বোধ

চারদিকে শুধু পানি আর পানি! সামির দুই হাত উঁচিয়ে প্রাণপণে সমস্ত শক্তি দিয়ে শেষ নিঃশ্বাসটুকু ধরে রাখার চেষ্টা করছ। চেষ্টা করছে চিৎকার করে বলতে, ‘বাঁচাও! বাঁচাও! প্লীজ কেউ বাঁচাও!’ কিন্তু এক ফোটা আওয়াজও গলা হতে বের হল না। নাক মুখ দিয়ে পানি ঢুকছে। আস্তে আস্তে নিকষ কাল অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে সামির। হয়ত আর কোনদিন এই পৃথিবীর আলো সে দেখতে পাবে না।

সামিরদের গ্রামের বাড়ীতে চলছে বিলাপ আর শোকের মাতম। সামিরের বাবা একেবারে পাথর হয়ে গেছে। মা একটু পরপর বেহুঁশ হয়ে যাচ্ছে। জ্ঞান ফিরলেই জিজ্ঞেস করছে সামিরের কোন খোঁজ পাওয়া গেছে কিনা। সামিরের বড় ভাইবোনরা কেবল কেঁদেই চলেছে। চাচা-ফুপুরা সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা।

জেলেরা এরই মধ্যে নদীতে কয়েকবার ডুব দিয়ে খোঁজ করে এসেছে। ছোট চাচা সামিরের নিখোঁজ সংবাদ দিয়ে মাইকিং এর ব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন।

সামিরের যখন জ্ঞান ফিরল, তখন চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। থেকে থেকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। সামিরের খুব দুর্বল লাগছে, মাথাটা খুব হালকা মনে হচ্ছে। চোখ মেলে হারিকেনের আবছা আলোয় অনেকগুলো অচেনা মুখ দেখতে পেল সে। সামির উঠে বসতে চাইল। কে যেন খুব স্নেহমাখা গলায় বলল, ‘থাক থাক, তুমি শুইয়া থাক বাবা’। একজন বয়স্ক মহিলা তাকে চামচে করে অল্প অল্প করে গরম দুধ খাইয়ে দিলেন। সামির প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিল না। বার বার দুর্বল গলায় জিজ্ঞেস করছিল, ‘আমি কোথায়? বাবা কোথায়? মাকে দেখছিনা কেন?’ কেউ কোন কথা বলছিল না। আস্তে আস্তে সামিরের সব মনে পড়তে লাগল।

সামিরের পরিবার এক সপ্তাহ্ আগে গ্রামের বাড়ীতে বেড়াতে এসেছে। উপলক্ষ্য ছোট চাচার বউভাত। সামিরের সব চাচা-ফুপু আর কাজিনরা অনেক দিন পর একসাথে হল। দাদী মারা যাওয়ার পর এখন আর কারোরই তেমন একটা গ্রামে আসা হয় না। খুব ভাল ভাবেই অনুষ্ঠান শেষ হল। সবাই খুব মজা করল। আগামীকাল সবারই ঢাকা ফিরে যাওয়ার কথা। তাই আজ বিকেলে সামিরের সব চাচাত-ফুপাত ভাইরা গিয়েছিল গ্রামের পাশের পায়রা নদীতে। মাছ ধরবে বলে।

মাছ ধরা শেষে বিকেলের মিষ্টি রোদে সবাই নদীতে নামল গোসল করতে। সামিরও নামল। সামিরের কাজিনরা সবাই মজা করে সাঁতারের প্রতিযোগিতা করছিল।সবাইকে ছাড়িয়ে কখন যে মাঝ নদীতে চলে এসেছে, সামির নিজেও বুঝতে পারেনি। হঠাৎ একটা বিশাল ঢেউ এসে সামিরের উপর আছড়ে পড়ল। তারপর আর কিছু মনে নেই।

পরদিন সকালে সামির অনেকটাই ভাল বোধ করল, উঠে বসতে পারল। ক্রমেই সে জানতে পারল সেদিন নদীর ভেতর যখন তলিয়ে যাচ্ছিল, তখন বাকের আর কসির নামে দুটি ছেলে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে উদ্ধার করে। তারপর তাদের বাড়িতে তুলে আনে। এটা একটা জেলে পল্লী। সামিরদের গ্রাম হতে বেশ দূরে, নদীর অপর পাড়ে অবস্থিত। সামির তার বাবার নাম, চাচার নাম বলল। কিন্তু জেলেরা চিনতে পারল না।

বাকের ও কসির চাচাতো ভাই। বয়স দশ-এগারো হবে, সামিরেরই বয়সী। এই পরিবারটি একটি যৌথ পরিবার। বাবা, চাচা, ফুপু, দাদা-দাদী সবাই মিলেমিশে থাকে।

কসিরের বাবা সামিরের মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘বাবা, যেই কয়দিন আমরা তোমার আব্বার খোঁজ না পাই, তুমি আমাগো সাথে এইখানেই থাক। তুমার একটু কষ্ট হইব, কি আর করা!’

সামির কিছুক্ষণ মুখ লুকিয়ে কাঁদল। এই গ্রাম্য অশিক্ষিত মানুষগুলোর মাঝে, এই অচেনা পরিবেশে সে কিভাবে থাকবে? সামির যে বেঁচে আছে তা কি তার বাবা-মা জানে?

একটু পর কসির এসে সামির কে নাস্তা খেতে ডেকে নিয়ে গেল। সামির দেখল সবাই উঠানের মাটিতে বসে একসাথে নাস্তা খাচ্ছে। পরিবারের সবাইকে একসাথে খেতে দেখে সামির ভাবল বাবা, মা, ভাই, বোন সবাই মিলে কবে যে এভাবে একসাথে নাস্তা খেয়েছি মনে পড়ে না। আরও অবাক হয়ে দেখল সবার মাটির পাত্রে একই নাস্তা, একগাদা পান্তা ভাত সাথে একটু শুঁটকি ভর্তা আর একটা পোড়া মরিচ। বাড়ির পুঁচকে বাচ্চাগুলোও নিজ হাতে মরিচ কচলে পানি মেশানো ঠাণ্ডা ভাত তৃপ্তির সাথে খাচ্ছে। সামিরের ইতস্তত ভাব দেখে বাকেরের ফুপু বলল, ‘বইসা পড় বাপজান। আমরা গরীব মানুষ, অ্যার থে ভালা কিছু থাকলে আমরা তুমারে সেইটাই খাইতে দিতাম।’ সামির ভাবলো, এরা কত সহজে মানুষ কে ‘বাপ’ ডেকে ফেলে অথচ এখনো সে ওদের ঠিকমত বিশ্বাসই করতে পারছে না। খেতে গিয়ে সামির খেয়াল করল কসির ও বাকেরের বৃদ্ধ দাদী হাতপাখা দিয়ে সামিরের পিঠে বাতাস করছে। পান্তা-শুটকি দিয়ে নাস্তা শেষে সামিরের মনে হল, পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু খাবারটাই সে এইমাত্র খেল।

নাস্তার পর বাকের আর কসির সামির কে ঘুরে ঘুরে জেলে পল্লী দেখাতে লাগল। এ গ্রামে প্রায় ৪০-৫০ টা ঘর আছে। প্রতিটা পরিবারই অভাব, দরিদ্রতা আর অসুখ-বিসুখের সাথে লড়াই করে টিকে আছে। বাড়ীর পুরুষরা প্রতিদিন ভোরবেলা আলো ফোটার আগেই নদীতে চলে যায় মাছ ধরতে। মহিলারা এসময় উঠোনে জাল বোনে, জাল মেরামত করে, বড়শি্তে সুতা লাগায়। প্রতিটা বাড়ীতেই রয়েছে দুই থেকে তিনটা ঘর। আট থেকে দশজন মানুষ সেখানে গাদাগাদি করে থাকে। রান্নাঘর বাড়ীর উঠোনে খোলা আকাশের নীচে আর টয়লেট বাড়ীর পেছনে ডোবার পাশে।

সামিরদের তিন ভাইবোনের তিনটা বেড রুম, সাথে লাগোয়া বাথরুম ও বারান্দা। প্রতিটা রুমেই রয়েছে এসি, ওয়াল ক্যাবিনেট, বিশাল স্ক্রীন এর এলসিডি টিভি, কম্পিউটার আরও কত কি! তারপরও এপার্টমেন্টটা পুরনো হয়েছে এই কারণে আগামী মাসে সামিররা চলে যাচ্ছে গুলশানের নতুন ডুপ্লেক্স বাড়ীতে।

আসবাবপত্রবিহীন এই মাটির ঘরের মানুষগুলো কে সামির যতই দেখছে, ততই ভাবছে এরা এই পরিবেশে কিভাবে বেঁচে আছে? বাকেরের দাদা চোখে কিছু দেখে না। দুই চোখে অনেক আগেই ছানি পড়েছে। টাকার অভাবে অপারেশন করাতে পারেনি। ফলে দুই চোখই এখন অন্ধ হয়ে গেছে। সামির সবচেয়ে অবাক হল জেলে পরিবারের ছোট ছোট বাচ্চাগুলোকে দেখে। পাচঁ-ছয় বছরের এই বাচ্চাগুলো নিজেদের সব কাজ নিজেরাই করে। খাওয়া, গোসল, নিজেদের কাপড় ধোয়া, বিছানা করা সব কাজ তারা খুশী মনে একা একাই করছে। মাকে কিছু বলতেই হচ্ছে না। যারা একটু বড়, দশ-বার বছরের তারা ঘরের কাজে বাবা-মাকে অনেক সাহায্য করে। বাড়ীর পশু-পাখী দেখাশোনা করা, মাটির চুলা জ্বালাতে গাছের ডাল, পাতা কুড়িয়ে আনা, পুকুর থেকে পানি আনা, ক্ষেতে পানি দেয়া, বাজার করা ইত্যাদি সব কাজ তারা নিজেরাই করে। শুধু তাই নয়, ওরা উপার্জনেও অনেক সাহায্য করে। কসির প্রতিদিন সূর্য উঠার আগে বাবার সাথে নদীতে চলে যায় মাছ ধরতে, তার স্বপ্ন বড় হয়ে সে বাবার চেয়েও বড় জেলে হয়ে সাগরের বড় বড় মাছ ধরবে। শেষ বয়সে বাবা-মাকে একটু আরাম দিবে এটাই তার একমাত্র ইচ্ছা।

বাকেরের নিজের কয়েকটি মুরগী আছে। সে মুরগীগুলো ডিম দিলে তা বিক্রি করে সে দাদার চোখের জন্য ঔষধ কিনে আনে। বাকেরের বড় বোন মরিয়ম খুব ভাল মাছ ধরার খাঁচা বানাতে পারে। প্রতিদিন ৬/৭ টা খাঁচা বিক্রি করে যা পায়, হাসিমুখে তা মার হাতে তুলে দেয়। মার যে সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হয়!

সামির ভাবল বাসায় এত স্মার্ট ফোন, টিভি, কম্পিউটার, ভিডিও গেমস, আইপ্যাড তবুও আমরা বোর হয়ে যাই; আর এরা জানেইনা আনন্দ, মজা আর ফ্রি টাইম কি জিনিস? পার্টি, রেস্টুরেন্ট, শপিং মল, ফেসবুক-ইন্সটাগ্রাম, আড্ডা-এডভেঞ্চার এগুলো ছাড়া মানুষ দিনের পর দিন এরকম বোরিং জীবনযাপন করতে পারে? অথচ কারো মধ্যেই কোন দুঃখ বা হতাশা নেই।

সামির কসির কে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাদের স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না?’ কসির ম্লান মুখে জবাব দিল, ‘ইচ্ছা তো করে, তয় ইস্কুলে গেলে বাপজানের মাছ ধরতে অনেক কষ্ট হইয়া যায়। আমি সাথে গেলে, আমি নৌকা চালাই আর বাপজান মাছ ধরে’। একটু পরই কসিরের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সামির কে বলল, ‘জান ভাই, আমার গাভীটানা একটা বাছুর দিছে। বাছুরডা একটু বড় হইলে বিক্রি কইরা দিমু, তারপর বাপজানরে একটা বড় দেইখা জাল কিইনা দিমু। এই জালটা কেমুন পুরান হইয়া গেছে।’ কসির, বাকেরের কথা শুনতে শুনতে সামিরের মন খারাপ হয়ে যায়।

কতদিন বাবা মিটিং সেরে রাত করে বাড়ী ফিরেছে, সামির ল্যাপটপের গেমস ছেড়ে, একবারও উঠে জিজ্ঞেস করেনি, ‘বাবা খেয়ে এসেছ?’ মা প্রায়ই মাইগ্রেনের ব্যথায় অস্থির হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাতি নিভিয়ে বিছানায় পড়ে থাকে। স্কুল, প্রাইভেট টিউটর, ক্রিকেট কোচিং, সুইমিং এত কিছুর পর মাকে দেখার সময় কোথায়? নানাভাই এর গত মাসে হার্টের অপারেশন হয়েছে। আজ পর্যন্ত একবারও দেখতে যায়নি।

রাতে কসিরের বাবা বাড়ী ফিরল অনেকগুলো পুঁটি মাছ ধরে। সবার চোখে-মুখে ঈদের আনন্দ! কারণ আজ বাড়ীতে সামিরের জন্য ভাল রান্না হবে। রান্না করবে কসিরের বৃদ্ধ দাদী। খেতে বসে সামির দেখল পুঁটি মাছ, চিংড়িশুঁটকি দিয়ে কচুর লতি আর মাসকলাইয়ের ডাল রান্না করা হয়েছে। তৃপ্তি ভরে দুই প্লেট ভাত খাওয়ার পর সামির ভাবল পুঁটি মাছের এই লাল ঝোলের কাছে কে এফ সি, পিজা হাট সব ফেল। খাওয়া শেষে উঠতে গিয়ে সামির দেখল বাকেরের মা এক বাটি পুঁটি মাছের তরকারী পাশের বাড়ীর জেলেদের বাড়ীতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আশ্চর্য, যেখানে এরা পেট ভরে নিজেরাই দুই বেলা খেতে পারে না সেখানে আবার অন্য মানুষদের কথা চিন্তা করে! সামির ঠিক হিসাব মেলাতে পারে না।

রাতে বাকেরের বাবা সামির কে একটি নতুন শার্ট দিলেন, যা আজই হাট থেকে কিনে এনেছেন। সামিরের চোখে পানি এসে গেল। পুরো বাড়ীতে রয়েছে একটি মাত্র চৌকি যেখানে বাকেরের দাদা ঘুমায়। আজ সেখানেই সামির কে ঘুমাতে দিল। শক্ত কাঠে সামিরের কষ্ট হবে ভেবে কসিরের মায়ের একটি শাড়ী বিছিয়ে চাদর বানিয়ে দিল। সবাই ঘুমিয়ে গেলেও সামিরের চোখে এক ফোঁটা ঘুম নেই। মাথার মধ্যে চলছে চিন্তার ঝড়।

কসির, বাকের স্কুলে পড়ে না। কিন্তু এই ছেলেগুলো এবং এদের ফ্যামিলি থেকে এই দুদিনে সামির যা শিখল, জানল তা সে একটি অভিজাত শিক্ষিত ফ্যামিলির ছেলে হয়ে, দেশের সবচেয়ে নামী স্কুলে পড়েও শিখতে পারেনি। এখানে সে থাকা-খাওয়ায় কষ্ট পাচ্ছে ঠিক, কিন্তু প্রতিটা মুহূর্তেই সামির অনুভব করছে এদের এই ভাঙা ঘরে যে পরিমাণ মমতা, ভালবাসা আর শান্তি আছে তা কোনদিনই সে খুঁজে পায়নি ওদের ওই আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাটটিতে। বাবা-মায়ের মধ্যে টাকা-পয়সা নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া লেগে থাকে। ভাইয়া-আপুর প্রতিদিনই নিত্য নতুন বায়না। পকেট মানি একটু কম হলেই শুরু হয়ে যায় চিৎকার চেঁচামেচি। বাবা বাসায় ফিরে রাত দশটার পর। মা ব্যাংক হতে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আবার জিমে চলে যায়। ভাইয়া-আপু কখনো কখনো বাসায় থাকলেও তাদের রুমে গিয়ে ডিস্টার্ব করা একদম মানা। এতবড় বাড়ীতে, এত বিত্ত-বৈভব আর আরামের মাঝে থেকেও সামিরের খুব একা লাগে, মনে হয় পৃথিবীতে ওর কেউ নেই। মাঝে মাঝে দরজা লাগিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে কাঁদে যাতে কেউ বুঝতে না পারে। আসলে কারা ভাল আছে ওরা না আমরা?

পরদিন সকালে অনেক হইচই এর আওয়াজ শুনে সামিরের ঘুম ভেঙ্গে গেল। সামিরের বাবা আর চাচা খোঁজ পেয়ে সামির কে নিয়ে যেতে এসেছে। সামির কে দেখে বাবা কেঁদে ফেলল। ঘাটে ভাড়া করা নৌকা অপেক্ষা করছে, বেশি দেরী করা যাবে না। সামিরের বাবা বারবার কসির-বাকেরের বাবা চাচাদের হাত ধরে ছেলের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে।

সামিরের চাচা কিছু টাকা বের করলেন জেলেদের দেওয়ার জন্য। বাকেরের বাবা হাত জোড় করে টাকা ফেরত দিয়ে বললেন, ‘ভাইজান টাকা লাগব না। কসির বাকের যেমুন আমাগো পোলা, আপনের ছেলেও আমাগো পোলা।’ তারপর চোখ মুছে বললেন, ‘ছাওয়ালডারে ভাল কইরা খাইতে, থাকতে দিতে পারি নাই; ব্যাচারার ওনেক কষ্ট হইছে।’

জেলে পরিবারটি সামির কে বিদায় দিতে নদীর ঘাটে এল। সবার চোখ ছলছল করছে। কসির আর বাকের সামিরের দুই হাত ধরে বলল, ‘ভাই, সময় কইরা আর একবার বেড়াইতে আইস। আমাগোরে ভুইলা যাইও না।’ সামির অনেক চেষ্টা করেও কোন কথা বলতে পারল না। নৌকায় ওঠার আগে কসিরের বৃদ্ধ দাদী জোর করে সামিরের হাতে কাগজে মোড়ানো তিনটা পাঁকা পেঁপে আর একটা চিংড়ি শুঁটকির প্যাকেট গুঁজে দিল। তারপর শাড়ীর আঁচলে চোখ মুছে বলল, ‘পোলাডা শুকটির ভত্তা খুব মজা কইরা খাইছিল। মারে বইল এগুলা দিয়া ভত্তা বানাইয়া দিতে।’

নৌকা ছেড়ে দিল। সামির হাত নেড়ে সবাইকে বিদায় জানাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই গ্রাম্য হতদরিদ্র মানুষগুলোর চেহারা অদৄশ্য হয়ে গেল। হঠাৎ দুই হাতে মুখ চেপে হু হু করে সামির জোরে কেঁদে উঠল। মনে হচ্ছে এই কাছের মানুষগুলোকে সে যেন চিরতরে হারিয়ে ফেলছে। বাবা সামিরের মাথায় হাত রাখলেন।

কান্নার বেগ কমে আসতেই সামির ভাবল কসির আর বাকেরের কথা। জীবনে হয়ত ওদের সাথে আর কখনও দেখা হবে না কিন্তু বড় হয়ে, পড়াশোনা শেষ করে এই দরিদ্র জেলেদের ছেলেমেয়েদের জন্য সামির একটি স্কুল দিবে। স্কুলটি শুরু হবে সন্ধ্যার পর, যাতে দিনে কাজ করে রাতে সবাই পড়াশোনা করতে পারে। বিনা বেতনে পড়াশোনা করার পাশাপাশি সব ছাত্র-ছাত্রী কে প্রতি মাসে তাদের গরীব বাবা-মায়ের জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেওয়া হবে। তাহলে আর কাজ করার জন্য কোন ছেলে-মেয়েকেই স্কুল বাদ দিতে হবে না। জেলে পল্লীর একটি সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে দেখতে সামির এগিয়ে যায় গন্তব্যের দিকে।

বোধ
সালমা জাবীন