প্রয়োজন নাকি লৌকিকতা!

আমাদের অনেকেরই শপিং প্রীতি অতি বেশি। হজ্জে যেন এই রোগ আপনার মূল্যবান সময় অপচয়ের কারন না হয় সেজন্য আগে থেকেই সতর্ক থাকতে হবে। আমরা যে কাজে গিয়েছি তা থেকে আমাদেরকে ভুলিয়ে সময় নষ্ট করার প্রচুর উপকরণ আপনার চারপাশে ঘোরাফেরা করবে। সাবধান হোন আগেই!

আমার আব্বা আম্মা যেবার হজ্জ করে আসলেন, তাদের দেখেছিলাম, বিশাল একটা লাগেজ শুধু জায়নামাজ! পাড়াপড়শি, আত্মীয়, বন্ধুবাবন্ধ সবার জন্য অন্তত একটা জায়নামাজ চাই ই চাই। এমন অবস্থা, এত আনার পরেও সেগুলো শেষ। মান বাঁচাতে লোকাল বাজার থেকে কিনে দিতে হয়েছে জায়নামাজ এবং বোরখা!

সেবার এই জিনিস দেখার পর থেকে আমার মাথায় ব্যাপারটা ঘুরছিল, হজ্জে লোকে কেন যায়? অবশ্যই শপিং করতে নয়। তাহলে হাজিদের কাছে মানুষজনের কেন প্রত্যাশা থাকে, হজ্জ থেকে তাদের জন্য কিছুনা কিছু আনা হবে! যারা যান, তারাও যেন জিম্মি, একজনকে দিলে অন্যে মন খারাপ করবে। কমবেশি দিতে তো হবেই!

একই কথা শুনলাম আমার শাশুড়ির কাছে। প্রথমবার তিনি যখন হজ্জে যান, আত্মীয়, পাড়াপড়শি মিলে প্রচুর জায়নামাজ কিনেছিলেন ; এরপরেও তাদের দেশে ফিরে কম পড়ায়, এখান থেকে কিনে দিতে হয়েছে। সুবহানাল্লাহ! এটা কি শপিং কম্পিটিশন, কাকে কত দেয়া যায়, দিতেই হিবে, না দিতে পারলে সম্মানহানি হবে।

একজন মানুষ, অনেক কষ্টের টাকা জমিয়ে হজ্জে যান, সেখানে তাকে অগণিত জায়নামাজ কিনতে হয় বিলানোর জন্য! আমার কাছে, এটা অত্যাচার লাগে, মানসিক অত্যাচার! আমি তাওয়াফ করার সময় এক দম্পতিকে আলাপ করতে শুনছি, এখনি বের হয়ে, আর কারকার জন্য কতগুলো কেনা লাগবে সেটা হিসাব করে শপিং এ যাবেন। আরো কি কি যেন কেনাকাটার হিসাব, সেটাও অন্যদের জন্য। যেখানে তাওয়াফ কয়টা করলাম সেটার হিসাব করার কথা, সামাজিকতা আমাদের বেঁধে দিচ্ছে লোক গুনে জায়নামাজ কেনার হিসেবে। এই চক্র থেকে বের হবার চেষ্টা করা উচিৎ।

হজ্জে লৌকিকতা যতটা বর্জন করা যায় ততই উওম। আমরা যেদিন ফিরে আসছি, এয়ারপোর্ট এ বসে আছি, কাফেলার এক মধ্যবয়সী নারী পাশে বসেছিলেন। বলছিলেন, লাগেজ বাঁধতে খুব কষ্ট হয়েছে। ৭০ টা শুধু জায়নামাজ কিনেছেন, সেটা বিরাট এক বস্তা। আরো কিসব আছে। আরো কিনেছেন গহনা, নিজের আর মেয়ের জন্য।

একদল লোক আছেন, যারা গহনা কিনতে যান, ছেলেমেয়ের বিয়ের জন্য। এত টাকাপয়সা নিয়ে হজ্জে যাওয়া আমার কাছে শান্তি নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই মনেহয়না। টাকা /গয়না রুমে রেখে /সাথে নিয়ে ঘুরে না আপনি শান্তিতে সালাহ আদায় করতে পারবেন, না পারবেন হজ্জ করতে। এই শপিং হজ্জের আসল উদ্দেশ্য থেকে আমাদের যেন দূরে সরিয়ে না নেয়।

আমরা যখন হজ্জে যাই, আমরা ভেবেই গিয়েছিলাম, এই বাধ্যতামূলক শপিং নিজের উপর চাপাবো না। না এত অর্থ নিয়ে যাচ্ছি, না সময়, না ইচ্ছা। কেনাকাটা যা করবো নিজেদের পরিবারের জন্য, এর বাইরে না। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যতদিন হজ্জ শেষ না হয়, দোকানেই ঢুকবোনা প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা না লাগলে।

যখন হজ্জ শেষ হল, আমাদের হাতে অনেক সময় ছিল, মদিনা যাবার কিছুদিন আগে শপিং শুরু করলাম। যেহেতু মদিনায় কম সময় থাকবো, তাই মক্কা থেকে যতটা সম্ভব কিনে নিতে হবে। কেনাকাটার বড় অংশ অবশ্যই বোরকা এবং জুব্বা। এগুলো কিনতে পারেন, মক্কা টাওয়ার থেকে। হজ্জে পর থেকে এসব শপিং মলগুলোতে ডিসকাউন্ট দেয়া শুরু হয়। আপনি যত দেরি করে যাবেন, তত বেশি ডিসকাউন্ট! হজ্জের পরে যেহেতু হাজিরা চলে যেতে থাকেন, তাই দোকান গুলো স্টক ক্লিয়ার করার জন্য এসব অফার দিয়ে থাকেন। তাই শপিং আগে না করলে আপনারই ফায়দা। মক্কা টাওয়ারে সুবিধা হল, এখানে সালাহর ওয়াক্ত হয়ে গেলে এখানেই সালাহ আদায় করে নিতে পারবেন।

মক্কা টাওয়ারে “বিন দাউদ ” নামে একটা সুপার স্টোর আছে, যাতে আপনি প্রয়োজনীয় সবকিছু পাবেন। খাবার দাবার সহ সব। উটের দুধ খুজছিলাম হোটেলের আশেপাশে কয়েক জায়গায় ; পাইনি। বিন দাউদে সেটাও পেলাম।

মক্কায় যেসব জিনিস খাবেন, সেটা হল শশা, ফলমূল, জুস। এগুলো যেমন টাটকা আর সুস্বাদু। কেনাকাটার সময় একটা জিনিস মাথায় রাখবেন, হারাম থেকে যতদূর যাবেন, জিনিষের দাম তত কম, তবে কোয়ালিটি খারাপ না। আমরা ছিলাম মিসফালাহ য়, পায়রা চত্বর শেষ হতেও একটু ভিতরে মার্কেট আছে। সেখানে সব পাওয়া যায়, জায়নামাজ, বোরকা, জুব্বা, টুপি, তসবিহ সব। শেষমাথায় আছে কিছু বাঙালী, পাকিস্তানি খাবারের দোকান, গ্রসারি শপ। এসব খাবারের দোকানে দাম বেশ কম, অথচ প্রায় একই জিনিস হারামের কাছে ৫ গুণ বেশি দাম!

তবে একটা জিনিস কখনোই মক্কা থেকে কিনবেন না, সেটা হল খেজুর। মক্কায় খেজুরের দাম অনেক বেশি, কোয়ালিটি খারাপ। যেহেতু মদিনা থেকেই বেশিরভাগ খেজুর আসে, তাই মদিনা থেকে কিনবেন। মদিনায় খেজুরের আলাদা একটা মার্কেট আছে। এখানে অনেক ভ্যারাইটিস পাবেন, দাম কম, খেজুরও ভালো। কাঁচা খেজুর পেতে পারেন, টেস্ট করতে ভুলবেন না। এই জিনিস দেশে পাওয়া যায়না। আর দেশে নিয়ে আসতে চাইলে, ফেরার দিন এয়ারপোর্ট থেকে কিনতে পারেন।

মক্কায় দেখবেন সালাহ আদায়ের পরপর রাস্তায় প্রচুর লোক পাটি বিছিয়ে বোরকা, জুব্বা বিক্রি করে। দাম কম, তবে ওখান থেকে নিবেন না। এসব জিনিশে কোয়ালিটি খারাপ, সাইজ থাকেনা। আপনি যদি রুমে গিয়ে দেখেন সাইজমত হচ্ছেনা, কখনো আর সেই ফেরিওয়ালাকে খুজে পাবেন না, চেঞ্জ করার সুযোগ নেই।

আরো জিনিষ মদিনা থেকে নিয়েছিলাম, যেমনঃ আতর, মিসওয়াক, বাচ্চাদের খেলনা, কাপড়। মদিনায় তায়েবা মার্কেটে মোটামুটি সব রকমের জিনিস পাওয়া যায়। “টপ টেন ” বলে একটা বড় দোকান আছে মদিনায় বাচ্চাদের কাপড় আর জুতা খুব ভালো পাওয়া যায়, দাম ১০ রিয়াল। এটা মসজিদে নববি থেকে ওহুদ পাহাড়ের দিকে যেতে গেলে রাস্তায় পরে।

মক্কা এবং মদিনা দুই জায়গাতেই শপিং করতে গেলে দেখবেন, বিক্রেতাদের বেশিরভাগ বাঙালী, তাই আপনার তেমন অসুবিধা হবেনা।

তবে, সাবধান থাকবেন, শপিং যেন আমাদেরকে আসল কাজ থেকে সরিয়ে না দেয়। হজ্জে আমরা নিজেদের মূল্যবান সময়কে যেন শপিংমলে অন্যের জন্য গুনেগুনে জিনিস কিনে নষ্ট না করি।

আর যারা হাজীদের আত্নীয়, প্রতিবেশী আছেন, হাজীদের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসি। এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। উভয়কেই এ ব্যাপারে উদারতা দেখাতে হবে। হাজীরা অনেক ব্যস্ত সময় কাটান, তারা সেখানে বেড়াতে বা শপিংয়ের উদ্দেশ্যে যাননা। তাদের কাছে আমরা যেন দুয়া ছাড়া অন্য কিছু প্রত্যাশা না করি।

তাহলে তারাও নিশ্চিন্ত মনে তাদের কাজ সম্পাদন করতে পারেন, অতিরিক্ত খরচের ভাবনা থেকে বেঁচে যান। অনেকেই অমুক অমুকের জন্য লিস্ট করতে গিয়ে খরচের বোঝার নিচে পড়েন, অথচ অনেকেই বহুদিন ধরে একটু একটু করে জমিয়ে হজ্জের টাকা জোগাড় করেন। সেখানে তাকে যদি আবার এতগুলো শপিংয়ের লিস্ট মাথায় চাপানো হয়, সেটা অন্যায়।

কিন্তু এমন তো হবার কথা নয়। হাজিরা আল্লাহর মেহমান, আমাদের কাছেও তারা অনেক সম্মানিত। আমাদেরকে এটা মাথায় ঢুকিয়ে নিতে হবে, হজ্জে তারা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে যান, এখানে লৌকিকতার জায়গা নেই। চলুন, আমরা সামাজিকভাবে হাজিদের থেকে এই মানসিক এবং আর্থিক চাপ থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করি।

আর হাজিরাও মাথায় রাখবেন, আমরা সারাজীবন শপিং করার সুযোগ পাবো, কিন্তু কাবাঘর সব জায়গায় পাবো না। তাওয়াফের সুযোগ মদিনা চলে আসলেই শেষ। প্রতি ওয়াক্ত সালাতে এতগুন নেকির সুযোগ শেষ। তাই এই সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়, কোনভাবেই না।

প্রয়োজন নাকি লৌকিকতা! 
ফাহমিদা হুসনে জাহান

অগাস্ট ০৬, ২০১৯ইং