বিজলী

মিরা আর রুকু দুই বোন। মিরার বয়স আট আর রুকু সবে পাঁচ এ পড়েছে। বাবা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আর মা ডাক্তার। সারাদিন দুই বোন বাসায় একাই থাকে।আর সাথে থাকে দুঃসম্পর্কের মুন্নি ফুপু। মুন্নি ফুপুই দুই বোনের সব। স্কুল থেকে আনা, দুপুরে ভাত খাওয়ানো, হোম ওয়ার্ক করানো, সব কাজই মুন্নি ফুপুর করতে হয়।কিন্তু তাতে মুন্নি ফুপির কোন বিরক্তি নাই। দুই বোন কে নিজের সন্তানের মতই ভালাবাসে মুন্নি ফুপু।

প্রতিদিন দুপুর বেলা দুই বোন কে ভাত খাওয়াতে গিয়ে মুন্নি ফুপির রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়। মিরা তবুও দু একটি গল্প বললে নিজে নিজেই খেয়ে ফেলে কিন্তু রুকু কে কোন কিছু দিয়েই আয়ত্তে আনা যায় না। প্রতিদিন একই কথা, ‘ভাত খাব না, আমি
চানাচুর খাব, বয়াম থেকে বিস্কিট দাও’। ‘চানাচুর খেলে পেট খারাপ হবে’, এই ভয় দেখিয়ে যখনই মুন্নি ফুপি ভাত মাখাতে গেল তখন শুরু হয় আর এক আবদার, ‘শাক আর ভেজিটেবল খাব না, শুধু চিকেন দিয়ে খাব’।

মুন্নি ফুপি লুকিয়ে লুকিয়ে একটু শাক-সব্জি ভাত আর ডালের মাঝে একদম মিশিয়ে দিয়ে তারপর খাদ্য যুদ্ধে নামে। ৩/৪ চামচ খাওয়ার পর আর এক নতুন বায়না, ‘কার্টুন দাও, কার্টুন দেখে ভাত খাব’। কিন্তু রুকুর বাবা-মায়ের কড়া নিষেধাজ্ঞা কার্টুন দেখে ভাত খাওয়া যাবে না। শুধু শুক্রবার এক ঘণ্টা কার্টুন দেখা যাবে, এর বেশি নয়। ছোটবেলা থেকেই এভাবে সারাদিন কার্টুন দেখে দেখে মিরার এই বয়সেই চশমা লেগেছে। রুকুর ক্ষেত্রে সে ভুল হতে দেয়া যাবে না।

সেদিন এমনই এক দুপুর বেলা রুকু আর মুন্নি ফুপির মধ্যে ভাত নিয়ে বিরাট যুদ্ধ চলছে, হঠাৎ দরজার বাইরে শোনা গেল ‘মিয়াঁও’। দরজা খুলে দেখা গেল সাদা ধবধবে একটা বাচ্চা বেড়াল দুটা সবুজ চোখ দিয়ে অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছে। রুকু চিৎকার করে উঠল, ‘মিরা আপু, দেখতে এস, একটা বাবু বিড়াল আমাদের দরজায় বসে আছে’। মিরা ছুটে আসলো, ও মা, বিড়ালটা কি কিউট! দেখ দেখ আমাদের দেখে কিভাবে লেজ নাড়ছে’। মুন্নি ফুপি ও ভেবে পেল না কোথা থেকে বিড়ালের বাচ্চাটা এই তিন তলায় উঠে এসেছে। মিরার খুব মায়া লাগল, ‘দ্যাখ ফুপি, বেড়ালটা কিভাবে ডাকছে, মনে হয় অনেক খিদে লেগেছে’। রুকু দৌড়ে ভেতরে গিয়ে নিজের প্লেট থেকে একটু মাছ এনে দিল। বেড়ালটা গপগপ করে খেয়ে ফেলল।

সেইদিন থেকে রুকু কে দুপুরে ভাত খাওয়াতে মুন্নি ফুপির আর মোটেও কষ্ট হত না। প্রতিদিন দুপুর হলেই মুন্নি ফুপি, মিরা আর রুকু অধীর আগ্রহে মাছ ভাজা দিয়ে ভাত মেখে বেড়াল ছানাটির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। বেড়াল ছানাটিও ঠিক দুপুর দুইটায় ওদের বাসার দরজায় এসে মেয়াঁও মেয়াঁও করতে থাকে। মিরা বেড়াল ছানাটির একটি নাম দিয়ে দিল- ‘বিজলী’। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিজলীর সাথে দুই বোনের গভীর ভালবাসা হয়ে গেল। দুপুরের খাওয়া শেষে দুই বোন বিজলী কে নিয়ে অসীম আনন্দে মেতে উঠে। বাথটাবে নিয়ে গরম পানি আর শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করাবে, চিরুনি দিয়ে গায়ের পশম আঁচড়ে দিবে তারপর নিজেদের রুম এ নিয়ে যাবে ঘুম পাড়াতে। বিজলীও খুব ভদ্র বিড়াল।কখনও ঘরে হিসু করবে না, খাবারে মুখ দিবে না এবং বাসার জিনিসপত্রও নষ্ট করবে না।

তিনটার দিকে মুন্নি ফুপি মিরা আর রুকু কে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে পড়ে আর নীচে শুয়ে পড়ে ছোট্ট বিজলী। মিরা আর রুকু তাদের ছোটবেলার একটি ফোমের বিছানা সবসময় নীচে বিছিয়ে রাখে। বিজলী সেখানেই ঘুমায়। বিকালে বিজলী কে নিয়ে দুই বোন ছাদে চলে যায়।এই সময়টা মিরা আর রুকুর সবচেয়ে আনন্দের আর উত্তেজনার। ওরা বিজলী কে নিয়ে বল খেলে, লুকুচুরি খেলে। সন্ধ্যা হলেই ওরা তাড়াতাড়ি বিজলীকে নীচে রেখে আসে। কারণ এ সময় মা ঘরে ফেরে। মা আবার একদম বেড়াল দেখতে পারে না।বিজলী ব্যাপারটা না বুঝলেও এটা বোঝে যে, সন্ধ্যার পর এই বাসায় সে আর থাকতে পারবে না।

একদিন দুপুর বেলা। হঠাৎ মা এসে হাজির। মার শরীর অসুস্থ, তাই আগে চলে এসেছে। এসেই ঘরের ভেতরে বিজলি কে দেখতে পায়। বিজলী কিছু বুঝতে না পেরে মায়ের পায়ের কাছে এসে মেয়াঁও মেয়াঁও ডাকতে শুরু করে। মা প্রচণ্ড রেগে যায়। ‘মুন্নি, মুন্নি এখানে বেড়াল কিভাবে ঢুকল? জানো না, বেড়ালের আঁচড়ে ইনফেকশান হয়’? মা চিৎকার করে উঠল।

রুকু সরল মনে বলে ফেলল, ‘মা ওতো প্রতিদিনই আমাদের বাসায় আসে, কই কখনতো আঁচড় দেয় না’। ‘ওঃ!প্রতিদিনই বাসায় আসে; আমি থাকি না, এই ফাঁকে বাসায় বেড়াল পালা হচ্ছে? এখনই এটাকে নীচে রেখে আস’। মিরা আর রুকু যতই কেঁদে কেঁদে মাকে বোঝাতে লাগল মা ততই রেগে যেতে লাগলো। বিজলী ভয়ে এক কোণায় চুপ করে বসে আছে, প্লেটের মাখা ভাত একদমই মুখে দিচ্ছে না। একটু পর মা নীচের দাড়ওয়ান কে ডেকে আনল। ‘যাও, এই বেড়ালটাকে বস্তায় ভরে ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে রেখে এস। আর কখনো যেন এই এলাকায় আসতে না পারে’, মায়ের কড়া নির্দেশ। দুই বোন দৌড়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘরের ভেতরে চলে গেল।

সেইদিন থেকে বিজলী যেন কোথায় হারিয়ে গেল। মিরা আর রুকু প্রতিদিন দুপুরে অপেক্ষা করে, দরজার বাইরে থেকে বিজলির মেয়াঁও মেয়াঁও ডাক শোনার জন্য। একদিন, দুদিন এভাবে এক মাস কেটে গেল।মিরা আর রুকুর দুপুর-বিকালগুলো এখন শুধুই কষ্ট আর বিষণ্ণতায় ভরা। ওরা বিজলী কে ভুলতে পারে না, ভুলতে পারে না। ওদের কষ্ট দেখে মায়েরও মন খারাপ হয়। তিনি সেদিনের ভুলের জন্য আফসোস করেন মনে মনে।

বস্তায় ঢোকানোর আগে বিজলী কেমন ছলছল চোখে মিরা আর রুকুর দিকে তাকাচ্ছিল, যেন বলছিল, ‘আমি যাব না, আমি তোমাদের ছাড়া থাকতে পারব না’।
বসন্ত পেরিয়ে গ্রীষ্ম চলে এল। সেদিন ছিল ছুটির দিন।দুপুর থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল। বিকালের পর চারদিক ঘন কাল অন্ধকারে ছেয়ে গেল। একটু পরেই শুরু হল ঝড়। মা ভেতরে ঘুমুচ্ছে।মিরা আর রুকু ঝড়-বৃষ্টি দেখতে দেখতে ছবি আঁকছিল।

সন্ধ্যা নামতেই বৃষ্টি আরও বেড়ে গেল।হঠাৎ রুকু বলল, ‘মিরা আপু, দরজার বাইরে থেকে কেমন যেন একটা মেয়াঁও মেয়াঁও ডাক শোনা যাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছ’? ‘ও তোমার মনের ভুল’, মিরা উত্তর দিল। একটু পর আবার ডাকটা শোনা গেল। দুজনই দৌড়ে দরজা খুলল।

অবাক হয়ে দেখল তাদের আদরের বিজলী শুকনো মুখে বসে আছে। গায়ের রঙ কেমন ময়লা হয়ে গেছে, নরম তুলতুলে শরীরটা একদম শুকিয়ে গেছে, মাথায় আঘাতের চিনহ, সেখান থেকে রক্ত পড়ছে, সারা শরীর থেকে পানি ঝড়ছে। শীতে বেড়ালটা ঠকঠক করে কাঁপছে।

রুকু কেঁদে ফেলল। মিরা দৌড়ে ভেতর থেকে নিজের দুধের কাপটা নিয়ে আসলো। বিজলী মুহূর্তের মধ্যে দুধটা শেষ করে ফেলল। হঠাৎ পেছন থেকে মার গলা শোনা গেল, ‘এই তোমরা বাইরে কি করছ? ভেতরে এস’। দুজনই ভয়ে কোন উত্তর দিতে পারল না। কোন উত্তর না পেয়ে মা বাইরে চলে আসলো। বিজলী কে দেখে মা চমকে উঠল।

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মা বলল, ‘এটা তোমাদের সেই বিড়ালটা না? আহারে, ভিজে কেমন চুপচুপে হয়ে গেছে! এই কয় দিনে কি অবস্থা হয়েছে, চেনাই যাচ্ছেনা! তোমরা তো খুব নিষ্ঠুর, ওকে এভাবে বাইরে ফেলে রেখেছ? দেখেছ, ঠাণ্ডায় শরীর কেমন নীল হয়ে গেছে!আর কিছুক্ষণ এভাবে পড়ে থাকলে নির্ঘাত বেড়ালটা মারা যাবে’। মিরা আর রুকু দুজন দুজনের দিকে অবাক হয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। মা চিৎকার করে উঠল, ‘মুন্নি এক্ষুণই ওকে ভেতরে ঢোকাও। আর রান্নাঘর থেকে কিছু খাবার নিয়ে এস’। বিজলী মাছ আর গোশত দিয়ে ভাত খেল। মা নিজ হাতে বিজলির মাথায় ঔষধ লাগিয়ে দিল, তারপর একটি নরম তোয়ালে বিজলির গায়ে জড়িয়ে ওকে রান্নাঘরে রেখে আসল। রান্নাঘরের চুলার গরমে বিজলি একটু পরই ঘুমিয়ে গেল।

মিরা আর রুকু এতক্ষণ শুধু চোখ বড় বড় করে মায়ের কাজ-কারবার দেখছিল।এবার রুকু জিজ্ঞেস করল, ‘মা তুমি বেড়াল ভালবাস’? মা হেসে উত্তর দিল, ‘বেড়াল ভালবাসি না; তবে তোমাদের মত আমিও ওর মায়ায় পড়ে গেছি। তাছাড়া ও অসুস্থ, ক্ষুধার্ত। আল্লাহ্‌র সৃষ্টিকে যদি তুমি দয়া কর, আল্লাহ্‌ও তোমাকে দয়া করবেন। আজ থেকে ও আমাদের সাথেই থাকবে’।‘সতিই??’ চিৎকার করে উঠল মিরা। রুকু দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। “সত্যি, তবে ওকে আমরা ভ্যাক্সিন দিয়ে নেব ইন শা আল্লাহ।” দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন মা।

বিজলী
সালমা জাবীন
(২২ মার্চ ২০১৮)