বাচ্চা নিয়ে হজ্জে যাবেন?

যদি আমাকে কেউ জিজ্ঞাসা করেন, বাচ্চা নিয়ে হজ্জে যাওয়া ঠিক কিনা? আমি বলবো, বাচ্চা না নিয়ে যদি যেতে পারেন সেটা সবচেয়ে ভালো। আপনার যদি বাচ্চা রাখার রিলায়েবল লোক থাকে, দাদী নানী বা খালা ফুপু; বাচ্চা যদি তাদের কাছে থেকে অভ্যস্ত করাতে পারেন, তাহলে রেখে যাওয়াই উত্তম।

কিছু কারন বলছি-

এয়ারপোর্ট এ অনেকসময় বিভিন্ন কারনে অপেক্ষা করতে হয়, প্লেন লেট হয় প্রায়ই, এয়ারপোর্ট এ পৌঁছানোর পর থেকে সব মিলিয়ে প্রায় ১৮ ঘন্টা লেগেছে মক্কায় হোটেলে পৌঁছাতে।

এরপর ওমরাহ্‌ (তাওয়াফ + সাঈ) করতে হবে। হজ্জের আগে আগে এই সময় তাওয়াফে খুব ভিড় থাকে। প্রায়ই ধাক্কাধাক্কি হয়। পুরো ওমরাহ করতে সময় লাগে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা, আপনাকে হাঁটতে হবে অন্তত ৭ থেকে ৮ কি.মি.। এত লম্বা সফরের পর অনেকের জন্যই এটা কষ্টকর, আর সাথে বাচ্চা থাকলে তো কথাই নেই।

তবে হুইলচেয়ায়ের ব্যাবস্থা আছে, চাইলে উপরের ফ্লোর দিয়ে তাওয়াফ করতে পারেন, তাতে সময় বেশি লাগবে, তবে ভীড় একটু কম। উপর দিয়ে তাওয়াফ করতে অন্তত ৫ কি. মি হাটতে হবে, সাথে সাঈ (সাফা, মারওয়া তে ৭ বার ঘোরা)।

মক্কার তাপমাত্রা আমাদের দেশের চেয়ে অনেক বেশি, প্রায়ই ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস থাকতো, রাতে একটু কম। দুপুরে যখন নামাজে যাবেন, সানগ্লাস ছাড়া চলা মুশকিল। আসরেও তাই, মনে হত মাটি থেকেও তাপ উঠছে। তাও যদি মসজিদে জায়গা পান ভালো কথা, আযানের অনেক আগে গিয়ে বসে না থাকলে মসজিদের ভিতরে জায়গা পাবেন না, বাইরে বসতে হবে। তবে, মদীনায় এই অসুবিধা নেই, গেট বন্ধ করা হয়না, আর উপরে ছাতার ব্যাবস্থা আছে।

বাচ্চা নিয়ে বাথরুম এবং খাওয়া দাওয়াতেও অসুবিধা হয়। বাথরুমে ভীড় লেগে থাকে, অপরিষ্কার থাকে। এক এক কাফেলার খাওয়া দাওয়া একেক রকম। বুফে খাবার হলে বাচ্চাদের খাওয়ানো সুবিধা হয়।

আশেপাশে যে খাবার দোকান আছে, সেগুলোতে নামাজের পরপর অসম্ভব ভীড়, খাবারের দাম বেশি, কিন্তু বাচ্চাদের খাবারের অনুপযোগী। তবে ফল এবং জুস খুব ভালো পাওয়া যায়। গরুর দুধ পাওয়া যায়, তবে অনেকের এই দুধ হজমে সমস্যা হয়।

সবচেয়ে কষ্ট হয় হজ্জের সময়, ৮ জিলহজ্জ ফজরের পর মিনায় যাওয়া উচিৎ, যেখানে অধিকাংশ কাফেলা ৭ তারিখ রাতে নিয়ে যান। সেদিন রাতে ঘুম হয়না, বাস কখন আসবে সেটা ভালোভাবে কেউ বলতে পারেনা। এগুলো সৌদি মুয়াল্লিমদের আন্ডারে, বাঙালী মুয়াল্লিমদের তেমন কিছু করার থাকেনা। বাসের জন্য কয়েক ঘন্টাও অপেক্ষা করতে হয়।

মিনায় সাধারণ তাবুগুলোতে ধারণক্ষমতার বেশি লোক রাখা হয়, যেটা বাচ্চাদের উপযোগী না। বাথরুম সংখ্যা কম এবং নোংরা। একইভাবে আরাফার ময়দানে নেয়া হয় ৮ তারিখ রাতে, সেদিন রাতেও ঘুম হয়না, আরাফার ময়দানে অসম্ভব গরম।

৯ তারিখ রাতে মুজদালিফায় খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হয়। যারা আগেভাগে পৌঁছে ভালো জায়গা পান তাদের অসুবিধা হয় না। তবে খাবারদাবারের কোন ব্যাবস্থা নেই। রাস্তায় খাবার বিলানো হয়, কেউ পায় কেউ পায়না।

১০ তারিখ, ফজর পড়েই জামারায় পাথর মারতে যেতে হয়, দূরত্ব মুজদালিফা থেকে প্রায় ৭ কি.মি। অধিকাংশ হাজি হেঁটে যান, বাসে যাওয়া যায়, ভাড়া অনেক বেশি। এখানেও হুইলচেয়ার পাবেন, যাদের সাথে বাচ্চা এবং অসুস্থ কেউ আছে তারা হুইলচেয়ার নেন, এখানেও ভাড়া চড়া।

পাথর মারা শেষ করে মক্কায় যেতে ৬/৭ কি. মি হাঁটতে হবে, বাস পাবেন, বাসে অনেক ভীড়, এবং বাসস্টপ পর্যন্ত যেতে হাঁটতে হবে অন্তত ২ কি.মি। এরপর সেদিনই তাওয়াফ, সাঈ করে নেয়াই উত্তম। সেইদিনই মিনায় চলে যেতে হবে রাতে। ১১, ১২,১৩ (চাইলে ১২ তারিখ পর্যন্ত) তারিখ শুধু জামারায় পাথর মারা শেষ হলে হজ্জের কাজ শেষ।

হজ্জের পর যতদিন থাকা যায় নফল ইবাদাত, তাওয়াফ করা হয়। অনেক ভীড় থাকে, মন চাইলেই মাতাফে (তাওয়াফের স্থান) যাওয়া যায়না, বেশি ভীড়ে মাতাফে নামার রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয় প্রায়ই।

আমরা শেষ দিকে অনেকদিন দুপুরবেলা লোক কম থাকতো বলে, না খেয়ে থেকে যেতাম তাওয়াফ করার জন্য, কখনো কয়েক ওয়াক্ত নামাজ একসাথে পড়ে রাতে হোটেলে ফিরতাম। সময়মত খাওয়া, ঘুমানোর চিন্তা ছিলনা। রাতে ১/২ টার সময় লোক কম থাকতো, তখনো করতাম মাঝেমধ্যে। এই কাজগুলো বাচ্চা সাথে থাকলে করা সম্ভব হত না।

যদি আপনি বাচ্চা সাথে নেবেন স্থির করে ফেলেন; তাহলে চেষ্টা করবেন ভি আই পি প্যাকেজে যেতে। এতে খরচ বেশি পড়বে। কয়েকটি সুবিধা হিসেবে খরচের হিসাব কমবেশি হবে।

যারা অল্পদিনের প্যাকেজে যান, হজ্জের কয়েকদিন আগে মক্কায় যান, শেষ করে মদিনায় থেকে ফিরে আসেন। এই প্যাকেজগুলো এক্সপেন্সিভ।

প্যাকেজগুলোর খরচ নির্ভর করে মক্কা, মদীনায় হোটেলের দূরত্ব, খাওয়া দাওয়ার উপর। মিনায় আপনার তাঁবু জামারাহ থেকে কতদূরে, আরাফার তাঁবু, খাওয়া কেমন এসবেরর উপর।

এসব হিসেব করে যাবার পরও অনেক অসুবিধায় পড়তে পারেন। রাস্তায় বাস নষ্ট হয়, অনেকে কাফেলা থেকে আলাদা হয়ে যান, আরো অনেক কিছুই হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে আলাদা খরচ করতে হবে।

সব মিলিয়ে বাচ্চা সহ যেতে অনেক অনেক ধৈর্য এবং প্রিপারেশন প্রয়োজন। তবে আল্লাহ সহজ করে দেন, এ কারনেই প্রতি বছর অনেক মানুষ বাচ্চাসহ হজ্জ করছেন। আপনিও নিয়ত করুন, আল্লাহ সহজ করুন আপনার জন্য।

বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর লোক আসেন বাচ্চাকাচ্চা সহ, এমনকি এক দম্পতির সাথে ৫ বাচ্চা দেখেছিলাম, যাদের বয়স ১ থেকে ১০। পাকিস্তানিদেরও দেখেছি, ফ্যামিলিসহ হজ্জে আসেন। তারা অনেকেই হজ্জে আসেন ব্যক্তিগত ভাবে, কোন এজেন্সি ছাড়া, পুরোটা সময় মসজিদুল হারামে কাটান। প্রচুর নাইজেরিয়ান, ঘানার মহিলাদের দেখেছি যারা ছোটছোট বাচ্চা নিয়ে হজ্জে আসেন। কাজটা কঠিন, খুব সহজ না।

আমাদের দেশের লোকজন বাচ্চাসহ খুব কমই হজ্জে আসেন। কয়েকটা ব্যাপার কাজ করে এখানে। বাচ্চা নিয়ে হজ্জের সব কাজ সঠিক সময়ে করা কষ্ট। আমাদের দেশের বাচ্চারা কষ্ট সহ্য করতে পারেনা। আমরা পিতামাতারা তাদেরকে কষ্ট সহনশীল হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যার্থ হচ্ছি। যেকোন পরিবেশে মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত করতে পারছিনা।

আমাদের বাচ্চাদের আমরা এসি রুমে আরামে বসে টেলিভিশন দেখতে দেখতে তাদের পছন্দের খাবার নিয়ে টালবাহানা করতে অভ্যস্ত করে তুলছি। যে কারনে অর্থ থাকার পরেও বাচ্চা নিয়ে হজ্জে যেতে অনেকেই সাহস করতে পারেন না। কিন্তু মক্কায় গেলে বাচ্চা দেখলে অবাক হতে হয়। এরা কাবার প্রান্তরে খেলে বেড়ায়, সালাহর সময় মায়ের সাথে দাঁড়ায়, তাওয়াফে বাবা মায়ের সাথী হয়। আমি এত বাচ্চা দেখেছি সেখানে, একসময় নিজের বাচ্চাগুলোকে কেন আনিনি, সেই মনোকষ্টে ভুগেছি।

যারা বাচ্চাদের নিয়ে যাবেন কিনা দ্বিধাদ্বন্দে ভোগেন, আপনার রাখার মত কোন লোক নেই, বাচ্চা নিয়েই যাবার নিয়ত রাখুন। তবে সবসময় দুয়ার উপরে থাকবেন, আল্লাহ যেন আপনার বাচ্চাকে বুঝ দেন, সবর দেন এবং সহজ করে দেন। যথাসময়ে হজ্জে মাবরুর পালনের তাওফিক দেন।

——————————–
বাচ্চা নিয়ে হজ্জে যাবেন?
ফাহমিদা হুসনে