জিলহজ্জ মাস ও আমাদের করণীয়

বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম

আর-রাহমানুর রাহীম আমাদেরকে বছরে এমন কিছু সময় দিয়েছেন যেন আমরা আমাদের আমলের পাল্লা ভারী করতে পারি।

অনেক সময় শিক্ষক যেমন আমাদের বোনাস পরীক্ষা নিয়ে থাকেন যা ভালো ও ফাকিঁবাজ সব ছাত্রছাত্রীদের জন্য উপকারী হয়; তেমনি এই সময়গুলো আমাদের জন্য বোনাস যা আমাদের আমলের পাল্লা ভারী করতে পারে যদি তা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারি।

রমাদান এমনই একটা সময় যা আমরা সবাই কম বেশী জানি। রমাদান ছাড়াও আরেক বরকতময় সময় হলো জ্বিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন।

আল্লাহ তা‌’আলা বলেন : কসম ভোরবেলার। কসম দশ রাতের। (সূরা ফাজর : ১-২)

ইবনে কাসীর রাহিমাহুল্লাহর মতে এর মাধ্যমে জিলহজ মাসের দশ দিনকে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ্‌ কসম করেছেন এই দিনগুলো নিয়ে তাহলে এর গুরুত্ব কতটুকু তা চিন্তা করলেই বুঝা যায়। এই দিনগুলো হলো বছরের শ্রেষ্ঠ দিন। ঠিক যেমন শ্রেষ্ঠ রাত হলো রমাদানের শেষ দশ রাত। এই দিনসমূহের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বিভিন্ন হাদীসে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

“এ দিনগুলোর তুলনায় কোনো আমল-ই অন্য কোন সময় উত্তম নয় । তারা বলল: জিহাদও না ? তিনি বললেন: জিহাদও না, তবে যে ব্যক্তি নিজের জানের শঙ্কা ও সম্পদ নিয়ে বের হয়েছে, অতঃপর কিছু নিয়েই ফিরে আসেনি।” (বুখারী)

ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন : জিলহজ মাসের দশ দিনের ফযীলতের তাৎপর্যের ক্ষেত্রে যা স্পষ্ট, তা হচ্ছে এখানে মূল ইবাদাতগুলোর সমন্বয় ঘটেছে। অর্থাৎ সালাত, সিয়াম, সাদকা ও হজ্জ, যা অন্যান্য সময় আদায় করা হয় না। (ফাতহুল বারী)

এই দশ দিনে সবচেয়ে বড় ইবাদত হলো হজ্জ। কিন্তু আমরা যারা হজ্জ করতে পারছিনা তাদেরও অনেক কিছু করার আছে। আমরা ইচ্ছা করলেই এই দিনগুলোকে কাজে লাগিয়ে আমাদের আমলনামায় কিছু ভালো কাজ যোগ করতে পারি।

১) নিয়্যতের বিশুদ্ধকরণঃ

নিয়্যত অনেক বড় ভূমিকা রাখে আমাদের সব ভালো কাজের ক্ষেত্রেই। এই নিয়্যতের জন্য অনেক সময় ছোট কাজও আল্লাহ্‌র কাছে অনেক বড় হয়ে যায়; ঠিক তেমনি অনেক বড় ভালো কাজও এই নিয়্যতের জন্য ছোট বা অকার্যকর হয়ে যায়। যেমন শুধুমাত্র নিয়্যতের মাধ্যমেই আমরা আমাদের প্রতিদিনের কাজগুলোকে ইবাদতে পরিণত করতে পারি।

২) নামাজঃ

এই দশদিনে আমরা চেষ্টা করতে পারি যেন ফরয নামাজগুলো সুন্দরভাবে মনোযোগ দিয়ে সময়মতো পড়া হয়। ফরযের পাশাপাশি আমরা কিছু নফল নামাজ পড়তে পারি। সাহাবী সাওবান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “তুমি বেশী বেশী সিজদা (সালাত আদায়) করবে, কেননা তোমার একটি সিজদা তোমাকে এক নতুন মর্যাদায় উন্নীত করবে, আর তোমার একটি গুনাহ থেকে তোমাকে মুক্তি দিবে”। [মুসলিমঃ ৪৮৮]।

৩) রোজাঃ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে জিলহজ্জের নয় তারিখে হাজীরা ছাড়া বাকীদের জন্য রোজা অনেক বরকতময়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি এই দিনের সাওম রাখা সম্পর্কে বলেছেনঃ “আরাফার দিনের সাওম আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিগত ও আগত বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন”। [মুসলিমঃ ১১৬২, আবু দাঊদঃ ২৪২৫, তিরমিযীঃ ৭৫৯]

এছাড়াও আমরা এই দিনগুলোতে নফল রোজা রাখতে পারি। আর আমরা সবাই জানি যে রোজা রাখার পুরষ্কার আল্লাহ্‌ নিজে দিবেন আর কি সেই পুরষ্কার তা কেউ জানেনা সুবহানাল্লাহ।

৪) যিকির করাঃ

এই দিনগুলোয় তাকবীর (আল্লাহু আকবার), তাহমীদ (আলহামদু লিল্লাহ), তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ) পড়া সুন্নত। এই যিকিরগুলো আমাদের বেশী বেশী করা উচিত। শুধু যে নামাজের পর করবো তা নয় আমরা সাহাবীদের মতো বাসায়, অফিসে, মাঠে সবখানেই পড়তে পারি।

★এছাড়াও ৯ই জিলহজ্জ এর ফজর থেকে ১৩ই জিলহজ্জের আসর পর্যন্ত নিম্নোক্ত তাকবীর পড়া সুন্নাহ; যা আবার কোন কোন স্কলারের মতে ওয়াজিব।

তাকবীরের শব্দগুলো নিম্নরূপ:

(আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।)

উল্লেখ্য, বর্তমানে তাকবীর হয়ে পড়েছে একটি পরিত্যাক্ত ও বিলুপ্তপ্রায় সুন্নত। আমাদের সকলের কর্তব্য এ সুন্নতের পুনর্জীবনের লক্ষ্যে এ সংক্রান্ত ব্যাপক প্রচারণা চালানো।

হাদীসে উল্লিখিত হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নতসমূহ থেকে একটি সুন্নত পুনর্জীবিত করল, যা আমার পর বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে, তাকে সে পরিমাণ সওয়াব দেওয়া হবে, যে পরিমাণ তার ওপর (সে সুন্নতের ওপর) আমল করা হয়েছে। এতে (আমলকারীদের) সওয়াব হতে বিন্দুমাত্র কমানো হবে না।’ [তিরমিযী : ৬৭৭]

৫) কুরবানী করাঃ

আমরা আমাদের সামর্থ্যানুযায়ী কুরবানী দিবো কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যেন আমাদের নিয়্যত ঠিক থাকে। কুরবানীর পশু নিয়ে প্রতিযোগিতা করা, দাম নিয়ে ফেসবুকে শো অফ, এসব যেন আমরা না করি। কারণ আল্লাহ্‌ কুরআনেই বলে দিয়েছেন এইসব রক্ত মাংস আল্লাহ্‌র কাছে পৌঁছায় না।

“তাদের গোশতও আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, তাদের রক্তও না৷ কিন্তু তাঁর কাছে পৌঁছে যায় তোমাদের তাকওয়া৷ তিনি তাদেরকে তোমাদের জন্য এমনভাবে অনুগত করে দিয়েছেন যাতে তাঁর দেয়া পথনির্দেশনার ভিত্তিতে তোমরা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো৷ আর হে নবী! সৎকর্মশীলদেরকে সুসংবাদ দিয়ে দাও৷ [সূরা হজ্জঃ ৩৭]

এছাড়াও আমরা আরও অনেক কিছু করতে পারি যা প্রচুর বরকতময়ঃ

১) তাওবা করা ২) বেশী বেশী কুরআন পড়া ৩) সাদাকাহ করা ৪) আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় করা ৫) অনেক অনেক দোয়া করা ৬) দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন সুন্নাহ পালন শুরু করা ৭) দাওয়াহর কাজ করা ৮) রিয়া, গীবত, বিদআত সহ খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকা।

সময় চলে যাচ্ছে, একটু একটু করে আর আমরা মৃত্যুর নিকটবর্তী হচ্ছি। দুনিয়ার জীবনের পিছনে ছুটে আমরা আখিরাতকে ভুলে যাই। আমাদের দুনিয়ার জীবন হলো আখিরাতের পাথেয় অর্জন করার সময়। আর এই পাথেয় অর্জনকে আল্লাহ্‌ আরও সহজ করে দিয়েছেন বছরের বিভিন্ন বরকতময় সময় দিয়ে। তাই আমরা যেন বেশী বেশী ইবাদত ও ভালো কাজের মাধ্যমে এই দিনগুলোকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহ্‌র আরও কাছাকাছি যেতে পারি এই দোয়া করি।

—————————————
জিলহজ্জ মাস ও আমাদের করণীয়

নাঈমা আলমগীর