হজ্জের গল্প

এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়’… কবি হেলাল হাফিজের কবিতার এই লাইনটি একটু বদলে বলতে চাই … ‘এখন যৌবন যার, হজ্জে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়’…

আমাদের দেশের মানুষের মাঝে একটা প্রবণতা হচ্ছে জীবনের শেষ পর্যায়ে গিয়ে হজ্জ করা। এর অনেক কারণ আছে। অনেকেই সারা জীবন চাকরী করে শেষ বয়সে পেনশনের টাকা দিয়ে হজ্জ করতে যান। অনেকেই মনে করেন শেষ বয়সে গিয়ে হজ্জ করে সব গুনাহ মাফ করিয়ে আসবেন। আবার অনেকেই সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত করে হজ্জে যেতে চান। অনেকেই আবার ভাবেন হজ্জ করার জন্য মন মানসিকতা এখনো তৈরী হয়নি।

একদম প্রথম কারণটি যুক্তিযুক্ত। কারণ টাকা না থাকলে তো হজ্জে যেতে পারবেন না। কিন্তু পরবর্তী কারণগুলো অযৌক্তিক। যারা মনে করেন শেষ বয়সে গুনাহ মাফ করতে হজ্জে যাবেন অথবা সন্তানকে মানুষ করে তারপর হজ্জে যাবেন, তারা ভুলে যান যে এক সেকেন্ড পরেই তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে। জীবন কি সব সময় আমাদের নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী চলবে ?

গায়ে শক্তি থাকতে থাকতেই হজ্জ করা উচিৎ। কারণ হজ্জ অনেক পরিশ্রমের কাজ। বৃদ্ধ বয়সে হজ্জে গেলে শরীরের কারণেই অনেক কাজ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তখন ইবাদত করে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়না, আর মনের মাঝে আফসোস থেকে যায়। আর যৌবনের ইবাদত আল্লাহ্‌ অনেক বেশী বেশী পছন্দ করেন।

আমরা দেশ বিদেশ দেখার জন্য কত প্ল্যান প্রোগ্রাম করি। কিন্তু হজ্জে যাওয়ার কোন প্ল্যান প্রোগ্রাম করি না। এমনকি ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে ওয়ার্ল্ড ট্যুরে যেতে পারি, কিন্তু হজ্জে যাওয়ার সময় বলি বাচ্চা নিয়ে ইবাদত করা কঠিন।

আপনার সামনে হজ্জে যাওয়ার সুযোগ আসলে তাড়াতাড়ি সেটা গ্রহণ করুণ। এবার হজ্জ নিয়ে আমার জানা অনেকগুলো ঘটনার মাঝে কয়েকটা সত্যি ঘটনা আপনাদের বলি।

ঘটনা # ০১

এক রিক্সাওয়ালা উত্তরার চার নম্বর সেক্টরে রিক্সা চালায়। তার খুব হজ্জ করার শখ। কিন্তু তার সামর্থ্য নেই। সেজন্য হজ্জ ফরযও হয়নি। কিন্তু তার প্রচণ্ড শখ হজ্জে যাওয়ার। প্রতি বছর চার নম্বর সেক্টরের মসজিদে হাজীদের ট্রেনিং এর সময় সে উপস্থিত থাকতো আর বিনা পয়সায় নিজের রিক্সায় চড়িয়ে তাদের গন্তব্যে পৌঁছিয়ে দিত। একদিন মসজিদের সামনে এক লোক তাকে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলো, এই তুমি হজ্জে যাবে? রিক্সাওয়ালা হতভম্ব। সে তো যেতেই চায়। সে আমতা আমতা করতে লাগলো। লোকটা জোড় গলায় জিজ্ঞেস করলো, তুমি যেতে চাও কিনা বল। তখন রিক্সাওয়ালা বললো সে অবশ্যই যেতে চায়। সেই লোক সে বছর সেই রিক্সাওয়ালার হজ্জে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।

ঘটনা # ০২

এবার এক পিয়নের গল্প। কোনো এক অফিসে প্রতি বছর দু’জন করে সেই অফিসের অফিসারদের হজ্জে পাঠানো হয়। সেই অফিসের এক পিয়নের খুবই শখ হজ্জে যাবে। কিন্তু সাধ্য নেই। কাউকে কিছু বলে না। প্রতিবছর সে অফিসে কাকে কাকে হজ্জে পাঠানো হচ্ছে তার লিস্ট দেখে, নিজের জন্য আফসোস করে। একবার হঠাৎ করেই সেই অফিসের ডিজি’র সাথে তাকে পাঠানো হলো হজ্জে। সে মহা খুশী।

ঘটনা # ০৩

আমার ভাইয়ের বন্ধুর এক আত্মীয় হজ্জে গিয়েছেন। তিনি হজ্জে গিয়ে কাবা দেখতে পাচ্ছিলেন না। সবাই দেখছে কিন্তু তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন না। সেখানেই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। দেশে এসে উনাকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো হয়েছিল, অনেক চিকিৎসা করানো হয়েছিল। পরবর্তীতে এক আলেমের সাথে যোগাযোগ করা হয়। ঐ আলেমের ভাষ্যমতে যেটা জানা গেলো, সেটা হচ্ছে তিনি প্রচুর কুফুরী কাজ করতেন। হয়তো সে কারণেই তিনি কাবা দেখতে পারেন নি। তিনি আর সুস্থ হননি।

ঘটনা # ০৪

আমার হজ্জে যাওয়ার বছর দু’এক আগে অফিসে একদিন মেয়েদের নামাজের ঘরে নামাজ পড়ছিলাম। একজন অপরিচিত মহিলাও নামাজ পড়ছিলেন। তিনি আমাদের অফিসে কাজ করেন না। নামাজ শেষে উনার সাথে কথা বলছিলাম। কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম যে, সে বছরই উনি উনার স্বামীর সাথে হজ্জে যাবেন। আমার তো আগ্রহ বেড়ে গেলো। খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করা শুরু করলাম। উনি উনার জীবনের আশ্চর্য এক ঘটনা বললেন।

উনি তার আগের বছর হজ্জের নিয়ত করে ব্যাংকে টাকা রাখা শুরু করেন। খুবই কম টাকা রাখেন প্রতিমাসে। হিসেব করে দেখলেন যে, যে পরিমান টাকা উনি রাখছেন, কমপক্ষে ২৫ বছর লাগবে নূন্যতম হজ্জের টাকা জমতে। তারপরেও হজ্জের টাকা জমাতে শুরু করলেন। এর কিছুদিন পরেই হঠাৎ করেই উনার স্বামী অফিস থেকে বেশ কিছু টাকা পেলেন। আর সে টাকা দিয়েই উনারা এখন হজ্জে যাবেন বলে ঠিক করে ফেললেন। উনি শুধু আমাকে বললেন, নিয়ত করে ফেলেন আপা। শুধু এই ভদ্রমহিলা না, আমি যত মানুষের কাছে হজ্জের ঘটনা শুনতে চেয়েছি, সবাই একবার করে বলেছে, ‘নিয়ত কর’।

আমি তো নিয়ত বহু আগেই করে ফেলেছি। টাকা হাতে আসে আবার খরচ হয়ে যায়। কিন্তু সেই মহিলার কথা শুনে আমি এবার শুধু হজ্জের নিয়তে টাকা জমানো শুরু করলাম। একটা বক্সে যখন যেমন পারতাম রাখতাম। হাতে নতুন টাকা আসলেই বক্সে রেখে দিতাম। সেটা কখনো পাঁচ টাকা হতো, কখনো একশ বা এক হাজার টাকার নোট হতো। খুব সামান্যই জমা হয়েছিল আমার।

এরপর আমার হজ্জের বাকি সব টাকা তো আল্লাহ্‌ আম্মুর মাধ্যমেই জোগাড় করে দিলেন। নিয়ত একটা বিশাল বড় ব্যাপার। কেউ যদি কোন কাজের নিয়ত করে, তাহলে আল্লাহ্‌ কোন না কোন ভাবে সেটা পূরণ করবেনই। সেটা দেরিতে হলেও হবে। তবে নিয়ত হতে হবে একদম মনের গভীর থেকে।

ঘটনা # ০৫

আমার হাজব্যান্ডের ডাক্তারের শাশুড়ি ২০১৭ সালে হজ্জে গিয়েছিলেন। কাবার সামনেই হোটেল। হোটেলে পৌঁছে ব্যাগ রেখে বের হবেন উমরাহ্‌ করতে। হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ এক গাড়ী এসে চাপা দিল উনাকে। সোজা হসপিটালে যেতে হলো। উনার সাথের সবাই হজ্জ করলেন, উনি পারলেন না। চল্লিশ দিন একনাগাড়ে হাসপাতালে থেকে সবার সাথে দেশে ফিরলেন। কাবার সামনে গিয়ে হজ্জ তো দূরের কথা, তাওয়াফই করতে পারলেন না। তাই বলি, ক্ষমতা আল্লাহ্‌’র। আল্লাহ্‌ না চাইলে কিছুই হবে না।

ঘটনা # ০৬

এই ঘটনাটা পড়েছিলাম ফেইসবুকে। এক ফিজিওথেরাপিস্ট ৩০ বছর ধরে হজ্জের জন্য টাকা জমিয়েছিলেন। যেদিন হজ্জের জন্য টাকাটা তুলেছিলেন সেদিন তার এক পেশেন্ট টাকার অভাবে হাসপাতাল থেকে পুরো চিকিৎসা না করিয়েই চলে যাচ্ছিল। তিনি সেই জমানো হজ্জের টাকা পেশেন্টের অজান্তে হাসপাতালে জমা দিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।

একই সাথে উনার খুশী ও মন খারাপ ছিল। রাতে স্বপ্ন দেখলেন তিনি তাওয়াফ করছেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে অফিস থেকে ফোন পেলেন যে, হাসপাতালের মালিক এবার হজ্জে যাবেন, সাথে একজন ব্যক্তিগত থেরাপিস্ট ছাড়া যাবেন না। সেই ফিজিওথেরাপিস্টকে নিয়ে তিনি হজ্জে যেতে চান। সাথে কিছু টাকাও দিতে চান। সেই ফিজিওথেরাপিস্ট তখন তার নিজের ঘটনা বললেন। মালিক তখন সেই পেশেন্টের খরচ নিজেই বহন করলেন আর ফিজিওথেরাপিস্টের টাকা ফেরত দিয়ে দিলেন।

আল্লাহ্‌ সবাইকে হজ্জ করার তৌফিক দেন না, আবার হজ্জ করার পর সবার হজ্জ কবুল করেন না। মক্কায় হারাম শরীফের খুব কাছে থেকেও মানুষ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে পারে না, তাওয়াফ করতে পারে না। অথচ এমন মানুষকে দিয়ে আল্লাহ্‌ ইবাদত করিয়ে নিচ্ছেন, যে কিনা চলতে পারে না, কুঁজো হয়ে চলে, হুইল চেয়ারে চলে, এত অবস্থা খারাপ যে হোটেলে থাকতে পারে না, রাস্তায় থাকে, তারপরেও আল্লাহ্‌ এদের এখানে নিয়ে এসেছেন।

মানুষ যে কত ক্ষুদ্র, নগণ্য আর অসহায় সেটা এখানে বেশ টের পাওয়া যায়। ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ্‌’র, রাজত্ব একমাত্র আল্লাহ্‌’র, এটা এখানে বেশ উপলব্ধি করা যায়। আমি চাইলেই সবকিছু করতে পারবো না, এমনকি ইবাদতও না। “লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ”—- আল্লাহ ব্যতীত অনিষ্ট দূর করার এবং কল্যাণ লাভের কোন শক্তি কারো নেই।

——————————–

হজ্জের গল্প

তাহ্‌নিয়া ইসলাম খান
—————————