লক্ষ্যে অটল

১.
নিশির খুব মন খারাপ। তার দুহাত ভর্তি মেহেদি। মেহেদি তার খুব প্রিয়, তবু খুব কষ্টে কান্নার ইচ্ছা নিবারণ করে বসে আছে সে। মেহেদি ভরা হাত দিয়ে তো আর চোখের পানি মোছা যাবে না!

বাড়ির বাকি সবাই অবশ্য খুব খুশি। সবাই বলতে নিশির নিজের ও দুই চাচ্চুর পরিবার আর দাদা-দাদু। মহিলারা ব্যস্ত রান্নাঘরে, আর ছোট মেয়েরা এক রুমে জড় হয়ে মেহেদির আসর বসিয়েছে। আর পুরুষরা ড্রয়িং রুমে বসিয়েছে আড্ডা। হাসা হাসি, হৈচৈ আর সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণে পুরো বাড়ি মেতে আছে। সে সাথে পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসছে গানের কলি-

“ও মন, রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ…”

ঈদের দিন সবার মতো নিশিরও হাসি খুশি থাকার কথা। কিন্তু তবু বুকের ভিতর একটা চাপা কষ্ট তাকে হাসতে দিচ্ছে না। কারণটা আর কিছুই না, রামাদান চলে গেছে। প্রতিটা বছরের মত এবারও চোখের পলকে রামাদান চলে গেছে, কিন্তু নিজেকে মেরামত করা হয়নি যেন একটুও। কত কত প্ল্যান ছিল, কিছুই ঠিকমত করা হয়নি। লাইলাতুল কদরের সালাতটাও যেন মন মতো হয়নি। জান্নাতে নিজের জন্য বাড়ি গড়ে নেওয়ার যে বড় সুযোগটা দিয়েছিলেন আল্লাহ তাআলা, তা যেন হাত থেকে ফসকে গেল।

নিশির মনে পড়ে গেল মাইমুনা আপুর শেয়ার করা স্ট্যাটাসটার কথা, “ঈদ তো তাদের জন্য যারা রামাদানকে ঠিকমত কাজে লাগিয়েছে।”

কেন প্রতি বছর একই কাহিনী হয়? কেন রামাদান শেষে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না সে? আবার কি পাবে সুযোগ? দেখা হবে আবার রামাদানের সাথে?

এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে বাঁধভাঙা চোখের পানিগুলো নিশির হাতের কাঁচা মেহেদির নকশা নষ্ট করে দিলো, তা সে টেরই পেলো না!

২.
নিজের রুমে একা বসে অপেক্ষা করছে নিশি, অধীর আগ্রহের সঙ্গে। বুক ধুকপুক করছে। হঠাৎ যেন তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে উঠলো- এসে গেছে! ধীরে ধীরে হালকা হয়ে যাচ্ছে বুক, মাথাটাও খুলে যাচ্ছে। খুশিতে নাচছে মন। মুখের কোণায় হাসি নিয়ে অতঃপর নিশি বললো, “আহলান ওয়া সাহলান, ইয়া রামাদান!”

“নিশিপু! নতুন চাঁদ, নতুন চাঁদ!” -চিৎকার করে বলতে বলতে এক দৌড়ে বারান্দার দিকে ছুটে গেল নিশির ছোট ভাই। রামাদানের নতুন চাঁদকে অভ্যর্থনা জানানোর রেওয়াজ তাদের বাড়িতে প্রচলিত অনেক দিন ধরেই। নিশিও গিয়ে যোগ দিল সবার সাথে, নতুন চাঁদ দেখে পড়ার দুআটাও পড়ে নিলো।

তারপর নিশি ফিরে এল নিজ রুমে। দেয়ালে লাগানো রামাদান প্ল্যানারটার প্রথম পয়েন্টের পাশে একটা টিক দিল, যেখানে লেখা ছিল- “রামাদানের নতুন চাঁদ দেখে দুআ পড়া”।

এবারে রামাদানের আগে থেকেই সব প্ল্যান করে রেখেছে। গত রামাদানে ব্যর্থতার কারণ গুলো কি কি ছিল তা অনেক ভেবে বের করে নোট করে নিয়েছে। অতিরিক্ত খাওয়া আর ঘুম, এ দুটো কেই প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

তারাবীহর সালাতকে সুন্দর করতে রুকু আর সিজদাহর কিছু নতুন দুআ মুখস্ত করে নিয়েছে। প্রতিদিনই কুরআনের সাথে তাফসীর, হাদিস, সীরাহ পড়ার রুটিন তৈরি করেছে। শুধু নিজেই না, নিজের বান্ধবী আর পরিবারের সবাইকেও কি করে রামাদানে প্রোডাক্টিভ রাখা যায় সেই চিন্তাও করে রেখেছে!

বান্ধবীদের সাথে নিজের রামাদান রুটিন শেয়ার করেছে আর সকলের দৈনিক আপডেট দেয়া-নেয়ার জন্য একটা ফেসবুক গ্রূপ খুলেছে। বাসার মহিলাদের খুব সাধারণ ইফতার তৈরি করার গুরুত্ব বুঝিয়েছে। পুরুষদের মসজিদে গিয়ে সালাত পড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে বারবার বলেছে। ছোটদের নিয়ে সুন্দর সব কাগজে হাদিস আর বিভিন্ন দুআ লিখে বাসার দেয়াল সাজিয়েছে।

এছাড়াও বাড়ির বাচ্চা, বুড়ো সহ সবাইকে নিয়ে রামাদানে কুরআন পড়া, হিফজ করা, সীরাহ কুইজ ইত্যাদি আরো অনেক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। সবার ব্যাপক উদ্দীপনা দেখে, প্রতিটি প্রতিযোগিতার বিজয়ীর জন্য ঈদের দিন স্পেশাল উপহার থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে নিশির বাবা আর চাচ্চু! সবাই তাই এবার অনেক আগ্রহী রামাদান নিয়ে। নিশিও আশাবাদী, কারণ একা একা চলার থেকে সবাইকে পাশে নিয়ে আল্লাহর দেখানো পথে হাঁটা অধিকতর সহজ আর আনন্দের!

এবার আর রামাদান শেষে কাঁদতে চায় না নিশি। আর পুনরাবৃত্তি করতে চায় না ব্যর্থতার কাহিনী। ইন শা আল্লাহ এবার লক্ষ্যে পৌঁছাবেই, সবাইকে নিয়েই পৌঁছাবে!


লক্ষ্যে অটল
-বিনতে আব্দুল্লাহ

(১০/৫/২০১৯)