উপহার বিনিময়

দৃশ্যপট -১

রাহেলা বেগমের তিন ছেলে। তিনজনেই বিবাহিত ও ভালো চাকুরী করে। ৫ তলা বিল্ডিং এর বাড়ী ভাড়া থেকে তিনি যা টাকা পান তা দিয়ে সংসার খরচ চালানোর পরও বেশ কিছু টাকা উদ্বৃত্ত থাকে তার হাতে। আর এই টাকা তিনি খরচ করেন বিভিন্ন উৎসবের সময়।

ঈদ উপলক্ষে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের জন্য কেনাকাটার পাশাপাশি তিন ছেলের শ্বাশুড়ীর জন্যও একই রকম তিনটি শাড়ি কিনেছেন তিনি। ছোট ছেলের শ্বশুর বিরাট ব্যবসায়ী । প্রতি বছর দেশের বাইরে থেকে ঈদের শপিং করেন।

এবারও একমাত্র মেয়ের শ্বাশুড়ি রাহেলা বেগমের জন্য ইন্ডিয়া থেকে দামী একটি কাতান শাড়ি এনেছেন। মেঝ ছেলের শ্বশুর সরকারী চাকুরীজীবী। ঈদ বোনাসের টাকা পাওয়ার পর দুই মেয়ের শ্বাশুড়ির জন্য জামদানী শাড়ি কিনে পাঠিয়েছেন।

আর বড় ছেলের শ্বাশুড়ি বিধবা মানুষ। ছেলের সংসারে নিজেই থাকেন অতিথির মতো। স্বামীর পেনশনের টাকা থেকে নিজের হাতখরচ চালানোর পর কিছু টাকা জমিয়ে নাতি নাতনীদের জন্য ঈদের কেনাকাটা করতে পারলেও মেয়ের শ্বাশুড়িকে শাড়ি দেয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই তার।

তিনি জানেন, মেয়ের শ্বাশুড়ি নিতান্তই ভদ্র মানুষ। এসব নিয়ে নিশ্চই মনঃক্ষুণ্ণ হবেন না। এদিকে রাহেলা বেগম যখন তার ভাই-বোনদের সাথে ফোনালাপে বার বার উল্লেখ করতে থাকেন তার ছোট দুই ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে পাঠানো শাড়ির কথা তখন বড় ছেলের বউয়ের বুঝতে বাকী থাকে না যে, তার মায়ের পক্ষ থেকে উপহার না পাঠানোর বিষয়টা নিয়ে শ্বাশুড়ি মুখ ফুটে কিছু না বললেও তার মনে ঠিকই চাপা অসন্তোষ কাজ করছে।

তাই শ্বশুর বাড়িতে নিজের মায়ের সম্মান রক্ষার্থে নিজের ঈদ বাজেটের টাকা থেকে শ্বাশুড়ির জন্য একটি শাড়ি কিনে তা নিজের মা পাঠিয়েছে বলে চালিয়ে দেয় সে।

এভাবে নিজের সামর্থ্য না থাকা স্বত্বেও শুধু অন্যের সাথে সমকক্ষতার প্রদর্শনের জন্য যে উপহার দেয়া হয় তাতে কি আদৌ ভালোবাসার বহি:প্রকাশ ঘটে?

দৃশ্যপট -২

জেরিন তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান। নানীর বাড়িতেও একমাত্র নাতনী সে। প্রতিবছর ঈদেই নানী, মামা ,খালা সবার কাছ থেকে জামা উপহার পায় সে। এদিকে দাদা, চাচা, ফুফুরাও ঈদে জামা উপহার দেয় তাকে। সবার কাছ থেকে এত এত উপহার পেয়ে স্বভাবতই অনেক আনন্দিত হয় জেরিন।

কিন্তু সে সমস্যায় পড়ে তখন যখন এই উপহার প্রসঙ্গে তাকে বড়দের অজস্র প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। “ ঈদে কয়টা জামা উপহার পেলে?” “কে কোন জামা দিল?” “কোন জামা কোন মার্কেট থেকে কিনেছ?” “ বাবা আলাদা করে জামা কিনে দেয়নি?” “ কার দেয়া জামাটা সবচেয়ে বেশী পছন্দ হয়েছে?” ইত্যাদি ইত্যাদি।

বড়দের এতসব প্রশ্নে বিরক্ত জেরিন কোন মতে সত্যি কথাটা বলে দিয়ে পালিয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু ছয় বছরের অবুঝ শিশু এখনও বুঝতে পারে না এসব প্রশ্ন আসলে ‘কার দেয়া উপহারের দাম কত,’ ‘কোন আত্মীয়ের আর্থিক স্ট্যাটাস কেমন’-তা যাচাই করার পরোক্ষ কৌশল মাত্র।

এভাবে টাকার অঙ্ক দিয়ে উপহারের মূল্য বিবেচনা করার যে মানসিকতা শৈশবেই একটি শিশুর মনে প্রোথিত করা হচ্ছে তাতে করে কি পরবর্তী জীবনে ‘যে কোন উপহার’ই তার মনে নিষ্পাপ আনন্দের অনূভুতি সঞ্চারিত করবে? নাকি উপহার পাওয়ার পরেই সে সবার আগে ‘price tag’ ও ‘ brand name’ দেখে সেই উপহারের মূল্যায়ন করা শিখবে?

দৃশ্যপট -৩

সালমান একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পড়াশোনার পাশাপাশি হাতখরচ চালানোর জন্য একটি টিউশনি করায় সে। তার ছাত্র আলিফ মেধাবী হলেও অমনোযোগীতার কারণে এতদিন পরীক্ষায় ভালো ফল করতো না । এ বছর সালমানের কাছে পড়ে প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় অনেক ভালো ফল করেছে সে। এতে খুশী হয়ে আলিফের মা সালমানের এ মাসের বেতনের সাথে আরও কিছু টাকা বাড়তি দিয়ে বলেছেন ঈদের কেনাকাটা করতে।

অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়া এই অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে কি করবে তা ভাবতে ভাবতে বাসায় ফিরছিল সালমান। একবার ভাবল মা ,বাবা ,ছোট বোনের জন্য ঈদের পোশাক কিনে নিয়ে গেয়ে ওদের সারপ্রাইজ দিবে।

কিন্তু পরক্ষণেই আইডিয়াটা বাদ দিল এই ভেবে যে, মা,বাবা, বোন প্রতিবছর ঈদে নিজেরা তো শপিং করেই আবার আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকেও প্রচুর গিফট পায়। ওদেরকে দেয়া মানে ‘তেল দেয়া মাথায় আবার তেল ঢালা।’

হঠাৎ ওর মনে পড়ল আব্দুর রহমান চাচার কথা। ওদের বাসার প্রাক্তন ড্রাইভার আব্দুর রহমান চাচা গত বছর অ্যাক্সিডেন্টে পা হারানোর পর এখন আর চাকুরি করতে পারেন না। বস্তির পাশে একটি চায়ের দোকান চালিয়ে এখন সংসার চলে তার। প্রচন্ড আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন আব্দুর রহমান চাচা যে ঈদের সময় যাকাতের কাপড় নিতে লাইনে গিয়ে দাঁড়াবেন না এটা ভালো মতোই জানে সালমান।

তাই আব্দুর রহমান চাচা, উনার বউ আর ছেলের জন্য ঈদের কাপড় কিনে ওদের বাসায় হাজির হলো সে। চাচাকে বলল, “আমার নিজের রোজগারের টাকা থেকে আপনাদের জন্য সাধারণ কিছু কাপড় এনেছি। ঈদের দিনে আপনারা সবাই পড়লে খুশি হবো।” উপহার পেয়ে হতবিহ্বল চাচা ওর মাথায় হাত রেখে দোয়া করে বলল, “আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দিন।”

এই সামান্য উপহার পেয়ে ওদের চোখে যে আনন্দের ঝিলিক দেখল তা দেখে সালমানের মনে হলো সঠিক মানুষকে সামান্য উপহার দিয়েও যে এত আর্শীবাদ পাওয়া যায় তা কি ও আগে কখনও বুঝতে পেরেছে?

উপরের এই ঘটনাগুলো কাল্পনিক হলেও সম্পূর্ণ অবাস্তব নয়। প্রতি বছর ঈদুল ফিতরের সময় সামর্থ্যবান মুসলিম পরিবারগুলোতে উপহার আদান-প্রদানের এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়; যা ঈদুল ফিতরের প্রকৃত তাৎপর্যের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।

দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর মুসলমানদের জন্য আল্লাহতায়ালা ঈদুল ফিতরকে এক অমূল্য উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন। এই দিনকে কেন্দ্র করে যখন মুসলমানরা একে অপরের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয় তখনই ঈদুল ফিতরের প্রকৃত সৌন্দর্য় ফুটে উঠে। আর উপহার বিনিময় হওয়া উচিত এই আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়ার একটি মাধ্যম মাত্র।

ইসলামে উপহার বিনিময়ের গুরুত্ব প্রসঙ্গে মহানবী (সাঃ) বলেছেন-

“তোমরা পরষ্পর উপহার বিনিময় করো যেন তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়।” (বুখারী)

তবে সবসময় যে উপহার পেলে তার বিনিময়ে similar gift return করতে হবে এমন বাধ্যবাধকতাও ইসলামে নেই। বরং যে কোন বস্তুগত উপহার প্রাপ্তির পর তার সর্বোত্তম প্রতিদান হতে পারে ‘জাযাকাল্লাহ’ বলে আল্লাহর কাছে উপহার দাতার জন্য দু্আ করা।

এই প্রসঙ্গে মহানবী (সাঃ) বলেছেন-
“যখন কেউ তোমাকে উপহার দেয় তখন তার প্রতিদান দাও আর যদি তা দেয়ার সামর্থ্য না থাকে তবে তার জন্য দুআ করতে থাকো, যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি আত্মতৃপ্তি পাও ।” (তিরমিযী)

তাই আসুন, এই ঈদুল ফিতরে আমরা উপহার বিনিময়ের ক্ষেত্রে ‘unnecessary competition’ এর পরিবতর্তে ‘urgent need’, ‘price tag’ এর পরিবর্তে ‘value of love,’ এবং ‘material gift এর বিনিময়ে ‘eternal gift’ দেয়ার ট্রেন্ড চালু করি। তাহলে দেখবেন এবারের ঈদ এক অন্যরকম বিশেষত্ব নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হবে।

উপহার বিনিময়
হাবিবা মুবাশ্বেরা

জুন ০১, ২০১৯ইং