মহিমান্বিত রজনীর সন্ধানে

ভোর রাত চারটা, ২৯ শে রামাদান
পুত্রজায়া ইউনিভার্সিটি মসজিদ, মালয়েশিয়া।

নিথর নিস্তব্ধ এক প্রশান্তিময় রাত। শহরের কোলাহল থেকে দূরের এই ক্যাম্পাসে ঈদের ছুটি শুরু হয়ে যাওয়ায় ছাত্র ছাত্রীর আনাগোনা কম। গ্রীষ্মের রাত যেমন হয়, সারাদিন গরমের পর শান্ত আরামদায়ক। ঠিক তেমন পরিবেশ বিরাজমান। রাত্রির ঘন অন্ধকারে ছেয়ে যায়নি চারদিক বরং মিষ্টি লালচে আলো আকাশজুড়ে, সম্ভবত রাস্তার বাতির আলোচ্ছটার জন্য লালাভ লাগছে আকাশ। ওদিকে মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে যাচ্ছে, গাছের পাতারা ঝিরঝির করে দুলছে।

মসজিদের বাইরে আকাশ পানে চেয়ে অনেকেই ভাবছেন, আজ কি সেই মহিমান্বিত রাত, আজ কি অদৃশ্যজগত তোলপাড় হয়ে যায়ে যাচ্ছে ফেরেশতাদের আনাগোনায়! পায়ের তলের নুড়ি পাথরের চেয়েও অধিক সংখ্যক মালাইকাগণ কি ঘিরে রেখেছেন আমাদের! আজ কি শান্তি আর শান্তি বর্ষিত হচ্ছে এ ধরণীর বুকে!

বেজোড় রাতগুলোয় একই আকাংখ্যায় বুক বাঁধে সিয়ামকারীগণ। এখনো মনে পরে বিগত হয়ে যাওয়া অনেক রামাদানের কথা। যখন শেষ দশকে লায়লাতুল কদরের আশায়, বৃষ্টিপাতের অপেক্ষায় থাকতাম। কোন দিন সূর্যের আলো নিষ্প্রভ লাগলে মনে হত, তবে কি আগের রাতই ছিল সেই মহিমান্বিত রজনী, যার মূল্য হাজার মাসের চেয়ে উত্তম! কোন রাত যদি পুরোটা ঘুমে কেটে যেত, পরদিন আফসোসের শেষ থাকতো না। বার বার মনে হতো ইশ, লায়লাতুল কদর কি হতছাড়া হয়ে গেলো! ছোট্ট কোন দুয়াও করতে পারলাম না।

শৈশবে খালাকে দেখতাম রামাদানের শেষ দশক সালাতের মুসাল্লায় কাটাতেন। এত দীর্ঘ সেজদা দিতেন, মাঝে মাঝে মনে হতো উঠছে না কেন! নানি বলতেন পানের বিড়ার মত পরে আছে মাটিতে। তিনি সেহেরির জন্যেও খুব একটা সময় ব্যয় করতেন না। ফজরের আযানের আগ মুহুর্তে কোনমতে কয়েক ঢোঁকে খাওয়া যায় এমন কিছু গলধঃকরন করে, ওটুকু দিয়েই রোজা রাখতেন। খালা এত কি চাইতেন আল্লাহ্ এঁর কাছে, জানি না। আমরা ছোট দুই ভাই বোন তার দেখাদেখি জায়নামাজ নিয়ে আসতাম, রাত জাগার চেষ্টা করে পরদিন সারাদিন ঝিমাতাম। এখনো রামাদানের রাতে সেইসব দিনের কথা খুব মনে পরে। আজ এতো বছর পর কে কোথায় ছড়িয়ে পরেছি!

প্রতিবারের মতোন এবারেও রামাদান এসে আবার চলেও যাচ্ছে। এ বছরের জন্য আজই শেষ সুযোগ। ভোর হতে বেশি বাকি নেই, বড়জোর ঘণ্টা দুই বাকি। সমগ্র বিশ্বে অসংখ্য মুসলিম জায়নামাজে বসে আছেন, তিলাওয়াতে, সেজদায়, দুয়ায়, ক্রন্দনে, অলংকৃত করছেন অমূল্য এ রাত্রি।

গভীর রাত পর্যন্ত ইবাদত করে ক্লান্ত দেহে মসজিদের কার্পেটে ইতিকাফকারীগণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে আছেন। বড় এক পর্দা দিয়ে পুরুষ ও মহিলাদের অংশ আলাদা করা। এ মসজিদে এসি নেই, বড় বড় পেডেস্ট্রাল ফ্যান আছে প্রচুর। তাই গরম অনুভূত হয় না। অনেকে ফ্যানের আশে পাশে শুয়ে আছে। ঘর থেকে যে যার মত বালিশ চাদর নিয়ে এসেছে। এক কোনায় একটি অল্পবয়েসী মেয়ে একাগ্রচিত্তে দুয়ায় মগ্ন, সে মনে হয় সারা রাত ঘুমায় নি। আল্লাহ্ এর থেকে মন প্রান দিয়ে কি যেন চাচ্ছে। পরম করুনাময় যেন তার দুয়া কবুল করেন।

ছুটি শুরু হওয়াতে ইতিকাফকারীর সংখ্যা বেশ কম। বিদেশী ছাত্রছাত্রী যাদের যাওয়ার যায়গা নেই, তাদের কেউ কেউ এখনো আছেন। অল্প কিছু মালয় ছাত্রছাত্রীও আছেন।

আমাদের দেশে ‘ইতিকাফ’ শব্দটি শুনলেই চোখে ভাসে অবসরপ্রাপ্ত, বৃদ্ধ, দাদা-নানা হয়ে গেছেন এমন ব্যাক্তিদের কথা। বাংলাদেশে তরুন, ছাত্র, চাকরিজীবী, গৃহবধু অথবা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে পুরো পরিবারসহ কেও কি ইতিকাফ করেন?

মালয়শিয়া সহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে রামদানের শেষ দশক প্রচুর মুসুল্লি মসজিদে অবস্থান করেন। পুরো দশ দিন না পারলেও ভেংগে ভেংগে থাকেন, রাতে থাকতে না পারলে দিনের কিছু অংশ হলেও মসজিদে একান্তে নিরিবিলিতে রবের ইবাদতে সময় গুজার করেন।

যেমন আমার পাশে একজন ইয়েমেনি মহিলা তার স্বামী সন্তান সহ ইতিকাফে বসেছেন শেষ দশ দিনের জন্য। তাদের সন্তানদের বয়স সাত থেকে দশের বেশি নয়। মহিলাকে যত দেখেছি তত মুগ্ধ হয়েছি। যতক্ষণ জাগ্রত থাকতে পেরেছেন, এক নাগাড়ে মুখস্থ কুরআন তিলাওয়াত করেছেন। একটা মুসহাফ হাতে রেখেছেন, যদি কখনো ভুলে যান, চোখ বুলিয়ে নেবার জন্য।

আরো কত রকম মানুষকে যে দেখেছি ইতিকাফ করতে। বয়স্কদের তূলনায় তরুণদের চোখে পড়েছে বেশি। এদেশে পুরুষদের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মহিলারাও মসজিদে রাত্রিযাপন করেন।
তারাবী, তাহাজ্জুদ আর ফজরের সালাতেও মহিলারা আসেন অংশগ্রহণ করতে। দেড় দু মাসের শিশু নিয়েও জামাতে সালাত পড়তে দেখেছি মহিলাদের। জায়নামাজের পাশে বাচ্চাদের শুইয়ে রেখে, খেলতে দিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন তারা। বাচ্চারা তেমন দুষ্টুমি করতো না, আর ছুটোছুটি করলেও বড়রা কখনো বিরক্ত প্রকাশ করতেন না।

এক বোনকে দেখলাম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তাহাজ্জুদ পড়তে এসেছেন। অসুস্থ, বয়স্ক, শিশু, বালক, তরুণ থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষের আনাগোণা ছিল মসজিদে। জামাতে সালাত পরতে আসা এ দেশের সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ।

ওদিকে আমাদের দেশে ইফতার আর সেহেরি তৈরি করতে করতে মা বোনদের রামাদান কেটে যায়। আর মালয়শিয়ায় রোজার সময় সারা মাস বাজার ও রান্না না করেও লোকে দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারে। সরকার ও বড় বড় সংস্থার ফান্ডিং থেকে মসজিদে মসজিদে প্রতিদিন আয়োজন করা হয় ইফতার ও সেহেরির। ধনী গরীব নির্বিশেষে এক কাতারে বসে সবাই খাওয়া দাওয়া করে।

যেমন পুত্রজায়ার এ মসজিদের কথাই বলি। পরিচিত এক ভাই এখানকার ছাত্র হওয়াতে বেশ ক’বার আসার সুযোগ হয়েছিল। মাগরিবের আযান দেবার আগে সেখানে বিশাল বিশাল থালা ভর্তি বিরিয়ানি সামনে নিয়ে গোল হয়ে বসে যেত সবাই। সাথে থাকতো অফুরন্ত শরবত, পানি, ঠান্ডা চা। খাওয়া শেষে জামাতে সালাত আদায় করে, কেও নফল ইবাদত করতো, আবার অনেকে বিশ্রাম নিত বা বাড়ি ফিরে যেত। ফের ইশার সময় আসতো সবাই।

তারাবীর আট রাকাত হবার পর কেক, পিঠা, পোলাও/বিরানী, ডোনাট, হালুয়া একেক সময় একেক রকম খাবার পরিবেশন করা হত। যারা আট রাকাত তারাবী পড়েন, তারা তখন রাতের খাওয়া খেয়ে বাড়ি ফিরতেন। অনেককে দেখতাম বাটি ভরে বাসার অন্যদের জন্য নিয়েও যাচ্ছেন। এবং এতে কেউ কিছু মনে করতেন না।

তারাবী শেষ করে ভরপেটে খানাপিনা হত। মাঝে মাঝে বহুজাতিক কোম্পানিরা তাদের পক্ষ থেকে ফ্রি খাবার দিয়ে যেত। যেমন একদিন ম্যাকডোনাল্ড কোম্পানি থেকে দিয়ে গেল বার্গার আর ফ্রুট জুস। খাবার খেতে খেতে অস্থির অবস্থা হত এক একজনের। সেহেরির আগে আরেক দফা মজাদার খাবার আসতো। সেই সাথে পুরো রাত জুড়ে সরবরাহ থাকতো চা ও পানির।

এখানে রামাদানের প্রতিটি রাত যেন এক একটি উৎসব এর রাত।

এবারের রামাদানে অসুস্থতার দরুণ তেমন কিছুই করতে পারি নি। মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে সেজদা দেয়াও সম্ভব ছিল না আমার জন্য। নিজে ঠিকমতো ইবাদত করতে না পারলেও, অন্য ইবাদতকারিদের সংগ পাবার লোভ সংবরণ করতে পারি নি। তাই শেষ দশকের যেদিনগুলোতে আবু আব্দুল্লাহ অফিসের ছুটি পেতো, তার আগের দিন সন্ধ্যায় আমরা পুত্রজায়ার এ মসজিদে চলে আসার চেষ্টা করতাম। আর ফজরের আযানের পর বাসায় চলে যেতাম।

সমস্ত প্রশংসা সুমহান মালিকের, যিনি তাঁর বান্দাকে এমন অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দিয়েছেন। খালেস দিলে যারা ইবাদত করেন, তাদের পাশে নিজের নগন্যতা অনুভব করার শক্তি দিয়েছেন।

অন্যন্য রাতের ন্যায় উনত্রিশ রামাদানের রাতেও সুললিত কন্ঠের তারাবীতে সকলের সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যাচ্ছিলো। সেদিন তিলাওয়াত করা হচ্ছিলো কুরআনের শেষ পারা। তারাবী শেষে ইতিকাফকারীগণ যার যার স্থানে বসে ব্যাক্তিগত নফল ইবাদতে মগ্ন হয়ে গেলেন।

একদিকে যেমন একজন তরুনী ল্যাপটপ এ কুরআন এর আয়াত নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তেমন অন্যদিকে অনেকে রাকাতের পর রাকাত নফল সালাত আদায় করছিলেন। কিছু মুসুল্লি ব্যস্ত ছিলেন অনুচ্চ স্বরের তিলাওয়াতে। আবার অনেকে শেষ রাতে বেশি করে কিয়াম করার জন্য নিয়ে নিচ্ছিলেন অল্প কিছুক্ষণের বিশ্রাম।

******** ********** ********* ****** *********

ভোর রাত চারটা

মসজিদের বেশির ভাগ আলো নেভানো। আলো আঁধারির মাঝে মাইকে দৃপ্ত কন্ঠে ইকামত দেয়া হল। কিয়ামুল লাইলের জামাত হবে। জামাত শুরুর আগে অনেকে অজু করে এলেন। আশে পাশের এলাকা থেকে নানা বয়সের নারী পুরুষ এসে জড়ো হতে লাগলেন এ বছরের রামাদানের শেষ রাত্রির কিয়ামে।

সামনের দিকের সারিতে পুরুষেরা দাঁড়িয়ে পরলেন। কিছুটা জায়গা ফাঁকা রেখে জামাতে শরীক হলেন শ্বেতশুভ্র আজানুলম্বিত পোষাকে আবৃত মহিলারাও। মালয় মেয়েরা সালাতের সময় সবাই একরকম পোষাক পরিধান করেন। দূর থেকে দেখলে তাদের মনে হয় বেলীফুলের গুচ্ছ। আর মধ্যরাতের আলো আঁধারির মাঝে মনে হয়, অন্য জগত থেকে হুর পরীরা নেমে এসেছেন।

অল্পসময়ের ভেতর গমগমে কন্ঠের তিলাওয়াত দিয়ে সালাত শুরু হল। অপূর্ব কন্ঠের সূরের মূর্ছনায় কেমন যেনো একটা অপার্থিব পরিবেশের সৃষ্টি হল। মসজিদের মৃদু আলোয় রাতের অন্ধকার পুরোপুরি দূর না হয়ে, বিরাজমান ছিল ইবাদতের অনুকূল ভাবগাম্ভীর্য পূর্ণ পরিবেশ। অদ্ভুত ও সম্পূর্ণ অপরিচিত এ অভিজ্ঞতা যে নিদারুণ মুগ্ধতার জন্ম দিয়েছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

জামাতে কিছুক্ষন কিয়াম হবার পর, সবাই আবার ব্যক্তিগত ইবাদতে ফিরে গেলেন। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সালাত ও তিলাওয়াতে রাত্রির শেষ কিছু মুহুর্ত অতিবাহিত করতে লাগলেন ইতিকাফকারীগণ।

এর মাঝে ছোট পিক আপে করে সুহুর এর খাবার চলে এল। মসজিদের বারান্দার টেবিলে স্তুপাকৃতিতে থরে থরে সাজানো হয়ে গেল খাবারের বাক্স, যে যার মত সুহুর খেয়ে নিল, সাথে ছিল চা আর পানি।

ফজরের আযান দিয়ে শেষ হয়ে গেলো রামাদানের শেষ রোজার সুহুর। পরদিন ঈদ। শুরু হলো আরো এক বছরের অপেক্ষা। ভালোবাসার রামাদানের জন্য অপেক্ষা। লাইলাতুল কদরের তালাশের জন্য দিন গোণা।

——- ————– ————– ————– ————– ——-

মহিমান্বিত রজনীর সন্ধানে 
উম্ম আবদুল্লাহ

জুন ০২, ২০১৯ইং