রুদ্ধদ্বার খুলে যাওয়ার মাস

সময়টা ছয় সাত বছর আগে। লিজার তখন ভার্সিটির ফাইনাল ইয়ার চলছে। যে সময়টা সাধারণত মেয়েদের জন্য বিয়ের পাত্র খোঁজা হয় সেই সময়েই লিজা হঠাত পরিবর্তিত হতে শুরু করল। পরিবর্তন হয়ে রীতিমত কালো বোরকাওয়ালী হুজুর হয়ে গেল!

বাসায় একদিকে তাকে নিয়ে চিন্তা কাদের সাথে মেশে, কোথায় যায় আবার আরেক দিকে চিন্তা এখন এই মেয়ের বিয়ে দিবে কার সাথে? এমন হুজুর ছেলে এখন কোথায় পাওয়া যাবে? শুধু হুজুর হলেই আবার চলবে না, ধর্মীয় বিষয়ে সঠিক জ্ঞান থাকা শিক্ষিত হুজুর হতে হবে। লে ঠ্যালা! হুজুর বলতে তো সবাই বোঝে দাঁড়ি টুপি থাকা আর টাকনুর উপর প্যান্ট পরা। লিজা আবার এর সাথে জুড়ে দিয়েছে “সঠিক ইসলামী জ্ঞান” থাকতে হবে। এমন কম্বিনেশনের হুজুরের সন্ধান কোথায় পাওয়া যাবে বাসার কেউ জানে না!

লিজার নতুন বোরকাওয়ালী বন্ধুরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলে এমন ছেলে নাকি নাই-ই। পরিচিত সার্কেল থেকে এক দুইটা প্রস্তাব যাও বা পাওয়া যায় তাতে “সঠিক জ্ঞান” মিললেও কুফুর দিকে থাকে বিশাল ব্যবধান।লিজাকে বোঝাতে চেষ্টা করা হয়, ছেলেকে তো ও ওর মনের মতো করে বিয়ের পরও তৈরি করে নিতে পারবে। কিভাবে বোঝাবে লিজা যে, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষকে কে এত সহজেই বদলে নেয়া যায়! কতই তো শোনা যায়, মেয়ে বিয়ের পরে পর্দা করবে, কিন্তু বিয়ের পর উলটা সোশ্যাল মিডিয়াতে বছরের পর বছর ধরে দেখা যায়, তাদের মেকাপ করা, বাহারি গয়নায় সাজা যুগল ছবি দেখা যায়। কত ছেলেরা বিয়ের আগে বলে “ইসলামী মাইন্ডেড” অথচ সোশ্যাল মিডিয়ায় বউকে নিয়ে তাদের আদিখ্যেতা যেকোন দ্বীন না বোঝা ছেলের মত সবাই দেখতে পায়।
লিজার বাসা থেকে পত্রিকার পাত্রী চাই কলামে খোঁজ করার কথা ভাবা হোল। সেখানে আছে নামাজী পাত্রের খোঁজ। কী আফসোসের কথা, নামাজ পড়লেই আমরা মানুষকে অনেক ধার্মিক ভাবি এখন! অথচ পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা মুসলিম পরিচয় ব্জায় রাখার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু নামাজী পাত্ররা আবার লিজার মতো কালো বোরকাওয়ালী চায়না। এটা তাদের কাছে একটু বেশি বেশিই!
বাবা-মার মুখে সার্বক্ষনিক চিন্তার ছায়া। পরিচিতদের থেকে আসা মানানসই প্রস্তাবগুলো মানা করে দিতে হচ্ছে মেয়ের অনিচ্ছার কারণে। নিজের ঘরের পরিবেশ লিজার এত দমবন্ধ করা লাগেনি কোনদিন। আল্লাহর বিশাল পৃথিবী যেন সংকুচিত হয়ে ছোট হয়ে এসেছে ওর কাছে। দ্বীনের পথে চলার প্রথমদিকের পরীক্ষাগুলোই বেশি কঠিন লাগে। কিন্তু এই সময়ই ঈমানের মিষ্টতা বেশি অনুভব করা যায়। জীবনে প্রথমবারের মতো সিজদায় চোখের পানি ফেলার স্বাদ পেয়েছিল এই সময় লিজা। এভাবেই আসলে আল্লাহ্‌ বান্দার মনকে এই দূর্গম পথে শুধু তাঁর ওপর তাওয়াক্কুল করে চলার জন্য একটু একটু করে তৈরি করে নেন।প্রতিটা কষত এখানে আল্লাহ্‌ এঁর নৈকট্য লাভের উপায়।, সুবহানাল্লাহ, বিনিময়ে থাকে হুধু শান্তি আর শান্তি।

একসময় নিজেই একটা অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলল এক জনপ্রিয় ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটে। অনলাইনের এক বড় সমস্যা হচ্ছে অপর পক্ষের মনোভাব বোঝা কঠিন। ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ থাকে বেশি। সামনাসামনি যা সহজেই মীমাংসিত হতে পারে অনলাইনে তা দিনের পর দিন বা মাসের পর মাস গড়াতে থাকে। লিজা বুঝতে পারে আল্লাহ্ ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন। আরও জানতে পারল ধর্মের আড়ালে হ্যাংলা ও ঠগ মানুষও লুকিয়ে আছে।

একসময় সেই সাইটের সাবস্ক্রিপশনও শেষ হয়ে গেল। লিজার জানা নেই এরপর সে কী করবে। আরও কয়েক মাস পার হয়ে গেল। রামাদান আসল। হঠাতই আবার একদিন সেই সাইট থেকে মেইল আসল। অবাক লিজা সাইটে ঢুকে দেখে রামাদান উপলক্ষে ওরা এক মাস ফ্রী সাবস্ক্রিপশন দিচ্ছে। “এত মাস পেরিয়ে গেল কিছু হয়নি, এই এক মাসে আর কী হবে!”, মনে মনে ভাবল লিজা।

রামাদানের মাঝামাঝির দিকে একটা প্রস্তাব আসল। অল্প কিছু দিনের মাঝেই অপর পক্ষ থেকে ওর বাসার সাথে কথা বলতে চাইল। এই প্রথম কোন প্রস্তাব অনলাইন থেকে বাস্তব জগতে বের হয়ে আসল ও এত দ্রুততার সাথে অগ্রসর হতে শুরু করল। ঈদের দিন সবাই সবার বাসায় যেতে পারে, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ঈদের দিনই পাত্রপক্ষ অনানুষ্ঠানিকভাবে লিজাদের বাসায় আসল।

আল্লাহ্, আল-ফাত্তাহ, বন্ধ দুয়ার খুলে দিলেন লিজার জন্য।
আল্লাহ্‌ আল-বাসিত, লিজার পৃথিবী আবারও প্রসারিত করে দিলেন তাঁর জন্য।
ইস্তেখারার পরিণামে এই প্রথম কোন প্রস্তাবে লিজার মন এত প্রশান্ত রইল। ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল ও যতটুকু চেয়েছিল, আল্লাহ্‌, আল-ওয়াহহাব, তার চেয়েও অনেক বেশি দিতে সক্ষম, সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ্‌ এভাবেই বান্দাকে সবর, শোকর ও তাওয়াক্কুল হতে শেখান। প্রতিটা অভিজ্ঞতা এখানে কোন অর্থ বহন করে।
বাকিটা ছিল শুধু সময়ের ব্যপার। মানুষ যাকে অলৌকিক বলে আল্লাহর কাছে সেটা শুধু ইচ্ছা করার ব্যপার। নিশ্চয়ই রামাদান দু’আ কবুলের মাস, রহমত নাযিল হওয়ার মাস!


রুদ্ধদ্বার খুলে যাওয়ার মাস
বিনতে খাজা

(১৩/০৫/১৯)