লা তাহযান

অবাক চোখে ছোট্ট মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল আনিকা। বার বার ঝাপসা হয়ে আসা চোখটা মুছে নিচ্ছে ও। জামিলও চোখ মুছছে সবার অগোচরে। প্রাইভেট ক্লিনিকের বারো নম্বর কেবিনে সিঙ্গেল একটি বেডে শুয়ে আছে আনিকা। বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে আছে সে ছোট্ট আর নিষ্পাপ মুখটির দিকে। এই সন্তান তার!!

পরিবারের অনেকেই সদ্য জন্ম নেয়া শিশুটিকে ঘিরে আছে। কত উচ্ছ্বাস তাদের। কপালে কারও হাতের মৃদু ছোঁয়া পেয়ে চোখ তুলে তাকাল আনিকা। জামিল ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। হাসতে গিয়ে আবারও চোখ ভিজে উঠল আনিকার। শিশুটির জোড় কান্নায় যেন কত বছর ব্যাপী জমে থাকা শূণ্যতা মুছে যেতে লাগল এই দম্পতির।

রিপোর্ট গুলো দেখে মৃদু কেশে নিয়ে ড.মালিকা বলেছিলেন- দেখুন, সন্তান স্রষ্টার দেয়া দান। তবে স্রষ্টা সবাইকে তা দেন না। আপনাদের তো অর্থ-সম্পদ রয়েছে৷ আপনারা চাইলেই কোন ইয়াতীম শিশুকে দত্তক নিতে পারেন।

-“তাহলে কি কোন আশা নেই ডক্টর?” গলা বুঁজে এসেছির আনিকার।

-“আল্লাহ্ ইব্রাহীম (আঃ) কে সন্তান দান করেছিলেন ৮০ বছর বয়সে। আমরা কি করে ভবিষ্যত বলতে পারি?” মৃদু হেসে প্রশান্ত কন্ঠে জবাব দিয়েছিলেন ডক্টর মালিকা।

জামিল বরাবরের মতই চুপটি করে বসে ছিল।

“আপনি তো এব্রোডে গিয়েও ট্রিটমেন্ট নিয়েছেন তাই না? আল্লাহর নির্ধারিত ক্ষমতার কাছে আমরা মানুষেরা বড় অসহায় মিসেস আনিকা। বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতিতে আমরা বার বার তাঁর ক্ষমতার কাছে নিজেদের ক্ষুদ্রতা আর অসহায়ত্ব আবিষ্কার করি।”

খুবই নমনীয় সুরে কথাগুলো বলেছিলেন ডক্টর। তবে, হতাশ হবেন না। আশা নিয়ে আল্লাহকে ডেকে যান।

সেদিন বাসায় ফিরে সব বাদ দিয়ে একমনে আল্লাহর সাহায্য চাইতে শুরু করেছিলেন। রামাদ্বানের একটি রাতও আনিকা কিয়ামুল লাইল মিস করেনি। একে তো সম্মানিত মাস তার ওপরে শেষ রাতের ইবাদাত!

একটি স্থির বিশ্বাস জন্মাল আনিকার ভেতরে। দয়াময় আল্লাহ্ ফেরাবেন না। ইস্তেগফার আর দো’আ তেই পুরো মাস কেটে গেল। বিগত চৌদ্দ বছর ধরে দেশে বিদেশে বহু ডাক্তার দেখিয়েছে এই দম্পতি। কোন চিকিৎসাতেই কোন কাজ হয়নি। বাজা মেয়ে উপাধি শুধু গ্রামে নয় শহুরে শিক্ষিত মেয়েদেরও যে কপালে জোটে, সেটি আনিকা উপলব্ধি করেছিল ভালভাবেই।

বেশ কিছুদিন পরেই এক অদ্ভূদ পরিবর্তন! জামিল কে জানাতেই অতিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ডাক্তার, টেস্ট সব করা হল। পজিটিভ!! ঈদের চাঁদও এই দম্পতির জীবনে এতটা আনন্দ এনে দিতে পারেনি কখনও।

আনিকাকে মেঝেতে পা ফেলতে দিতেও আপত্তি জামিলের। দিনগুলো কাটছিল অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে। গভীর রাতে স্রষ্টার সাথে একান্তে কথা বলতে বেশ লাগত আনিকার। “রব্বি হাবলি মিনাস সলেহীন” এই দো’আই ছিল যেন সর্বক্ষণের সঙ্গী।

পূর্ণ সময় অতিক্রম হবার পরে আগমন ঘটল সেই কাঙ্খিত সন্তানের। গভীর রাতে সন্তানের মুখে তাকিয়ে বিড়বিড় করে আনিকা উচ্চারণ করল- আমি তো তোমায় ডেকে কখনও নিরাশ হইনি প্রভু!


লা তাহযান
জাকিয়া সিদ্দিকী

(১১/০৫/১৯)