দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাত

দৃশ্যপট-১

জামান সাহেব বিরাট ব্যবসায়ী। রাজধানীর একটি অভিজাত এলাকায় বসবাস করেন। সারা বছর গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার সময় পান না তিনি। তবে বছরে একবার অর্থ্যাৎ রোজার মাসে তিনি গ্রামের বাড়িতে যান যাকাতের কাপড় দিতে। তার আগমন উপলক্ষে পুরো গ্রামে যেন উৎসবের আমেজ তৈরি হয়।

অন্যান্য যাকাত দাতাদের তুলনায় তার দেয়া শাড়ি ও লুঙ্গির মান অনেক ভালো বলে গ্রামের দরিদ্র মানুষ সারা বছর অপেক্ষায় থাকে কবে জামান সাহেব যাকাতের কাপড় দিতে আসবেন!

তিনি গ্রামে আসার কয়েকদিন আগে থেকেই যাকাত দেয়ার তারিখ ও স্থান জানিয়ে এলাকায় প্রচারণা শুরু হয়ে যায়। নির্ধারিত দিনে জামান সাহেব তার দামি গাড়িতে করে গ্রামে আসেন যাকাতের শাড়ি ,লুঙ্গির শত শত প্যাকেট আর এগুলো বিতরণের জন্য ৪-৫ জন সহযোগী নিয়ে।

সহযোগীদের কেউ যাকাত নিতে আসা নারী-পুরুষদের লাইনে দাঁড় করানোর ব্যবস্থা করেন, কেউ জামান সাহেবের হাতে কাপড় তুলে দেন আবার কেউ ছবি তোলার দায়িত্ব পালন করেন। তীব্র গরমে দরদর করে ঘামতে থাকলেও জামান সাহেব হাসিমুখে ছবির জন্য পোজ দেন যেন সন্ধ্যাবেলা ফেসবুকে আপলোড করা ছবিতে এবং পরের দিনের লোকাল পেপারে ছাপানো ছবিতে তার হসিমুখ দেখে বোঝা যায় তিনি কতটা আনন্দিত চিত্তে দরিদ্রদের সাহায্য করছেন!

আর সারা দিন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর একটি শাড়ি বা লুঙ্গি পাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করায় দরিদ্র মানুষগুলোর মুখেও তখন ফুটে ওঠে বিজয়ের হাসি। এভাবে যাকাত দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের সাময়িক আত্মতৃপ্তিতেই শেষ হয় যাকাত দেয়ার এই বাৎসরিক আয়োজন।

এভাবে বৃহৎ সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র পরিমাণ দান (একটি শাড়ি/ লুঙ্গি) করে পরবর্তী বছরগুলোর জন্য পরনির্ভরশীল করে রাখলে তা কি আদৌ সম্পদের গতিশীলতা তৈরি করে দারিদ্র বিমোচনে ভূমিকা রাখে? নাকি শুধু দানের শো-অফ এর মাধ্যমে আত্মতুষ্টেই অর্জিত হয়?

দৃশ্যপট ২

রিসানার মা রাতের বেলা ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে ওর বাবাকে বলছিলেন, ওদের বাসার কাজের বুয়া রহিমা খালার দুর্দশার কথা। চার মাস আগে বুয়ার গার্মেন্টস কর্মী স্বামী একটি অ্যাক্সিডেন্টে একটি হাত হারায়। আগের মতো আর গার্মেন্টসে কাজ করতে পারবে না সে। দুই বাচ্চা সহ চারজনের সংসার বুয়া একা কিভাবে চালাবে এই চিন্তায় দিশেহারা অবস্থা এখন রহিমা খালার।

উপরন্তু স্বামীর চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে এই কয়েক মাসে অনেক দেনাও হয়ে গেছে তার। তাই রিসানার মা ঠিক করেছে এবারের যাকাতের টাকার পুরোটাই রহিমা খালাকে দিবে। এতে যদি একটু উপকার হয় তার।

দীর্ঘদিনের গৃহকর্মী রহিমা খালার এই অসহায় অবস্থার কথা শুনে রিসানার মনটাও খারাপ হয়ে গেল। উনার জন্য কিছু একটা করার তাগাদা অনুভব করলো মনের ভিতর।

রাতের বেলা ফেসবুকে ওর কাছের বান্ধবীদের গ্রুপ ‘গার্লস স্কোয়াডে ’একটা পোস্ট দিল সে। বান্ধবীদের সবাইকে প্রস্তাব দিল নিজেদের অভিভাবকদের সাথে আলাপ করে যাকাত দেয়ার জন্য যে টাকাটা প্রত্যেক ফ্যামিলি নির্ধারণ করে রেখেছে তা বিচ্ছিন্নভাবে কাউকে না দিয়ে সবার টাকা একত্রিত করে একটা ফান্ড তৈরি করার।

এই ফান্ডের টাকা দিয়ে রহিমা খালার জন্য কিছু একটা করতে চায় সে। দু-একজন বাদে অধিকাংশ বান্ধবীই এই প্রস্তাবে সাড়া দিল। ২০জনের দেয়া যাকাতের টাকা একত্রিত করে প্রথমে রহিমা খালার সব ঋণ শোধ করল রিসানা। এরপর উনার স্বামীর জন্য বস্তির পাশেই একটি মুদি দোকান ভাড়া নিয়ে দিল ওর বাবা।

সেই সাথে ১ম মাসে বিক্রি করার জন্য প্রয়োজনীয় মালামালও কিনে দিল। আর রিসানার বান্ধবীরা সবাই এবারের রোজার পুরো মাসের গ্রোসারি আইটেম এই মুদি দোকান থেকেই কিনল। এভাবে সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় রহিমা খালার পরিবার ঋণমুক্ত হয়ে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ পেল।

তাদের হাসিমুখ দেখে রিসানার বান্ধবীরা প্রতিজ্ঞা করল পরের বছর রোজাতেও সবার যাকাতের টাকা একসাথে করে তারা এরকম অন্য কোন দরিদ্র পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করবে।

অর্থাৎ একটি ব্যাপারটি এখানে স্পষ্ট যে,পরিকল্পিত উপায়ে ও দীর্ঘমেয়াদে কার্যকরী হবে এমন খাতে যাকাতের অর্থ খরচ করলে তা সমাজে সম্পদের প্রবাহ তৈরি করে ধনী ও দরিদ্রের মাঝে একটি অর্থনৈতিক ভারসাম্য তৈরির চমৎকার মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে।

তবে এজন্য প্রয়োজন সঠিক পদ্ধতিতে যাকাত প্রদান করা ও এর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষেই ধনী-দরিদ্রের আর্থিক বিভেদ দূর করার আন্তরিক সদিচ্ছা অন্তরে লালন করা।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-

তোমাদের বিত্তবানদের মধ্যেই যেন শুধু সম্পদ আবর্তন না করে।
[ সূরাহ হাশর: ৭]

তাই আসুন ,আমরা যথাযথ খাতে যাকাত প্রদান করে সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করি যেন পরকালে এই সম্পদ আমাদের জন্য বেদনাদায়ক আযাবের কারণ না হয়।

দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাত
হাবিবা মুবাশ্বেরা

(২৯/০৫/১৯)