তাওয়াক্কুল

বর্ষার মৃদু শীতল হাওয়া গায়ে লাগতেই কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করছিল। পুরনো স্মৃতিগুলো মনের মাঝে স্পষ্ট হতে লাগলো। বিষন্নতার একটা উষ্ণ ছায়া হৃদয়টাকে ঢেকে দিল।

প্রায় ৭ বছর আগের কিছু স্মৃতি মনের মধ্যে উঁকি ঝুঁকি দিতে লাগলো!

৭ বছর আগেই আমার দ্বিতীয় জীবনের সূচনা হয়েছিল। বৈবাহিক জীবন!

জীবনের সবচাইতে বেশী অভিজ্ঞতা আমি সে বছরই অর্জন করি। কিছুদিনের ব্যবধানেই বাড়ির মেয়ে থেকে বাড়ির বউ হয়ে যাই।

বলতে গেলে আমার সাধারণ জীবনকে ছেদ করে হঠাৎই একটা নতুন জীবন আমার সামনে উপস্থিত হয়। যার মোকাবেলার জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি আমার ছিল না।

তবুও, মানুষের পরিস্থিতি মেনে নেয়ার ক্ষমতা প্রশংসনীয় বটে! সবকিছু নিয়ে আবার নতুন করে শুরু করলাম আলোর পথে যাত্রা।

ভালোই চলছিল সব। পরিবারে যথেষ্ট অভাব থাকলেও তা খুব সহজেই দ্বীনের আলোয় ঢাকা পড়ে যেত। টুনাটুনির সংসারে ভালোবাসার অভাব ছিল না মোটেও! দ্বীন পালনেও আমরা একে অপরের সঙ্গী ছিলাম। রাতের কিছুটা সময় দ্বীনি পরামর্শ করে কেটে যেত। ভবিষ্যতের জন্য ছোট ছোট স্বপ্ন বুনতাম।

আমাদের মাঝে মাঝে একটি বিষয় নিয়ে মৃদু তর্ক হতো, তিনি বলতেন আমাদের প্রথম সন্তান হবে মেয়ে আমি বলতাম ছেলে। এক পর্যায়ে কথার প্যাঁচে হেরে গিয়ে তিনি বলতেন “এটা আল্লাহ্ই ভালো জানেন!”
আমি তখন খুব করে হাসতাম।

আমাদের খুব ইচ্ছে ছিল সন্তানদের দ্বীনি ইলমে শিক্ষিত করে তুলব। যাতে তারা পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত না হয় কিছু সুন্দর সুন্দর নাম ও দুজন মিলে ঠিক করে রেখেছিলাম ভবিষ্যতের জন্য।

কিন্তু স্রষ্টার পরিকল্পনা যে ছিল ভিন্ন।

আমাদের সুখের আকাশে একঝাঁক কাল মেঘ জমাট বাঁধল। বজ্রপাতের আগুনের শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে গেল আমাদের ক্ষণে ক্ষণে বোনা স্বপ্নগুলো ।

ধীরে ধীরে শরীরটা ঠান্ডা হতে শুরু করলো যখন শুনতে পেলাম আমি আর কখনোই মা হতে পারবনা!

মনের সমুদ্রে ভেসে বেড়ানো পাল তোলা নৌকাগুলো মূহুর্তেই ঝড়ো হাওয়ায় দুমরে মুচড়ে গেল। এ সংবাদ শুনে, আমি যেন কোন কিছু বলার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেই মুহূর্তে তিনি আমার পাশে বসে নির্বোধ বালকের মতো সান্তনা দিতে লাগলেন। তবে তীব্র এ বেদনার কাছে এই প্রতিষেধক যে ঠিক কতোটা তুচ্ছ তা বলে বোঝানোর অপেক্ষা রাখে না।

একটা ঘটনাই যেন যথেষ্ট ছিল আমার প্রতি সবার দৃষ্টি ভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য। শাশুড়ী থেকে শুরু করে, পাশের বাসার মহিলাটিও আমার বিষয়ে বিরুপ মন্তব্য করতে ভুলতো না।

ভীষণ মানসিক চাপে থাকতাম। মাঝে মাঝে নিজেকে পাগলের মত লাগতো। পরিবারে কারো কাছেই তেমন মূল্য পেতাম না, তার আরেকটা কারণ ছিল স্বামীর স্বল্প আয়।

যাক! মানসিক শান্তির জন্য ইবাদাত বাড়িয়ে দিলাম। ইবাদাতের মাধ্যমে সন্তানের শূন্যতা অনেকটা ভুলে থাকতে পারতাম। আলহামদুলিল্লাহ্!

একদিন রাতের খাবার শেষে মায়ের রুমে যেতেই শুনলাম তিনি তার ছেলেকে দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলছেন।

শুনে আচমকা হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতে লাগল! আমি আর কিছু শোনার অপেক্ষা করলাম না। নিজের কামরায় গিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। টপটপ করে চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছিল।

এ অব্যক্ত বেদনা যেন ভেতরে ভেতরে আমাকে শেষ করে দিচ্ছিল। রবের ও আমার মধ্যে এক বিরাট দূরত্ব অনুভব করছিলাম। চাইলেও ইবাদাতে মনোযোগী হতে পারছিলাম না।

মাঝে মাঝে মনে হতো; ইসস! আমি যদি আমার রবের কাছে চলে যেতে পারতাম! তাহলে হয়তো আমার জন্য তার জীবনের স্বপ্নগুলো ভেঙে পড়তো না! ছোট ছোট হাত পায়ের স্পর্শে তিনি নতুন করে স্বপ্ন দেখতেন। বাবা!বাবা! শব্দে তাদের ঘর মুখরিত হয়ে উঠত।

ভাবনার এক পর্যায়ে নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছিলো। নাহহ! এইভাবে আর চলতে পারে না আমি নতুন করে সব শুরু করবো। আমার ভয় গুলোকে কাটিয়ে তোলে ইবাদাতে মগ্ন হবো। এই দুনিয়ার জীবনে আমরা মুসাফির বই আর তো কিছুই নই।

রাতে তিনি বাসায় আসতেই আমি বললাম “আপনি চাইলে দ্বিতীয় বিয়ে করে নিতে পারেন আমার আপত্তি নেই। আমি আমার জন্য আপনার স্বপ্নগুলো ভেঙে ফেলতে চাই না “

তিনি আমার দিকে একবার তাকিয়ে নিজের কাজে মন দিলেন। বুঝলাম! কথাটার তেমন মূল্য দিলেন না।

রাতে তিনি রুমে এসে বলতে লাগলেন, “মুনতাহা! তোমার মনের অবস্থাটা আমি বুঝতে পারছি।

সারাদিনের ব্যস্ততায় তোমাকে সময় দিতে পারিনা তাই হয়তো তুমি ভাবছ আমি তোমাকে ভুলে যাচ্ছি আর নিঃসন্দেহে তুমি এর কারণ হিসেবে ধরে নিয়েছ তোমার সন্তান জন্মদানের অক্ষমতা।

মুনতাহা! ধৈর্য ধারণ করাই মুমিন ব্যক্তির কাজ। সন্তান আল্লাহ্‌র দেওয়া একটি নিয়ামত। আল্লাহ্ হয়তো আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন। ইব্রাহিম (আ:) কে আল্লাহ্‌ তখন সন্তান দান করেছেন যখন তিনি সন্তানের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। তাহলে আমরা হতাশ হচ্ছি কেন? আমাদের ইবাদাতে আরো মনোযোগী হওয়ার দরকার। বুঝতে পারলেন?

ঘোর কাটতেই আমি বুঝতে পারলাম তিনি সত্যিই কি চাইছেন।

তারপর থেকেই আমাদের জীবনের মোড় ঘুরে যেতে শুরু করলো । কারও কটু কথাই আর গায়ে লাগতো না। ইবাদাতের মধ্যে দিয়ে হেসে খেলে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা দিন দিন মজবুত হিয়ে যাচ্ছিল।

এর মধ্যেই হঠাৎ করে তার ব্যবসায় প্রচুর লাভ হতে লাগলো। এক কথায় অভাবনীয় স্থান থেকে টাকা আসছিলো। লোকে বলে না, টাকা থাকলে দুধের মাছির অভাব হয় না? আমাদের ক্ষেত্রে ও হলো তা! পরিবার থেকে ধরে প্রতিবেশীদের সবারই চোখের মনি তখন আমরা।

আমাদের দুজনেরই পার্থিব চাওয়া পাওয়াগুলো সীমিত ছিল তাই দুজন মিলে ঠিক করলাম যে এইবার নবীর দেশ থেকে ঘুরে আসব।

অনেকদিনের ইচ্ছা সেই পথ দিয়ে হাঁটবো যেদিকে আমার নবী হেঁটে গিয়েছেন।

অবশেষে ইচ্ছার পরিসমাপ্তি ঘটলো।

মক্কার মাটিতে পা রাখতেই হৃদয়ে শিহরিত হয়ে উঠল।

আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়টা আমি তখন অতিবাহিত করি। সর্বদা মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি কাজ করতো। মনে হতো জীবনের সমাপ্তিটা যদি এখানেই হয়ে যেত তাহলে আমিও হয়তো সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারলাম। আমাকেও হয়েতো জান্নাতুল বাকিতে শায়িত করা হতো।

হজ্জের মধ্যে দিতে আমার মানসিক অনেক পরিবর্তন হয়। ইবাদাতে আগের চাইতে অধিক মনোযোগী হতে পারি। আলহামদুলিল্লাহ্! আত্মশুদ্ধির ক্ষেত্রেও হজ্জ পালন আমার জীবনে বিরাট ভূমিকা রাখে।

দুনিয়ার আর কিছুই চাওয়ার ছিলনা আমার কিন্তু তবুও দোয়া কবুলের বিশেষ স্থানগুলোতে সন্তান লাভের দোয়া করতাম।

“মা” ডাক শুনার প্রয়াস কি এতো অল্পে মেটে?আলহামদুলিল্লাহ্! আল্লাহ্‌র অশেষ রহমতে সুষ্ঠু ভাবে হজ্জ সম্পন্ন করলাম।

নিজ গন্তব্যে ফিরে এসে আবার নতুন করে প্রাত্যহিক জীবন শুরু করলাম। নতুন জীবনে আল্লাহ্‌র রহমতে ছিল অসীম।

হঠাৎ টের পেলাম, দিনে দিনে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ছি। শারীরিক ভাবে অনেক দূর্বল অনুভূত হচ্ছিল।
তিনি মোটামুটি জোর করেই আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন।

ডাক্তার অনেকগুলো চেক আপ করাতে বলল।
প্রথমত বিষয়টাকে জ্বর বলে উড়িয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু পরে কিছুটা ভয় হতে লাগলো। অন্তিম সময় অতি নিকটে নয়তো?

দুদিন পর আবার ডাক্তারের কাছে গেলাম তিনিও পাশে ছিলেন। ডাক্তারের চোখ মুখের চাহনি দেখে কি হতে চলেছে আঁচ করতে পারছিলাম না ।

ডাক্তার আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন “আপনাদের কি কোন সন্তান আছে?”

তিনি অপ্রস্তুত ভাবে একবার আমার দিকে তাকিয়ে ” না ডাক্তার……… ” তিনি আরো কিছু বলার আগেই ডাক্তার বলতে লাগলেন “আপনাদের জন্য তাহলে সুখবর আছে!”

আমার হৃদয়টা যেন আর সইতে পারছিল না। আমি জোর গলায় বললাম “কি সুখবর ডাক্তার?” ডাক্তার একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলতে লাগলেন “আপনি মা হতে চলেছেন।

আমি রাতের আকাশে সূর্য দেখার মতো অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। তিনিও অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।

তিনি ডাক্তারকে আমার বন্ধ্যাত্বের বিষয়টা জানালেন। তারপর আলোচনা শেষে তিনি নিশ্চিত হয়ে আল্লাহ্‌র কাছে শুকরিয়া আদায় করতে লাগলেন।

সেদিন ঘরে ফেরার পথ যেন আর ফুরোচ্ছিল না, বার বার মনে হচ্ছিল, কখন ঘরে ফিরব? কখন রবের নিকট 
সেজদায় লুটিয়ে পড়বো?

কখম চোখের পানি ছেড়ে রবের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো? কখন!! এ পথ যে অতি দীর্ঘ!!

মাআআআ মাআআ অস্পষ্ট শব্দে আমার স্মৃতিচারণে ব্যাঘাত ঘটল।

ইসস! কতোটা সময় ধরে বসে আছি মেয়েটা যে সকাল থেকে এখনও কিছু খেল না।

তাওয়াক্কুল
আরফাত তাযকিয়াহ্

অগাস্ট ০২, ২০১৯ইং