রামাদানের প্রস্তুতি

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

আলহামদুলিল্লাহ্‌ বছর ঘুরে আবার আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে বরকতময় মাস, রামাদান। আমরা অনেকেই আছি যারা প্রতি বার অনেক কিছুই করার কথা ভাবি, কিন্তু সঠিক পরিকল্পনার অভাবে সেসব আর করা হয়ে উঠে না।

রামাদানে আমাদের করণীয় কার্যাবলী কে মাথায় রেখে এ মাসের প্ল্যানিং কে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়।

১) পরিচ্ছন্নতা ২) ইবাদত ৩) দোয়া এবং ৪) সামাজিক দায়িত্ব।

১) পরিচ্ছন্নতাঃ

ক) গৃহ পরিষ্কারকরণ-

প্রথমেই নজর দেই বাসা পরিষ্কারের দিকে কারণ রামাদান আসার আগেই আমি যদি একটা ব্যাপক পরিষ্কার অভিযান চালাই তাহলে রামাদানে আসল কাজের দিকে মনোযোগ দেওয়াটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। আর এটা তো আমরা সবাই জানি পরিষ্কার ঘর মানে সুস্বাস্থ্য আর মনও ভাল থাকা।

খ) আত্মা পরিশুদ্ধিকরণ-

এবার প্রয়োজন আত্মিক পরিচ্ছন্নতা অভিযান, যা শুরু হয় তাকওয়া বাড়ানোর মাধ্যমে এবং এরই সাথে নিজের ভুলগুলো উপলব্ধির মাধ্যমে। তাই আত্মিক পরিচ্ছন্নতার জন্য আমাদের রামাদানের আগে বেশি করে আল্লাহর কাছে সাহায্য আর ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে যাতে করে শক্ত তাকওয়ার সাথে আমরা আমাদের রামাদান মাস শুরু করতে পারি।

গ)সামাজিক পরিচ্ছন্নতা অভিযান-

এরপরের কাজ হল সামাজিক ভাবে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো। রামাদানের দুই একদিন আগে থেকেই আমাদের চেষ্টা করতে হবে সামাজিক কিছু কাজ যেন আমরা বাদ দিতে পারি।

* যেমন অহেতুক গল্প না করা। কারণ অহেতুক গল্পের বেশিরভাগ বিষয় হিসেবে থাকে গীবত অথবা দুনিয়া সম্পর্কিত বিষয়বস্তু।

* সময়ের অপচয় না করা; কারণ সময় এমন একটা জিনিস যা হারালে আর ফিরে পাওয়া যায় না এবং এই জন্য শয়তানও সবসময় ব্যস্ত থাকে আমাদেরকে দিয়ে সময়কে অপচয় করানোর জন্য। সময়ের অপচয় স্বরূপ আমরা যা করে থাকি তা হল অতিরিক্ত ফেসবুক ব্যবহার করা, TV দেখা, অযথা বসে থাকা এমন অনেক কিছু। রামাদানে শয়তান বন্দি থাকলেও আমরা ঠিকই আমাদের অভ্যাসের দাস হিসেবে অথবা নিজের নফসের কাছে পরাজিত হয়ে সময়ের অপচয় করেই যাই।

নফসের কাছে পরাজিত হয়ে রামাদানে রোযা রেখে এমন কিছুই করা উচিত নয় যা আমাদের Ramadaan Reward কে কমিয়ে দেয়। আপনাদের কি মনে হয় টিভি দেখার মাধ্যমে অথবা অহেতুক গল্প করার মাধ্যমে কি আমার রামাদানের Reward বাড়বে নাকি কমে যাবে?

২) ইবাদতঃ

এবার আসি ইবাদতের প্রস্তুতিতে। আমাদের প্রস্তুতি এমন হতে হবে যেন এটাই আমার শেষ রামাদান। কারণ আমরা কেউ জানিনা পরবর্তী রামাদান আমরা পাবো কিনা। ঠিক তেমনি আশেপাশে তাকালে হয়ত আমরা দেখতে পাব গত রামাদানেও আমাদের পাশে ছিল এমন মানুষ হয়তো এই রামাদানে আর বেঁচে নেই। তাই প্রস্তুতি এমন হওয়া উচিত যেন নিজের আমলনামায় যোগ করার মত কিছু কাজ আমরা করতে পারি।

এই জন্য আমাদের লিস্ট করতে হবে কি কি ইবাদত আমরা করব এবং সাথে এটাও খেয়াল রাখতে হবে দু’একদিন পর পর লিস্ট চেক করে নিজেকে ঠিক করে নেওয়া। আর এই ইবাদত করার প্র্যাক্টিস শুরু করতে হবে রামাদানের আগেই যাতে রামাদানের শুরু থেকেই আমরা সফল ভাবে করতে পারি।

এক্ষেত্রে হতে পারে আমি নিজে করিনা এমন কোন ইবাদত শুরু করলাম (যেমন হয়ত আমি কুরআন পড়ি না বা পড়তে পারিনা তাহলে আমি তাই শুরু করতে পারি; অথবা আমার হয়ত কখনই তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া হয়নি আমি নাহয় তাই শুরু করলাম) অথবা আমি যেই ইবাদত গুলো করি তার আরো উন্নতি করলাম।

এটা হতে পারে আমরা নামাজে আরো মনোযোগী হতে পারি। যেমন সূরা ফাতিহা পড়ার সময় আরো মনোযোগী হওয়া; কারণ এই সূরা ফাতিহার প্রথম অংশ হল আল্লাহর প্রশংসা বা আল্লাহকে সম্মান জানানো আর শেষ অংশ হল মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা।

আর আমরা অনেকেই জানি না আমরা যখন নামাজে সূরা ফাতিহা পড়ি, মহান আল্লাহতায়ালা তখন প্রতিটা আয়াতের জবাব দেন (হাদীসে কুদসীতে আছে)। তাই আমাদের উচিত সূরা ফাতিহা সময় নিয়ে পড়া এবং প্রতিটা আয়াতের পর একটু থামা। তেমনি ভাবে আমরা চেষ্টা করতে পারি নামাজে পড়া প্রতিটা শব্দের বাংলা অর্থ জানার চেষ্টা করা।

আবার ইবাদতে লিস্টে প্রতিদিন কুরআন পড়ার ব্যাপারটাও রাখা উচিত। হোক সেটা এক আয়াত অথবা এক রুকু; কিন্তু আমাদের চেষ্টা থাকবে আমরা যেন প্রতিদিন কুরআন পড়ার অভ্যাস করতে পারি।

অন্যান্য সময়ে কুরআন পড়ার যে সওয়াব তার চেয়ে অনেক গুন বেশী সওয়াব রামাদানে পড়ার মধ্যে। এই সওয়াব হল প্রতিটা হরফ উচ্চারণের জন্য, আলহামদুলিল্লাহ্‌।

আমরা আরও একটা কাজ করতে পারি আর তা হল আমরা বাসার লোকজন মিলে সূরা মুখস্থ করার প্রতিযোগিতা দিতে পারি। আমরা পরিবারের সদস্যরা মিলে যার যার নিজের সাধ্যমত ২/৩ টা সূরা ঠিক করে তাজবীদ সহ মুখস্থ করতে পারি।

অথবা আমরা আল্লাহর ৯৯টা নাম শিখতে পারি।

আবু হুরাইরাহ্‌ রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

“আল্লাহ্‌ তা’আলার রয়েছে নিরানব্বইটি নাম, একশো থেকে একটি কম, যে এই নামগুলি মনে রাখবে, বুঝবে এবং উপলব্ধি করবে, সে জান্নাহ -তে যাবে।”

[বুখারি ৩.৫০:৮৯৪, মুসলিম ৩৫:৬৪৭৬, আত-তিরমধি ৫১.৮৭:৫১৩৮]

আমাদের মহানবীর (সাঃ) অনেক সুন্নাহ আছে যা হয়ত আমরা পালন করি না। এই রামাদানে আমরা চাইলে যেকোন একটা সুন্নাহ ঠিক করতে পারি যা আমরা আগে পালন করি নাই কিন্তু এখন থেকে পালনের চেষ্টা শুরু করতে পারি। এমন অনেক উপায় আছে যেভাবে আমরা আমাদের ইবাদতকে আরও সুন্দর করতে পারি অথবা আগে করিনি এমন ইবাদত অথবা সুন্নাহ্ এর প্র্যাকটিস করতে পারি।

৩) দোয়াঃ

আমি নিজে একসময় এমন ছিলাম যখন দোয়া চাওয়ার দিকে মনোযোগ দিতাম বেশী আর ইবাদত থাকত অনেকটাই অবহেলিত তাও দোয়া চাইতাম দুনিয়াবাদী সব দোয়া।

আলহামদুলিল্লাহ্‌ এখন বুঝতে শিখেছি ইবাদত ও দোয়ার ক্ষেত্রে কিভাবে ব্যালেন্স করতে হয়। দোয়ার লিষ্ট তিনভাগে ভাগ করা যায়। যেমন দুনিয়ার জন্য, আখিরাতের জন্য এবং আমাদের পারষ্পারিক সম্পর্কের জন্য।

অনেকেই হয়ত ভাবছেন লিস্ট করার কি প্রয়োজন। প্রয়োজনটা আমি আমার নিজের উদাহরণ দিয়ে বুঝাতে পারি। প্রতি রামাদানেই এমন হয়, অনেক কিছু আল্লাহর কাছে চাইব বলে ভেবে রাখি কিন্তু দেখা যায় আসল সময়ে (দোয়া কবুলের সময়) ভুলে যাই।

তাই লিস্ট করে রাখব আর দু’একদিন পর পর তা দেখে নিজেকে Reminder দিব। দুনিয়ার জন্য তো অনেক কিছুই চাওয়া যায়, তাই এই নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে বরং দেখা যাক আখিরাতের জন্য কি চাওয়া যায়।

যেমনঃ ঈমান বৃদ্ধির দোয়া, কথা, কাজে, মনে, আত্মায় সৌন্দর্য বৃদ্ধির দোয়া, কুরআন বোঝার জন্য আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা, ইসলামকে বোঝার দোয়া, শয়তানের প্ররোচনা থেকে মুক্তির দোয়া, কবরের আযাব থেকে মুক্তির দোয়া, সবসময় সব কাজে আল্লাহর উপর ভরসা করতে পারার দোয়া ইত্যাদি।

নিজের জীবিত অথবা মৃত বাবা-মা, আত্মীয় স্বজনের জন্য দোয়া চাইতে পারি। আর পারি আল্লাহর কাছে বেশি বেশি করে ক্ষমা প্রার্থনা করতে। আসলে চাওয়ার কোন শেষ যেমন নেই ঠিক তেমনি আল্লাহর কাছে চাইতে কার্পণ্য করারও কিছু নেই। কারণ আল্লাহর কাছে দেওয়ার জন্য কোন কিছুর কমতি নেই বরং আমরাই চাইতে পারিনা, এ আমাদেরই ব্যর্থতা।

সম্পর্কের জন্য দোয়া এই ভাগটা দেখে নিশ্চয় অনেকের ভ্রু কুচঁকে গিয়েছে কি হতে পারে তা ভেবে। এই ক্ষেত্রে দোয়া হল আমাদের প্রতিদিনের যাপিত সম্পর্ক গুলো যাতে ইসলামের আলোকে সুন্দর ও মধুরভাবে টিকে থাকে সেই দোয়া। এই সম্পর্কের মধ্যে আছে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, ভাই বোন সম্পর্ক, বাবা মায়ের সাথে সম্পর্ক, দ্বীনি ভাই বোনদের সাথে সম্পর্ক, নিজের অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের সাথে সম্পর্ক ইত্যাদি।

আরও থাকবে উম্মাহর জন্য দোয়া। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার মুসলিম ভাই বোনদের দুঃখ দূর করার জন্য দোয়া অথবা তাদের ভাল থাকার জন্য দোয়া। ঠিক তেমনি যারা গোমরাহীতে আছে তাদের হেদায়াতের জন্য দোয়া।

এমন হাজারো দোয়ার সাথে আমাদের মাথায় থাকতে হবে দোয়া কবুলের সময় জানার ব্যাপারে। দোয়া কবুলের ভাল সময় হল ইফতারের আগে, শেষ রাত, শুক্রবারের আসর আর মাগরিবের মাঝখানে আর রমজানের শেষ দশ দিন তো আছেই। আরেকটা কথা দোয়া করার পর আমরা অবশ্যই চেষ্টা করব মূসা (আঃ) দোয়াটা পড়ার। তা হলঃ

“Rabbi innee limaa anzalta ilayya min khayrin faqeer” O my Lord ! Truly I am in need of whatever good You bestow on me [ Surah Al-Qasas ,verse 24 ]

৪) সামাজিক প্রস্তুতিঃ

এবার আসি কি হবে আমার সামাজিক প্রস্তুতির লিস্ট সেই কথায়। শুরু করার আগে একটা হাদীস শেয়ার করতে চাই।

রাসুল (সা:) বলেছেন “কোন ব্যাক্তির প্রতিটি ভালো কাজ দশ থেকে সাতশো গুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। (মুসলিম)

এর অর্থ হল আমি এই মাসে যেই ভাল কাজটা করব তার সওয়াব কত গুন পর্যন্ত হতে পারে তা আল্লাহই ভালো জানেন, আলহামদুলিল্লাহ্‌। তাই আমরা একটা লিস্ট তৈরি করব সামাজিক ভাবে কি কি ভালকাজ আমরা করতে পারি।

যেই ভাল কাজটি হতে পারে মুসলিম কাউকে দেখে হেসে সালাম জানানো। সবচেয়ে ছোট সাদাকা হল হাসি আর যা দিতে আমাদের কোন কষ্টই করতে হয়না। আমরা অন্যকে ইফতারে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতে পারি কিন্তু নিয়্যতটা হবে অবশ্যই আল্লাহর সন্তুষ্টি। কখনো নিয়্যত এমন হওয়া উচিত না যে ‘সামাজিকতা রক্ষা’, ‘লোক দেখানো’, ‘আমাকে দাওয়াত দিয়েছে তাই আমিও দিব’ এই ধরনের।

আবার আমরা বিভিন্ন জনকল্যানমূলক কাজ করতে পারি। হয়তোবা খুব বড় করে না হোক ছোট হলেও আমরা চেষ্টা করতে পারি তা সম্পন্ন করার।

আমরা সালামের অভ্যাস শুরু করতে পারি। আমাদের সমাজে একটা চলন আছে আর তা হল শুধু বড়দেরকেই সালাম দেওয়া বাকীদের নয়। কিন্তু সালাম হল এমন এক জিনিস যা এক মুসলিম অপর মুসলিমকে দেখলেই দিবে হোক সে বড়, ছোট অথবা সমবয়সী।

আমরা চাইলে ছোট এক প্লেট খাবার নিয়ে মসজিদে চলে যেতে পারি ইফতার করতে যা আমাদের ভ্রাতৃত্ববোধ বাড়াবে। এছাড়াও বাচ্চাদের নিয়ে রামাদান বিষয়ক প্রোগ্রাম করতে পারি। মসজিদে তারাবীহ পড়তে যাওয়ার সময় মসজিদে আসা বাচ্চাদের জন্য কেন্ডি নিয়ে যেতে পারি। এভাবে আমরা যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী সামাজিক ভাল কাজের অথবা সুন্নাহর লিস্ট করতে পারি যা হয়ত আমাদের Reward অনেক গুন বাড়িয়ে দিতে পারে।

আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুক রামাদানের মাহাত্ম্য বুঝার এবং সেই অনুযায়ী আমল করার।

জাযাকাল্লাহু খায়রান।

————-
রামাদানের প্রস্তুতি
নাইমা আলমগীর

মে ১২, ২০১৮ইং