‘তৃপ্তি’

১.

– “আজকে কিন্তু লেট করলে তোর খবর আছে!”
-‎ “খাওয়ার ব্যাপারে আমি কোনদিন লেট করসি?”
-‎ “তাও ঠিক, তুই যে একটা খাদক! তোর নামটা কি মনে করে যে রাখসিলো…”

বন্ধুর দেয়া শেষ মেসেজটার রিপ্লাই দিলো সিয়াম একটা ভেংচি কাটার ইমোটিকন দিয়ে। নিজের নাম সিয়াম অর্থ ‘বিরত থাকা’ বলে তার খাই খাই স্বভাবের জন্য মাঝে মধ্যে একটু বেশিই পঁচানি খেতে হয়। কিন্তু তাতে তার কোনো কিছুই আসে যায় বলে মনে হয় না।

“আমি কি মানুষের টাকায় খাই নাকি? দুই দিনের দুনিয়া, খাওয়া পেলে খাবো না কেন?” – অলসভাবে শুয়ে এসব ভাবতে থাকে সিয়াম। তারমধ্যেই হঠাৎ তার মায়ের আগমণ-

“কিরে, আর কতক্ষণ বিছানায় পরে থাকবি। রোজা রাখলেই কি এত ঘুমাতে হয় নাকি। যোহর নামাজ মিস করবি তো এই ভাবে শুয়ে থাকলে…”
সিয়াম কোনো উত্তর দেয় না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝে, মায়ের কথায় যুক্তি আছে। যোহর নামাজ পড়তে হলে তার আর শুয়ে থাকা চলবে না। সারাবছর না হলেও, রমজান মাসে তো সে পাঁচ ওয়াক্তই নামাজ পড়ার চেষ্টা করে।

ম্যাজম্যাজ করা শরীর নিয়ে কোনোরকম নামাজ পড়ে রান্না ঘরে উকি দেয় সিয়াম। তার মা কি নিয়ে জানি খুব হুলুস্থুল করছে। চোখাচোখি হতেই মা অতি উৎসাহের সঙ্গে বললো-

– “তোর জন্য হালিম বানাচ্ছি আজ! সকালে তোর বাবাকে কত বার যে রিকুয়েস্ট করা লাগলো খাসির মাংস এনে দেয়ার জন্য। তারপর শোন-“
– ‎”ওহহো মা, তোমাকে তো বলাই হয়নি! আজকেও ইফতার পার্টি আছে একটা। যেতেই হবে।”
সিয়ামের মায়ের মুখটা মলিন হয়ে গেলো। হালিমের জন্য তিনি কম খাটনি করেননি। তার একমাত্ৰ ছেলে এই বছর চাকরি শুরুর পর থেকে প্রত্যেকটা দিন অনেক রাত করে বাসায় ফিরে, এমনকি রমজান মাসেও। ছুটি কেবল শুক্রবার,তাও প্রথম দুটা শুক্রবারই তার গেলো কোথাকার কোন ইফতার পার্টিতে। কে জানতো এই শুক্রবারও…

মানে মানে কেটে পড়লো সিয়াম, পাছে মা আবার বলে বসেন- “এই বার না গেলে হয় না?” এবারেরটা সে কোনো ভাবেই মিস করতে চায় না। এমন দারুণ ইফতারের অফার কে মিস করতে চাইবে? যদিও দামটা একটু বেশি, কিন্তু আইটেমের সংখ্যাও ব্যাপক। তাই দাম নিয়ে থোড়াই কেয়ার করে সে। মনে মনে ভাবে-
“আজকে সব আইটেম খাবো, একদম তৃপ্তি করে খাবো, হুম!”

খাওয়ার কথা মনে হতেই পেটটা গুড়গুড় করে উঠে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে এখনো অনেক দেরি। আসর নামাজ পড়ে মোবাইলটা হাতে নেয়, একটু সময় পার করতে। ইউটিউব এ স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ টাইটেল দেখে একটা ভিডিওতে চোখ আটকে যায়। অচেতন মনে সেটাই সিলেক্ট করে দেখা শুরু করে সিয়াম।

২.

জীবনে বিপর্যয় আসতে পারে যে কোনো মুহূর্তে- হাতের বাঁধনের দিকে তাকিয়ে এই কথাটাই ভাবছে অসহায় বন্দি। কালই যে ছিল সম্ভ্রান্ত নেতা সে কিনা আজ পরাধীন! এর নামই ভাগ্য।

ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কাতর,তাই সামনে রাখা খাবারটুকু আটক নেতার কাছে সামান্যই মনে হলো। তার মতো মানুষকে শত্রুরা আটকে রেখেছে তাদের উপাসনালয়ে, ভাবা যায়! তবে কিনা তাদের ব্যবহার খুবই ভালো। কিন্তু কেন? ভেবে সে উদ্ধার করতে পারলো না।
এভাবে তিনটা দিন পার হয়ে গেলো শত্রুদের আন্তরিক আপ্যায়নে, তাদেরকেই নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে। অবশেষে মিললো নিঃশর্ত মুক্তি। কিন্তু কি আশ্চর্য, এতোদিন যেই ব্যক্তি, যেই ধর্ম, যেই শহর ছিল তার সবচেয়ে অপছন্দের, সেসবই এখন তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় মনে হলো।

অবশেষে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলো সেই বন্দি,যার নাম সুমামা বিন আসাল।

সাহাবীরা আনন্দিত হয়ে তার জন্য সাধ্যানুযায়ী বাহারী খাবারের ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু আজ সে খেতে পারলো না বেশি। সবাই অবাক হলেন।
সবার বিস্ময়ের কারণ ব্যাখ্যা করলেন স্বয়ং রাসূল (সাঃ)- “তোমরা কেন অবাক হচ্ছো ? সে সকালে খেয়েছে একজন অবিশ্বাসীর পেট নিয়ে, আর এখন খেয়েছে একজন মুসলিমের পেট নিয়ে। নিশ্চয়ই, অবিশ্বাসীরা খায় সাতটি পেট নিয়ে, আর মুসলিমরা খায় একটি নিয়েই।”*

৩.

সিয়াম স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে তার রুমে, হাতে ফোন। বুকের ভেতর কেমন যেন একটা অনুভূতি কাজ করছে- একদমই নতুন সেই অনুভূতি। এদিকে দিনের আলো প্রায় ফুরিয়েই যেতে চলেছে।

হঠাৎ হাতের ফোনটা বেজে উঠলো। ঝাপসা চোখে সেটা কোনো মতে ধরা গেলো।
– “কিরে সিয়াম, তুই কই?”
-‎ “আমি আসতে পারছি না রে, স্যরি।”
সিয়ামের মা আজ ইফতারে তার ছেলেকে সঙ্গে পেয়ে পুরোই আনন্দে আটখানা। ছেলের পাতে এটা সেটা তুলে দিয়ে ছোট খাটো পাহাড় গড়ে ফেললেন। কিন্তু সিয়াম বেশি খেতে পারলো না আজ। তবু কেন জানি অদ্ভুত এক তৃপ্তিতে মনটা তার ভরে গেলো।

………..

রেফারেন্স:
*সহীহ বুখারী: ৫৩৯৪

‘তৃপ্তি’
বিনতে আব্দুল্লাহ

মে ৩১, ২০১৮ইং