রমাদান – আড়ম্বরের আড়ালে

বাসা থেকে যখন বের হয় তিথি, ঘড়ির বড় কাঁটা প্রায় তখন এগারোটায়। মাথার উপর গনগনে সূর্য। বেশ গরম পড়বে মনে হচ্ছে আজ। মধ্যরাতে প্রথম রমাদানের সেহেরী করে ফজর পড়ে ঘুমাতে দেরী করে ফেলায় বেশ বেলা করে উঠলো তিথি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে গেলো তার। স্টুডেন্ট কে বলেছে দশটায় আসবে পড়াতে। এখনই দশটার বেশী বাজে। মাও ডেকে তুললোনা তাকে ভেবে ভ্রু কুঁচকে ফেললো সে। কথা দিয়ে কথা না রাখাটা বেশ অপছন্দের তিথির। যা হোক, আজ রমাদানের প্রথম দিন। কাল থেকে সব টাইমলি করার চেষ্টা করবে ভেবে নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলো সে।

বের হয়েই রাস্তার অপর পাশের রেস্টুরেন্টের দিকে চোখ পড়লো তিথির। সাদা কাপড়ের বিশাল ব্যানার দিয়ে পুরো দোকানটা ঢাকা। মানুষের কেবল পায়ের দিকটা দেখা যাচ্ছে । ব্যানারে কালো রং দিয়ে বড় বড় করে লেখা “আসন্ন নির্বাচনে ঢাকা – ৯ (খিলগাঁও সবুজবাগ) আসনে পদপার্থী অমুক কে কুলা মার্কায় ভোট দিন”। রমাদান শুরু হয়ে গেলেই সব খাবারের দোকানগুলোতে এরকম বাহারী পর্দা দেখা যায়। ভাবতে ভাবতে একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দ্রুত পা চালালো তিথি।

গলির মোড়ে দেখা হলো নোভা’পুর সাথে। নোভা’পু ওদের তিন তলায় থাকে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে একাউন্টিং এ অনার্সের শেষ বর্ষের ছাত্রী। শুনেছে খুব ভালো নাকি একাউন্টিংয়ে। তিথি নিজেও কমার্সের ছাত্রী। এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়ে এখন ঝাড়া হাত পা। টিউশনি টা তাই বেশ এনজয় করছে এখন সে। নোভাপু রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আজ নোভাপু কে অন্যরকম লাগছে। মুখে ভারী কোন মেকাপ নেই, মাথায় ওড়না দিয়ে বড় ঘোমটা টানা। রমাদান ইফেক্ট বুঝতে দেরী হলো না তিথির। নোভাপুর সাথে সালাম বিনিময় করে গন্তব্যে পা বাড়ালো সে আবার।

যেতে যেতে মনে পড়লো বান্ধবী রুমকির কথা । বিকালে রুমকির বাসায় যাবে বলে মনস্থির করেছে ও। যেভাবেই হোক রুমকিকে বোঝাবে রমাদানে রোযা রেখে মায়ের সাথে মিথ্যা বলে বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করাটা বড় অন্যায় করে ফেলছে সে। একে তো হারাম রিলেশনশিপ তার উপর রোযা রেখে মিথ্যা বলা!! রুমকি কে বোঝানোর জন্য দুটি হাদীসও সে প্রস্তুত করে রেখেছে। একটা হারাম রিলেশনশীপের জন্য তওবা করে গুনাহ মাফ চাওয়া আর মিথ্যা বর্জন করা।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

“ যে ব্যাক্তি রমাদান মাস পেলো অথচ নিজের গুনাহ মাফ করাতে পারলো না, সেই ব্যাক্তির নাক ধূলোয় ধূসরিত (ধ্বংস) হোক।…” [তিরমিযী, ৩৫৪৫। আহমাদ, ৭৪৪৪। ইবনে হীব্বান, ৯০৮। ইবনে খুযায়মাহ, ১৮৮৮]

“যে মিথ্যা বলা ও অজ্ঞতামূলক কর্ম পরিত্যাগ করলো না, অথচ খানা-পিনা পরিহার করে রোযা রাখলো – এধরণের রোযা আল্লাহর নিটক মূল্যহীন। [বুখারী, ১৮০৪, ১৯০৩, ৬০৭৫]

পড়তে বসে কিছুক্ষণ পরপর হাই তুলছে সূচী। সূচী তিথির ছাত্রী। ক্লাস এইটে পড়ে। কাল শনিবার সূচীর গনিত পরীক্ষা। গনিতে সে মোটামুটি ভালো। খুব বেশি পরিশ্রম করতে হয় না তিথির।

“রোযা রেখেছো সুচী?” – তিথির প্রশ্নে আচমকা সম্বিত ফিরে পেয়ে সূচী না বোধক মাথা নাড়লো। বললো, কালকে অংক পরীক্ষা। মা অংকের ব্যাপারে বেশ সিরিয়াস। হিসাব মিললেই ফুল মার্কস। মা-ই বললো, রোযা রাখার দরকার নেই। শরীর খারাপ করবে। তারচেয়ে বরং খেয়ে-দেয়ে ভালো করে প্রিপারেশন নিতে। তিথি কথা বাড়ালো না আর।

রান্নাঘর থেকে সূচীর মায়ের চিল্লাচিল্লি শোনা যাচ্ছে যথারীতি। বাসার কাজে সাহায্যকারী বুয়ার সাথে প্রায়ই গজগজ করতে থাকে সূচীর মা। আজকেও ব্যতিক্রম না। রমাদানের প্রথম দিন তিথির মতো বুয়ারও আসতে আসতে দেরী হয়ে গেলো বলে এই শব্দ অত্যাচার!! মনটা খারাপ হয়ে গেলো তিথির। মহিলা নিজের মেয়েকে রোযা রাখতে দিচ্ছে না, বুয়া রোযা রেখে বাসা বাড়িতে কাজ করে দুটো পয়সার জন্য; তার প্রতিও কোন রহম করলো না মহিলা । তিথির সেই হাদীসটি মনে পড়লো ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ
“রোযা জাহান্নাম হতে ঢাল স্বরূপ। সুতরাং তোমাদের কেউ যখন রোযা রাখবে, তখন সে যেন বাড়াবাড়ি না করে। যদি কোন মানুষ তার উপর বাড়িবাড়ি করে বা চড়াও হয়, তবুও সে তাকে গালিগালাজ করবে না। বরং সে বলবে, ‘আমি রোযাদার।” [বুখারী, ১৮৯৪। মুসলিম, ১১৫১]

সূচীর মা মেয়ের অংকের হিসাব মিললেই ফুল মার্কস নিয়ে যতটা সিরিয়াস, তার কিছুটাও আখিরাতের হিসাব মিলানো নিয়ে আছে কি? তিথি মনে মনে ভাবতে লাগলো নোভাপুর কথাও। সারা বছর মুখে ভারী মেকাপ দিয়ে চুল ছেড়ে বুকের ওড়না সাইডে ফেলে ইউনিভার্সিটি যায়। অথচ রমাদান এলে সবকিছুতেই খনিক বিরতি দিয়ে যেন আল্লাহকে যেন বিরাট ফেভার করে ফেলা হয়। দুনিয়ায় হিসাব বিজ্ঞানে ফাইনাল একাউন্ট মিলাতে দক্ষ হয়েও যদি নোভাপু আখিরাতের ফাইনাল একাউন্টে কাঁচা থেকে যায়, তবে ক্ষতিটা তো তারই হবে ।

টিউশনি শেষ করে বের হয়ে মন ভালো হয়ে গেলো তিথির। রমাদানের প্রথম জুম’আ আজ। সব মুসুল্লিরা পায়ে হেঁটে মসজিদের দিকে যাচ্ছে। দ্রুত বাসার দিকে রওনা হলো তিথি। বাসায় গিয়ে গোসল করে নামায শেষে মায়ের সাথে কুরআন নিয়ে বসার কথা তার। মা আর তিথির রমাদান রেজ্যুলেশন হলো কুরআন বুঝে বুঝে পড়া ও খতম দেওয়া। মায়ের সাথে এই সময় টা খুব প্রিয় তিথির।

হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেঘ জমেছে। কিছুক্ষণ আগেও মাথার উপর সূর্যের খরতাপ খেলা করছিলো। বোরকার ভেতরে যেন একটা মৃদু ঠান্ডা বাতাস অনুভব করলো তিথি।

রোযাদারদের রোযা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার জন্য বলেই রমাদানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা উনার বিশেষ রহমত ঢেলে দেন তাঁর বান্দাদের প্রতি। চারিদিকে কেমন যেন একটা পবিত্র পবিত্র ভাব টের পেলো তিথি। আনন্দে চোখে পানি এসে গেলো তার। মনে মনে বলে উঠলো
‘“আহলান… আহলান ইয়া রামাদান!”

রমাদান – আড়ম্বরের আড়ালে
নুসরাত জাহান

মে ২৪, ২০১৮ইং