নিষ্প্রদীপ হৃদয়

এক.

ইশরাতের বাসায় আজকে ওর ইউনিভার্সিটির বান্ধবীদের দাওয়াত। নাদিয়া, মুন ইশরাতের কাছের বান্ধবী। কাছের বান্ধবী হলেও কিছু ব্যাপারে তাদের মধ্যে মত বিরোধ থাকেই সবসময়। যেমন, ওদের মধ্যে মুন একটু ধার্মিক। বাকিদের গান বাজনা, মুভি, প্রেমের গল্প এসব নিয়ে কথা উঠলেই মুন এড়িয়ে যায়, চুপচাপ থাকে যা অন্যদের পছন্দ না। মাঝেমাঝে বোঝানোর চেষ্টা করে ওদের।

ইশরাতের সাথে নাদিয়ার সবসময় একটা খুনসুঁটি লেগেই থাকে। ইশরাতের স্বভাব হচ্ছে সে অন্য সব দোষ সবাইকে বলে বেড়াবে নাহয় সবার সামনে তাকে খোঁটা দিয়ে কথা বলবে। তারপর বলবে, “যা বলেছি সত্যিই তো বলেছি।” নাদিয়ার আজকাল খুব মন খারাপ থাকে। খুব কঠিন এক সময় পার করছে সে। ইশরাত জানে সে এখন কঠিন সময় পার করছে এবং নিজের কিছু ভুলের জন্য ডিপ্রেশনে ভুগছে।

মুন আসার সাথে সাথে ইশরাতকে পরোক্ষভাবে বুঝিতে চাইলো, “বুঝলি ইশরাত, ফেইসবুকের চেয়ে বড় ফিতনার জায়গা আর নাই। নাসিহা দেয়ার নামে মানুষকে অপমান করার কারখানা হয়ে গেছে। খোঁটা দিয়ে কথা বলবে, নাহয় অন্যের দোষ গুনাবে আর নিজেকে ত্রুটিমুক্ত প্রমাণ করতে চাইবে।

একটা হাদিসে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “মুমিনগণ খোঁটাদানকারী, অভিশাপকারী, নির্লজ্জ ও অশ্লীলভাষী হয় না। আরেকটা হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি অন্যের গুনাহ এই দুনিয়াতে গোপন করবে, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা সেই ব্যক্তির গুনাহ হাশরের ময়দানে গোপন করবেন এবং মাফ করে দিবেন। কিন্তু মুনের নসীহা ইশরাতকে চুপ করাতে পারলো না।

ইশরাতের পরিকল্পনাই ছিলো নাদিয়াকে অপমান করা। সুযোগ বুঝে দু’চারটা চরম সত্য কথা শোনালো নাদিয়াকে। সে ভুল করেছে, গুনাহ করেছে, এখন সে অনুতপ্ত। নাদিয়া কথা গুলো শুনেই গেলো পালটা কোন উত্তর দিলো না। মুন ইশরাতকে বললো, “তোর উচিৎ ছিলো নাদিয়ার কথা দ্বারা স্বান্তনা দেয়া। সে যেন একা না হয়ে যায়, আরো বড় ভুল না করে বসে।” ইশরাত বলে উঠল, “মুন, আমি যা বলেছি সত্যিই তো বলেছি। তুই না এত ধার্মিক, আমাকে মিথ্যা বলতে বলছিস নাকি!” আর সে মনে মনে বেজায় খুশি হল, “আজকে শোনালাম ইচ্ছামত! খুব ভালো হচ্ছে তোর সাথে যা হচ্ছে!”

ওয়াসিলাহ্ ইবনুল আসক্বা (রাঃ) থেকে বর্নিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন: তোমার ভাইয়ের বিপদে আনন্দিত হয়ো না। কেননা এতে আল্লাহ তার প্রতি করুণা করবেন এবং ঐ তোমাকে বিপদে নিমজ্জিত করবেন। [রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ১৫৮৫]

দুই.

তিথিদের বাসায় আজকে রাবেয়া খালা এসেছে। তিথির মার বড় বোন রাবেয়া খাতুন। তিথির মা তার বড় বোনের কথার উপর একটা কথাও বলতে পারে না। ছেলে মেয়ে সব ওয়েল স্ট্যাবলিশড, গাড়ি বাড়ি সব দিকে সুখে আছেন তাই তার হুকুমে চলে তিথির নানার বংশে সবাই। রাবেয়া খাতুন যখনই আসে তার ছেলের রেফারেন্সে তিথির ভাইয়ের চাকরি হয়েছে এটা দুই তিনবার অবশ্যই শোনাবেন আর তিথির বিয়ে নিয়ে কথা তো তুলবেনই।

তিথি ড্রইং রুমে এসে সালাম দিয়ে বসতে না বসতেই রাবেয়া বেগম বললেন, “কিরে তোর জন্য কি মংগল গ্রহ থেকে ছেলে খুঁজে আনবে তোর বাবা মা? কারণ এইদেশের ছেলে তো তোর পছন্দ হচ্ছে না।” তিথি চুপচাপ মাথা নিচু করে শুনছে। মাও চুপ।

রাবেয়া বেগম আবার বললেন, “এই তুই আর বড় ভাইয়ের মেয়ে শীলা, তোরা কি বিয়ে করবি না এই জীবনে! কি চাচ্ছিস তোরা।” তিথি এবার বললো, “খালা, শীলা কি চায় আমি কি করে বলবো। আমি তো আর ওকে…” তিথি কথা শেষ করার আগেই তিথির মা ওর হাত চেপে ধরে ধমকের সুরে বললেন, “তিথি তর্ক করে না খালার সাথে।”

খালা আবার বলতে শুরু করলেন, “শীলার নাহয় বাবার টাকা আছে। বয়স হয়ে গেলেও ওর বাবার টাকা আর সম্পত্তি দেখে বিয়ে করে নিয়ে যাবে। কিন্তু তোকে কি দেখে বিয়ে করবে?” তিথি করুন মুখে ওর মার দিকে তাকালো। মা মাথা নিচু করে চোখের কোনা মুছে নিলো। তিথি বুঝে গেছে ওর মা এই কথাতে খুব কষ্ট পেয়েছে।

তিথি বড় খালাকে বলল, “খালা, আমি আপনি দুনিয়াতে আসার ৫০ হাজার বছরেরও আগে আমাদের জোড়া আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা নির্ধারণ করে রেখেছেন। যার সাথে বিয়ে হওয়ার হয়ে যাবে। সেই সময়েই হবে যে সময়ে আল্লাহ হুকুম দিবেন।” বলে, উঠে চলে গেলো।

রাবেয়া বেগম চেচিয়ে তার বোনকে বললেন, “শুনেছিস তোর মেয়ে কি বলে গেলো, শুনেছিস! আমি কি তোর মেয়ের ভালো মন্দের ব্যাপারে কথা বলতে পারবো না নাকি! আর আসবো না এখানে। দেখি কোন ঘরে বিয়ে দিস তোর মেয়েকে।” মা চুপ করে শুনে যাচ্ছে কিছু বলার ক্ষমতা নাই কারন বোনের অনেক টাকা কিছু বললে বংশের বাকিরা তাকে বয়কট করতে পারে।

তিন.

রিনির পাশে ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়াটিয়া লুনা। পরিচিত হতে এসে লুনা। রিনির বিয়ের চার বছর আর এখনো কোন বাচ্চা হয়নি শুনে লুনা বলল, “ট্রাই করতেছেন না, ভাবি? ডাক্তার কার সমস্যা বলছে?” রিনি খুব ইতস্তত বোধ করছে। রিনি যতই কথা এড়িয়ে যেতে চায় ততই লুনা ইনিয়ে বিনিয়ে একই প্রসংগে কথা বলতে চায় যায়। আরো কত্ত প্রশ্ন এই প্রসঙ্গের সাথে জুড়িয়ে দিচ্ছে।

“জামাইয়ের সাথে সম্পর্ক কেমন? “বাচ্চা নাই দেখে জামাই রাগ করে নাকি? শশুড়বাড়ির মানুষ বংশ রক্ষার জন্য জামাইকে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে নাকি!” রিনির এত দিনে এইধরনের প্রশ্নে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার কথা। প্রতিদিন শ্বাশুড়ি ফোনে একই কথা জিজ্ঞেস করে, “ডাক্তার দেখিয়েছো? ঢাকায় থাকো, বড় কোন গাইনী ডাক্তার দেখাও। আমাদের সময় এত ডাক্তার লাগতো না বাবা। বিয়ের পরপরই বাচ্চা পেটে আসছে। আমার ডায়বেটিসও বাড়ে কমে, প্রেশারও হাই। একটা নাতি দেখার নসিব হবে কি না আল্লাহ্ই জানেন।”

রিনির চোখে পানি চলে আসে কিন্তু শব্দ করে কাঁদতে পারে না। শুধু চুপ করে শুনে যাচ্ছে আজ চারটা বছর। বাবার বাড়ির আত্মীয় -স্বজন, রিনির বান্ধবীরা, আশেপাশের মানুষজন, এমনকি কাজের বুয়াও কয়দিন আগে এক কবিরাজের ঠিকানা দিয়ে গেলো। প্রতিটা দিন চুপ করে কারো না কারো কথা শুনে যায় রিনি।

আজ নতুন প্রতিবেশী লুনা, যার সাথে আধা ঘন্টাও হলো না পরিচয় হয়েছে তার প্রতিটা প্রশ্ন রিনি ভিতরটা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এইসব প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় যে নেই। চুপ করে শুনে যেতে হবে। আল্লাহ্ একটা সন্তান দান না করা পর্যন্ত প্রতিদিন কেউ না কেউ এইসব প্রশ্ন করেই যাবে। .

চার.

দুনিয়াতে প্রতিটি জীবের রিযক্ব আর-রাজ্জাক এর নির্ধারণ করা। কারো উপার্জনের ব্যবস্থা, খাবার ব্যবস্থা আল্লাহই করে রেখেছেন। চাকরি যেমন রিযক্ব তেমনি বিয়ে আর সন্তানও। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা আমানাহ হিসেবে তাঁর বান্দাকে সন্তান দান করেন। কেউ চাইলেই সন্তান নিতে পারে না।

আমাদের সমাজে প্রচলিত একটা কথা আছে, “বাচ্চার জন্য ট্রাই করছো না!” বিয়ের কিছু সময় পর থেকে দম্পতিদের বিশেষ করে মেয়েদের এই কথাটা শুনতে হয়। এই কথাটার অর্থ কেউ কি ভেবে দেখেছেন? মানে, “তোমরা হাসব্যান্ড ওয়াইফ একসাথে সময় কাটাচ্ছো না!” একটা মেয়ের জন্য এটা কতটা বিব্রতকর। কিন্তু অদ্ভুত ব্যপারে হচ্ছে মেয়েরাই মেয়েদের এই প্রশ্ন করে।

যাদের একটা বাচ্চা আছে, তারা আরেকটা বাচ্চা নিচ্ছেন না কেন? যাদের দুইটা বাচ্চা আছে, তারা আরেকটা কেন নিবে? তিনটা বাচ্চা! এই যুগে এত বাচ্চা কেউ নেয়! কারো প্রথম সন্তান মেয়ে, “আহারে ছেলে হলে ভালো হতো, এরপর না হয় মেয়ে হতো!” এ যেন সব আমার নিজেরাই নির্ধারণ করি, কার ছেলে আগে হবে, কার মেয়ে, কার দুইটা বাচ্চা হতে হবে, কার তিনটা।

——————————————————–

আপনার পরিচিত কারো চাকরি হচ্ছে না বা চাকরি চলে গেলো, বিয়ে হচ্ছে না বা সে বিয়ে করতে চাচ্ছে না, বাচ্চা হচ্ছে না, একটা বাচ্চা হওয়ার পর দ্বিতীয় বাচ্চা নিচ্ছে না বা খুব কম গ্যাপে দুইটা তিনটা বাচ্চা হয়ে গেলো, বা কারো তালাক হয়ে গেলো, কারো পারিবারিক ব্যাপার এবং সে এসব ব্যাপারে কথা বলতে পছন্দ করছে না কিন্তু আপনাকে কথা গুলো জানতেই হবে।

আপনি তাকে প্রশ্নের উপর প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর যেনে আপনার কোন লাভ নেই কোন ক্ষতিও নেই। হয়ত আপনি এটা নিয়ে অন্য কোথাও “গপ্প” জুড়িয়ে দিবেন। এছাড়া এই জেনারেল নলেজ গেইন করে আপনার কোন উপকার বা অপকার হবে না।

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্নিত,
তিনি বলেন-রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ

“অনর্থক অপ্রয়োজনীয় বিষয় ত্যাগ করাই একজন ব্যক্তির উত্তম ইসলাম।”
‌‌‌‌__________________________________

আমাদের সবারই কিছু না কিছু খারাপ অভ্যাস আছে। কিছু খারাপ অভ্যাস এমন যা অন্যদের কষ্ট দিয়ে বসে, আবার কখনো আমাদের নিজেদের দুনিয়া এবং আখিরাতের ক্ষতির কারণ হয়ে যায়। আমরা হয়তো সেই খারাপ অভ্যাসটা নিয়ে চিন্তা করি না বা এতটা পাত্তা দেই না।

আমরা আমাদের বড় বড় গুনাহ গুলো থেকে বাঁচার চেষ্টা করি কিন্তু ছোট ছোট গুনাহ গুলো ভুলে যাই। যেমন- কাউকে কষ্ট বা খোঁটা দিয়ে কথা বলা, কারো কাজকে ছোট করা ইত্যাদি। যে মানুষের জীবন পরীক্ষা মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তাকে নতুন করে কষ্ট দেয়া তার উপর জুলুম হয়ে যায়।

আমরা মুসলিম। আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মাহ। আমরা পানি পান করার সুন্নাহ, জুতো পরা ও খোলার সুন্নাহ, আরো অনেক সুন্নাহ পালন করি কিন্তু মুসলিম ভাই বোনদের ছোট করে কথা বলা, প্রতিবেশীদের কষ্ট দেয়া, কারো দুঃখ-কষ্টের সময়ও কাউকে দুটো কটুবাক্য শোনাতে আমরা ছাড় দেই না। এটা তো আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহ থেকে শিক্ষা পাই না।

আবূ হুরাইরা (রাঃ), নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ভাল কথা বলাও সাদকাহ। (বুখারী ও মুসলিম)

________________________________

এই মহিমান্বিত মাসে আমরা কি নিজেদেরকে একটু পরিবর্তন করতে পারি না? আমরা যেন অহেতুক কারো ব্যাপারে কৌতুহল না প্রকাশ করি। আমরা কি নিজেদেরকে অন্যের জন্য, নিজের পরিচিত, কাছের মানুষদের জন্য সেই জায়গাটা হতে পারি না, যাতে সে মন খুলে সব কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারে।

কারো খুশির কারণ না হতে পারলেও অন্তত জেনে বুঝে কাউকে কষ্ট দেবেন না। কেউ না চাওয়া পর্যন্ত তার ব্যাক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবেন না। কারো কষ্ট দেখে খুশি হবেন না, তাকে খোঁটা দিয়ে কথা বলবেন না। সুখও মানুষকে আল্লাহর রাস্তা থেকে দূরে সরিয়ে নিতে পারে। কারো কষ্ট হতে পারে তার হেদায়েতের উসিলা। আর আপনার উত্তম আদব এবং আখলাক হতে পারে কারো জন্য ইসলামের পথে আসার উত্তম দাওয়াত।

আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্নিত,

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে; নচেৎ চুপ থাকে।”

রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ১৫১৯
হাদিসের মান: সহিহ হাদিস।

আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা এবং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন ও হাদিসে আমাদের কতবার সাবধান করে দিয়েছেন ভালো কথা বলার ব্যপারে, অন্যের সাথে উত্তম ব্যবহার করার ব্যপারে, অহংকার না করার ব্যাপারে, যা আমাদের জাহান্নাম যাওয়ার কারণ হবে। আল্লাহ্ আমাদের তৌফিক দান করুন মানুষের সাথে উত্তম কথা বলার এবং অনর্থক ও কাউকে কষ্ট দিয়ে কথা থেকে বিরত থাকার।

————– ————– ————– ————–
নিষ্প্রদীপ হৃদয় 
আদিনা আমাতুল্লাহ