পালটে দেবেন। ডালের যে অংশ পানিতে থাকবে সেখানকার পাতা তুলে ফেলবেন নয়তো পানির ভেতর পাতা পচে পানিটা দূষিত করে ফেলবে। এছাড়া পরিষ্কার পানিতে মশা ডিম পাড়ে, নিয়মিত পানি পালটে দেওয়া হলে মশার বংশ বিস্তার রোধ করা সহজ হবে ইন শা আল্লাহ।

৩. ঘ্রানযুক্ত ফুলের গাছ সবারই ভালো লাগে। কিন্তু এগুলোর যত্ন লাগে বেশি। রোদ লাগবে, মাটি খুড়ে না দিলে ভিতরে অক্সিজেন যাবেনা, সার দিতে হবে, প্রুনিং করতে হবে ফুলের জন্য। এরচেয়ে ঘ্রানহীন ফুল গাছের নখরা কম। যেমন নয়নতারা, অপরাজিতা, পর্তুলিকা(এতে আবার মিলিবাগ হয়)। ফুলের গাছের মাটি শুকালেই পানি দেবেন। মাটিতে হাত দিয়ে দেখবেন মাটি ভেজা নাকি শুকনো। শুকনো হলেই পানি দেবেন। আর অপরাজিতায় বীজ হলেই উঠিয়ে ফেলবেন, বা হওয়ার আগেই ফুল উঠিয়ে ফেলবেন। বীজ হলে গাছ ভাবে তার কাজ শেষ, আর ফুল দিতে হবেনা। তখন ফুলের সংখ্যা কমে যায়।

৪. টবে শসা, করল্লা, লেবু, মরিচ চাষ করা যায়। নিজের গাছের সবজির মজাই অন্যরকম। তবে এ বিষয়ে আমার নিজেরই অনেক কিছু জানার আছে। টুকটাক ইনফো জোগাড় করে পরে কখনো এই নিয়ে বলা যাবে ইন শা আল্লাহ।

কোন গাছ লাগানো হবে সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া শেষ। এবার কিভাবে গাছ লাগাবো সেই বিষয়ে আসি।

১.যেকোন গাছের জন্য ড্রেনেজ সিস্টেম বা পানি নিষ্কাশনটা খুব জরুরী। গাছে বেশি পানি জমে থাকলে পাতা হলুদ হয়ে যায়, গোড়া পচে যায়। টবের নিচে যে ছিদ্র থাকে সেটার উপর এক লেয়ার ইটের কুচি দিয়ে তার পর যদি মাটি দেওয়া হয় তবে টবের ড্রেনেজ সিস্টেম ঠিক থাকে। নাহলে মাটি জমে পানি বের হওয়ার পথ আটকে যায়।

২. গাছ ভালো হয় দো আঁশ মাটিতে। এই মাটি পানি ধরে রাখেনা। ফলে পানি জমে গোড়া পচে যাওয়ার ভয় কম থাকে। কিন্তু এই মাটি সব সময় পাওয়া যায়না। পাওয়া যায় এটেল মাটি, যা পানি দিলেই কাদা কাদা হয়ে যায়। এই মাটিতে বালি মিশিয়েও সেটাকে গাছ লাগানোর উপযুক্ত করা যায়। মাটির সাথে ভার্মিকম্পোস্ট মিশিয়ে লাগালে মাটির গুণগতমান বেড়ে যায়। ভার্মিকম্পোস্ট অনলাইন ছাড়াও দোয়েল চত্বরের নার্সারিগুলোতে পাবেন ইন শা আল্লাহ।

৩. গাছে মাসে একবার সার দিতে হয়। সারগুলো জৈবসার হওয়াই উত্তম। ডিমের খোসা ধুয়ে রোদে শুকিয়ে গুড়ো করে, ব্যবহৃত চাপাতার দুধ চিনি ধুয়ে রোদে শুকিয়ে, কলার খোসা কেচি দিয়ে কেটে রোদে শুকিয়ে গুড়ো করে নিয়ে তিনটাই সমপরিমাণ করে মাটিতে দিতে পারেন। হয়ে গেলো NPK সার (নাইট্রোজেন, ফসফরাস,পটাসিয়াম)।

এছাড়া চাল-ডাল ধোয়া পানি, সবজির খোসা পচানো পানি ইত্যাদি দেওয়া যায়। ভার্মিকম্পোস্টও দেওয়া যায়।

কি দেওয়া যাবে না? দুধ, চিনি, লবণ মিশ্রিত কিছু, রান্না করা কিছু, মাছ, মাংস। রাসায়নিক সার দিলে পরিমাণে বেশি হলে গাছ মারা যাবে।

১৫ দিনে একবার গাছে এপসম সল্ট দেওয়া যায়। এপসম সল্ট গাছের পাতার যত্ন নেয়, পাতা আরো সবুজ হয়। এতে ম্যাগ্নেসিয়াম থাকে। ১লিটার পানিতে ১ চা চামচ এপসম সল্ট মিশিয়ে স্প্রে করতে হয়।

গাছ লাগানোর প্রক্রিয়া জানা শেষ। এবার একটু বলে রাখি কিসে গাছ লাগাব। গাছের জন্য প্রথমেই টব-প্লেট কিনে খরচ না করে প্রথমে বাসায় থাকা প্লাস্টিকের বোতল, ফেটে যাওয়া গ্লাস, মগে গাছ লাগানো ভালো। সাফল্যের মুখ দেখার পরে টব কিনে সাজালে নিজের কাছে ভালো লাগবে। আর প্লাস্টিকের টবের চেয়ে টেরাকোটা বা মাটির তৈরি টব গাছের জন্য এবং প্রকৃতির জন্য উত্তম।

যেকোন ভালো কাজ আল্লাহর জন্য করলে সেই কাজের প্রতিদানও পাবেন আল্লাহ সুবহানাতা’লার কাছ থেকে। গাছগুলোর যত্ন আত্তি করবেন আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নিয়তে।

আল্লাহ সুবহানা তা’লা আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতের ঘরগুলো সবুজে সবুজে মুড়ে দিন। আমিন।

নগরকৃষি
নূরুন আ’লা নূর

(০৪/০৫/২০১৯)