রব্বের মেহমান

ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি গায়ে মেখে মিমি দ্রুত গতিতে হাটছে। বৃষ্টি বাড়ার আগে চাচিকে খুঁজে পেলে হয়। ছাতাটাও তো আনা হয়নি। এমনিতেই সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। সূর্য ডুবে যাবার পর রাস্তার আলো গাড়ির শব্দ সব কেমন যেন অস্থির লাগে মিমির কাছে। পাখি যেমন সূর্যি ডুবার আগে দ্রুত নীড়ে ফিরতে চায় মিমিও অনেকটা তেমনই। কিন্তু আজ ঘটনা অঘটনায় মিমি এখনও সেন্ট্রাল প্লাজার সামনে। খুঁজছে চাচিকে।

বৃষ্টির বেগ কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু চাচি যেখানে আছে সে জায়গাটা খুঁজেই পাচ্ছেনা মিমি। মনে মনে ভাবলো কাউকে জিজ্ঞেস করবে কিনা যে তাকওয়া টুরস আন্ড টাভেলসের অফিসটা কোন দিকে। ভাবতে ভাবতেই টুংটাং করে বেজে উঠলো মিমির ফোন। হ্যাঁ! চাচিই কল দিয়েছে।

“কোথায় তুমি?”
“সেন্ট্রাল প্লাজার সামনে। এখন কোন দিকে যাবো?”
“ডান দিকে সোজা আসতে থাকো। একটু আসলেই দেখবে বড় ব্যানারে লেখা হজ্জ ও ওমরা সেমিনার। সেখানেই ঢুকবে।”

কোনো উত্তর না দিয়েই মিমি ফোন কেটে দ্রুত হাটতে শুরু করলো। একটু পরেই ব্যানার পেয়ে গেলো। ব্যানার থেকে চোখ সরিয়ে গেটের দিকে চোখ ফেলতেই দেখলো চাচি আসছে বড় একটা ধূসর বর্ণের খিমার পরে। চাচির মত এমন স্টাইলিশ মানুষকে খিমারে দেখে মিমি মনে মনে ফিক করে হেসে দিলো।

ও আচ্ছা, আগে বলে নেয়া দরকার ছিলো মিমির চাচা-চাচি এবার হজ্জে যাচ্ছে। তাই এই সেমিনারে আসা। তবে এখানে মিমির আসার কোনো কথাই ছিলো না। বলা চলে মিমির তাকদিরই এখানে মিমিকে টেনে এনেছে। খুব জরুরী দরকারে মিমির হাসব্যান্ড গিয়েছে রাজশাহী। মিমির চলছে পরীক্ষা। পরীক্ষা না চললে মিমিও হয়তো একটু বেড়িয়ে আসতো। কিন্তু না, তা আর হলো না। এখন একা কি করে থাকবে। তাই এই ক’দিন মিমিকে চাচির বাসাতেই থাকতে হচ্ছে।

চাচিকে খুব একটা পছন্দনা মিমির। এড়িয়ে চলতে না পেরে যেটুকু মিশা লাগে সেটুকুই। এই অপছন্দের কারণ মূলত চাচির অতি-আধুনিকতা। বেশ ভুষা চাল চলনই দায়ি। নিজে যেমন, চাচাতো বোনগুলকেও করেছে ঠিক তেমনি। নাহ্‌ বলা যায় দু’ এক ডিগ্রি বাশি। সে যাক।

চাচির সাথেই মিমিও সেমিনারে ঢুকলো। ঢুকেই মনটা ভীষণ ভালো হয়ে গেলো মিমির। কি সুন্দর পরিবেশ এখানে। সব হজ্জ যাত্রীদের তাদের করনীয় বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে এক এক করে। কখন কোথায় কি করা হবে। কিভাবে হজ্জ করা হবে। হজ্জের হুকুম আহকাম সব বুঝিয়ে বলা হচ্ছে খুব সুন্দর করে। শহরের বিখ্যাত কিছু আলেমও এসেছেন এখানে। এভাবে এতো কাছ থেকে ওনাদের কথা মিমি কখনই শোনেনি।

খুব আনন্দিত কন্ঠে মিমি বললো, “চাচি, তুমি এখানে এসেছো আগে বললে তো আমি শুরু থেকেই জয়েন করতাম। এমন প্রোগরামগুলো আমার খুব ভালো লাগে।”

“আমরা এসেছি যে খুব বেশি সময় হয়নি।”
“শুরু হয়েছে ক’টা থেকে?”
“আসরের পর থেকেই।”
“ইশ কত কি মিস করে ফেললাম আমি!!”

মিমির এমন আক্ষেপে চাচি হালকা একটু হাসলো। হয়তো এ হাসি সৌজন্যমূলক হাসিই হবে।

সবাই মন দিয়ে কথা শুনছে। কথা হচ্ছে হাজীদের শিডিউল নিয়ে। কবে এখান থেকে ফ্লাই করা হবে। তারপর কি করা হবে। কোথায় কোথায় নেয়া হবে। এসব। কথায় কথায় মাদীনাতুল মানাওয়ারা এর কথা বলা হচ্ছিলো। বলা হলো যে যখন মাদিনাতুল মানাওয়ারা ছেড়ে আসার সময় হবে তখন মন থেকে নাকি প্রচণ্ড কষ্ট অনুভব হবে। কোলের শিশুকে মায়ের কারো কাছে চিরতরে রেখে চলে যেতে যতটা কষ্ট ঠিক নাকি ততটা কষ্ট হয় হাজীদের মাদিনা ছেড়ে যেতে। প্রতিটা শব্দে গা কাঁটা দিয়ে যাচ্ছিলো মিলির। পাশ থেকে চাচি বলে উঠলো, “সত্যিই এতটাই কষ্ট হয়!! জানো আমি যখন গেলোবার চলে আসছিলাম তখন আমি পারছিলাম না হাউমাউ করে কাঁদি।”

ও আচ্ছা, বলে রাখা ভালো মিলির চাচা চাচি আগেও একবার হজ্জ করে এসেছেন। তবুও ওনারা সেই অতি আধুনিকই রগে গেলেন। হজের জায়গায় হজ্জ জীবনের জায়গায় জীবন এই মতবাদে বিশ্বাসী হয়তো ওনারা। হজ্জ করে ফিরে এয়ার পোর্টেই খিমার ছুড়ে ফেলেছিলেন তিনি। যাক, সেসব পুরনো কথা। যা বলছিলাম… তো উনি হঠাৎ বলে উঠলেন, “সত্যিই এতটাই কষ্ট হয়!! জানো আমি যখন গেলোবার চলে আসছিলাম তখন আমি পারছিলাম না হাউমাউ করে কাঁদি।”

এতো শব্দের মধ্যে কথাটা ঠিক মত শোনার জন্য মিমি চাচির একটু কাছাকাছি গিয়ে তাকালো চাচির দিকে। তাকিয়ে মিমি বললো, “তোমার চোখ তো এখনও ভিজে উঠেছে।”

চাচি নিজের চোখ মুছে আবার কথা শোনায় মন দিলো।

কিন্তু হঠাৎ চাচির দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড ইর্ষা হতে লাগলো মিমির। এই মানুষটা হজ্জে যাচ্ছে। এই মানুষটা আল্লাহ্‌র মেহমান। অথচ মিমির আজও হজ্জ করার সৌভাগ্য হলনা। এই মানুষটার কোন একটা দিক মিমির পছন্দ না। কোনো একটা দিকও না। আগেই বলা হয়েছে চাচির বেশ ভুষা চাল চলনের জন্যই মিমি এই পরিবারটাকে এড়িয়ে চলে। তার উপর ওনার ব্যবহারও ভীষণ রকমের খারাপ। ম্যানার বলে কিছুই উনি জানে না। ওনার ব্যাবহার যে কি পরিমাণ খারাপ তার প্রমাণ এই খানিক বাদেই মিমি আবার পেলো। যখন খাবার রেডি করা হচ্ছিলো। অহেতুক তুচ্ছ কি যেন কারণে চাচি তার সাথে আনা খাদেমাকে এতোগুলো মানুষের সামনে ইচ্ছে মত ঝাড়ি দিলো। ওয়েটারদের কর্কশ ভাষায় দেরি হচ্ছে কেন এই নিয়ে কথা শুনিয়ে দিলো। গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি কোথায় পার্ক করেছে তা খুঁজে না পেয়ে ড্রাইভারকে ইচ্ছেমত গাল মন্দ করে দিলো।

মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো মিমির। এই মানুষটা আগেও একবার হজ্জ করে এসেছে। এবার আবার যাচ্ছে। কিন্তু এই হজ্জের কি ফায়দা হলো যদি নিজেকে তিল পরিমাণও পরিবর্তন করতে না পারলো।

অনেকদিন পর মিমির চাচাতো বোনদের সাথে দেখা হলো। তাদের আধুনিকতা আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে। অবশ্য যতবার দেখা হয় প্রতিবারই মিমির কাছে সব কিছুই আগের বারের থেকে বেশিই মনে হয়। এমন অহেতুক আড্ডায় মিমি কখনই স্বস্তি পায় না। কিছু মানুষ শুধু আউটফিট নিয়ে কথা বলেই মনে হয় বছরের পর বছর পার করে দিতে পারে। এই পরিবারের মানুষগুলোও ঠিক তেমনই।

তাদের মা বাবা হজ্জে যাচ্ছে অথচ তারা পরে আছে কোন পার্টিতে কি ড্রেস পরবে, কোথায় মেইক আপ করবে, কোন ড্রেসের সাথে কোন অরনামেন্টস পরবে, কি জুতা এসব নিয়েই। খুব অল্পতেই হয়তো মিমি বিরক্ত হয়ে উঠে। খুব বিরক্তি নিয়ে মিমি সবে একটা বই হাতে নিয়েছে। হঠাৎ খেয়াল অন্য দিকে চলে গেলো চাচাতো বোনের একটা কথায়, “আম্মু, আমি ভাবছি জেসিকা ম্যাম হজ্জ করে এসে কি ড্রেস পরবে।”

অন্য বোন বললো, “কিহ্‌ ম্যাম হজ্জে যাচ্ছে!!??”
“হ্যাঁ!!”

মিমি কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “হজ্জে যাচ্ছেন তো এভাবে কেন বলছো তোমরা?”

কিছুটা তাচ্ছিল্যার হাসি হেসে চাচি বললো, “জেসিকা ম্যাম, যা ঢং করে চলে!! স্লিভ্লেস ব্লাউজ, এই চিকন পাড়ের শাড়ি। হজ্জ করে এসে…”

চাচির কথা শেষ হবার আগেই পুরো রুমে একটা হাসির রোল পরে গেলো। আর মিমির চিন্তার জগৎ হঠাৎ মোড় পাল্টে ফেললো। কানে শুধু সেদিনের সেমিনারের একটা কথা বাজতে লাগলো, “আপনারা আল্লাহ্‌র মেহমান। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষদের মধ্য থেকে আল্লাহ্‌ আপনাদের নির্বাচিত করেছেন তাঁর ঘরে, রাসুল(সাঃ) এর রাওজায় মেহমান হবার জন্য।”

আমরা কারা আল্লাহ্‌র মেহমানকে বিচার করার! আল্লাহ্‌ নিজে যাদের হজ্জ করার অনুমতি দিয়েছেন আমারা কারা তাদের হজ্জ হচ্ছে কি হচ্ছে না সেটা যাচাই করার! আমরা কিভাবে অন্যের ইবাদাত নিয়ে প্রশ্ন তুলি অথচ আমাদের নিজেদের বালতিই তো ফুটো। শুধু মাত্র কুকুরকে পানি খাওয়ানোর জন্য যে রাব্ব একজন পতিতাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন তিনি কি এই হাজীদের ক্ষমা করবেন না? আর তিনি ক্ষমা করলেন কি করলেন না সেটাইবা বিচারের আমরা কে!! মিমির মনটা হঠাৎ যেন প্রশস্ত হয়ে গেলো। মন থেকে দো’আ করলো চাচির যে যে ব্যপারগুলো মিমির অপছন্দের হজ্জের মাধ্যমে যেন আল্লাহ্‌ চাচিকে সেই সব থেকে পরিত্রাণের ব্যাবস্থা করে দেন। মিমি দো’আ করলো এই পরিবারের সবার জন্য যেন এই হজ্জ হিদায়াতের মাধ্যম হয়। দো’আ শেষে চাচির কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো, “চাচি, হজ্জে যাচ্ছো তুমি, প্লিজ আরাফাহ্‌ এর মাঠে অবশ্যই আমার জন্য দো’আ করবে কিন্তু।”

রব্বের মেহমান
নুসরাত জাহান মুন

অগাস্ট ০৩, ২০১৯ইং