রমাদানে আত্মশুদ্ধি

দাদার সাথে কাটানো সময়গুলো ইদানীং বেশিই মিস করছে আরিনা।

প্রতিবছর যখনই দাদার বাড়ি যেত, তখন দাদা তাকে অনেক গল্প শুনাতেন। যার সবগুলোতেই বিশেষ কিছু মোরালিটি থাকত! সেই কথনগুলো কানে লেগে থাকত আরিনার। কিন্তু, শহরে এসে আবার সেই বান্ধবীগুলো আর কিছু জাস্টফ্রেন্ডের আড্ডা আর কথোপকথনে গুলিয়ে যেত সব। সেই তথাকথিত আধুনিক গান, মিউজিক পার্টি…এসবে হারিয়ে যেত সে।

কিন্তু, নাহ্! দাদার মৃত্যুর পর আজ দেড় বছর হলো প্রায়। যখনি একাকী থাকে তখনই মনে পড়ে দাদার সেই বাণীগুলো। আড্ডাগুলোও আর ভালো লাগছে না আরিনার। রমাদানের ২০ দিন পার হয়ে গেল। এবার সবগুলো রোজা রাখার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়েছে সে। দাদা বলেছিলেন, রোজা শব্দের আরবি হলো সাওম। আর সাওম অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা, সংযত থাকা, সংযত রাখা, আত্মসংযম ইত্যাদি। দাদা আরো বলেছিলেন, রোজাতে দো’আ কবুল হয়, আর এটি এমন এক ইবাদত যার প্রতিদান আল্লাহ্ নিজে দিবেন এবং এসময়টা নাকি শয়তানকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়!

তেমন কিছুই জানতো না সে। বাবা- মা র কথাও তেমন শুনতে চাইত না। কিন্তু দাদার কথাগুলোতে কী যেন এক টান পেতো সে।

মা শা আল্লাহ্, এখন সে জানে, শিখেছেও কিছু। দাদার বলা কথাগুলো হাদীস গ্রন্থেও পেয়ে গেলো সে।

“যখন রমাদান আসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। শয়তানকে শিকল পড়িয়ে দেয়া হয়।” [বুখারি ও মুসলিম]

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লামﷺ বলেন, “(রমাদানের) প্রতি দিন ও রাতে (জাহান্নাম থেকে) আল্লাহর কাছে বহু বান্দা মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাদের প্রত্যেক বান্দার দো’আ কবুল হয়ে থাকে (যা সে রমাদান মাসে করে থাকে)।”

[সহীহ সনদে ইমাম আহমদ কতৃক বর্ণিত, হাদীস নং ৭৪৫০]

ইবরাহীম ইবনু মূসা (রহ) আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেন,
আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তাঁর নিজের জন্য, কিন্তু সিয়াম আমার জন্য, তাই আমিই এর প্রতিদান দেব। সিয়াম ঢাল স্বরূপ।

[গ্রন্থঃ সহীহ বুখারী (ইফাঃ)
অধ্যায়ঃ ২৩/ সাওম বা রোজা (كتاب الصوم)
হাদিস নম্বরঃ ১৭৮৩ এর খন্ডাংশ
হাদিসের মানঃ সহিহ]

এবার একদম রোজার শুরু থেকেই সে কুরআন তিলাওয়াত, যিকর্, ইস্তেগফার, দান-খয়রাত এসবে মনোযোগ দিল। রমাদানের ঐ বিশদিনেই আল্লাহর অশেষ রহমত অনুভব করতে লাগলো সে। নিজের মাঝে এক অন্য আরিনাকে আবিষ্কার করলো মেয়েটা!
এরই মাঝে আরিনা বেশ কজন স্কলারের লেকচার পেয়ে গেল ইউটিউব ঘেটে। অনলাইননে ড. আবু আমিনা বিলাল ফিলিপ্সের হৃদয়স্পর্শী বক্তব্যগুলোর কিছুও পেয়ে গিয়েছিল। আলহামদুলিল্লাহ্। তাঁর একটি কথা তার মনে ধরে বেশ।সেটি হলো,
‘জীবন একটি যুদ্ধক্ষেত্র। আর জান্নাত হলো লক্ষ্য। প্রতিনিয়ত আপনার ও শয়তানের মাঝে সংগ্রাম চলছে। যে জিতে যাবে সেই বীর।’

আলহামদুলিল্লাহ্। শয়তানের ওয়াসওয়াসার সাথে সংগ্রাম করে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে সে দ্বীনের সঠিক পথের সন্ধানে।

রমাজানের বরকতময় সময়গুলো আত্মার এক ব্যাপক শুদ্ধিতে ভরে উঠলো। আরিনার মন আজ আল্লাহর দেওয়া প্রফুল্লতায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো। পর্দার বিষয়েও সচেতন হয়েছে সে। তবে, আরিনা কিন্তু তার দাদার জন্য দো’আ করতে ভুলে না কখনো। ইসলাম সম্পর্কে জানা ও মানার আগ্রহ নিয়ে এভাবেই দিন চলতে লাগলো তার।

_আসলে আল্লাহর রহমতের বিষয়গুলো এমনই। হঠাৎ করেই কখন যে কার মাঝে হিদায়াতের মুক্তো চলে আসবে তা কেবল রহমানুর রহীম মহান আল্লাহ তা’লাই জানেন। তাঁর দান করা হিদায়াতের নূরেই আলোকিত হয়ে ওঠে আমাদের মতো গুনাহগার বান্দাদের হৃদয়।

মুআবিয়া ইবন সুফিয়ান রাদিআল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ ﷺ- বলেছেন,
আল্লাহ যার কল্যাণ চান তিনি তাকে দ্বীনের বিষয়ে গভীর ইলম দান করেন।’
[সহীহ বুখারী: ৭৩১২]

আর রমাদানের বিষয়ে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেন,

﴿شَهۡرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِيٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلۡقُرۡءَانُ هُدٗى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٖ مِّنَ ٱلۡهُدَىٰ وَٱلۡفُرۡقَانِۚ﴾ [البقرة: 185]
‘রমাদান হলো সেই মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য হিদায়াত এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শন, আর ন্যায়-অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।’ [সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৮৫]

আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি সেকেন্ড দ্বীনের পথে কাজে লাগানো প্রয়োজন। আর, রমাদান সে তো এক বরকতময় মাস। এ মাসেই আছে এক কল্যাণকর রজনী, ‘লাইলাতুল ক্বদর’।

আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, নবী করীম ﷺ- ইশরাদ করেছেন, ” যে ঈমান ও বিশ্বাস সহকারে সওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদরে নামায পড়ে এবং রমাদানের রোযা রাখবে,তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” (বুখারী,১/৩৩৪)

তাই, এই মাস পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক আমাদের আত্মশুদ্ধিতে।আর, মহান রবের করুণায় এই আত্মশুদ্ধিতে মহান রবের যিকর্, ইস্তেগফার ও অন্যান্য ইবাদতের মাধ্যমে আত্মার পরিচর্যা অব্যাহত থাক মৃত্যু অবধি।

মহান রব কবুল করে নিন সকল আরাদ্ধাকে’ তাঁর রহমতের বান্দাদের মাঝে। আমীন আল্লাহুম্মা আমীন ! ইয়া রব্বী!

“আর ‘রাহমান’ -এর বান্দা তারাই, যারা যমীনে অত্যন্ত বিনম্রভাবে চলাফেরা করে এবং যখন জাহেল ব্যাক্তিরা তাদেরকে (অশালীন ভাষায়) সম্বোধন করে, তখন তারা বলে, ‘সালাম’” [ সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৬৩]

…………..

রমাদানে আত্মশুদ্ধি
ফারহানা শহীদ

২০/০৫/১৯