শিকলমুক্ত শত্রুর মুখোমুখি

উফফ! মহা মুশকিল তো! বেশ অনেকক্ষন ধরেই জামার হাতা ধরে টানাটানি অনুভব করছিলো আদিবা। দৃঢ় চেষ্টা চালাচ্ছিল বিষয়টা উপেক্ষা করতে। কোনো ভাবে আজকে সে আর ছাড় দিবেনা ভাবতেই টানাটানি যেন বেড়ে গেলো। অবশেষে নাছোড়বান্দা সব বাদ দিয়ে একেবারে তার ঘাড়ে চড়ে বসলো!

সারা বছর ফযরের সলাতের পর কুরআন মাজীদ পড়তে বসার সময় ঘুমের সাথে লড়াই চালায় আদিবা। একটার পর একটা বিচ্ছিরি হাই আসে, ঝিমিয়ে পরে যায়, চোখ জ্বলতে থাকে, কোনো কোনো দিনতো আবার পেটেও মোচড় দেয়! নানা রকম উপসর্গগুলো নিমেষেই দূর হয়ে যায় যখনি সে পরবর্তী সময় পড়বো ভেবে মুসহাফ বন্ধ করে রেখে দেয়।

এরপর সারাদিনে শত কাজের মাঝে পড়ার সময়টা আর কোনোভাবেই দেখা দেয়না তাকে। কুরআনুল করিম অবতীর্ণ হওয়ার এই পবিত্র মাসে শয়তানগুলোকে শিকলবন্দী করে দেয়া হয় [১]। তাই আদিবা ঠিক করেছে সারা বছরের এই অভ্যাসের দাস নয় বরং এক আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দাস হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে এ সুযোগ পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগবে সে। এইটাই যদি জীবনের শেষ রামাদান হয়!

কুরআনের সাথে স্থায়ী সম্পর্ক গড়তে সর্বপ্রথম সে অনেক দুআ করেছে। এরপর উত্তম নিয়তে, আল্লাহ এর নামে শুরু করে একটা তালিকা তৈরী করেছে। প্রতিদিন কমপক্ষে সে দেড় পারা করে পড়বে। দৈনিক এক পারা করে পড়ার যে সূত্র আছে (প্রতি ৫ ওয়াক্ত সলাত শেষে ৪ পাতা করে, একদিনে ৫৪ = ২০ পাতা; মোট ৩০ দিনে ৩০২০= ৬০০ পাতা) তার থেকে তাকে এগিয়ে থাকতেই হবে। এরপর কোন ছোট আকারের সূরা গুলো বারবার তিলাওয়াতের পাশাপাশি অডিও শুনে মুখস্ত করবে তার তালিকা। কত যে আনন্দ লাগে সলাতে নতুন মুখস্ত করা সূরা তিলাওয়াত করতে! রাতে পড়বে সারাদিনের পড়া অংশের তাফসীর।

দেয়ালে বড় করে প্রিন্ট করে ঝুলিয়ে রেখেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অনুপ্রেরণীয় হাদিস, “তোমরা কুরআন মাজীদ পাঠ কর। কেননা, কিয়ামতের দিন কুরআন, তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হিসাবে আগমন করবে” [২]।

কঠোরভাবে রুটিন পালন করতে ধৈর্যশীল ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এইবার সে। গত রামাদানের কোনো ভুল করা যাবেনা এবার। মহান আল্লাহ এ পবিত্র মাসে সিয়াম রাখার সাথে সাথে তাকওয়া অবলম্বনের উত্তম সুযোগ দিয়েছেন,

হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। [আল-বাকারাহ, ২:১৮৩]

ঘুমের সাথে লড়াইয়ের যাবতীয় প্রস্তুতি নেয়া থাকলেও আক্রমণটা আসলো অন্য দিক থেকে। ফযরের সলাতের পর যাবতীয় যিকির-আযকার শেষ করে, দৃঢ় সংকল্প নিয়ে মুসহাফ খুলে পড়া শুরু করে আদিবা।

চোখের কোণ দিয়ে দেখা যাচ্ছিলো একটু দূরে রাখা উজ্জ্বল কমলা রঙের শপিং ব্যাগটা। গতকাল মার্কেট থেকে কেনা জামার কাপড়টা ব্যাগের ভিতর থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসলো যেন। এরপর তাকে ধরে টানাটানি করে বলা শুরু করলো, “আদিবা, আমার সাথে ম্যাচিং একটা ওড়না কবে কিনবে? দোকানে এরপর ভিড় বেড়ে যাবে তো। ম্যাচিং ওড়না ছাড়া ঈদের দিনে কি পরবে? আজকে আবার মার্কেটে যাই চলো…”

না শোনার ভান করে আদিবা পড়ায় মন দিতে চেষ্টা করতেই ঘাড়ে উঠে বসে বলতে থাকলো, “এই আদিবা, মনে আছে গতবার টেইলর দেরিতে অর্ডার নিতেই চায় নাই? তারপর কার জানি কাপড়ের সাইজের সাথে তোমারটা মিলিয়ে বেঢপ একটা জিনিস ফেরত দিলো ঈদের আগে? আরে! অন্য সবার জন্য কি কেনা বাকি খেয়াল আছে তোমার?…” উপেক্ষা করার চেষ্টা করতে করতে আদিবা ভাবনায় ডুবে যেতে শুরু করলো।

ঈদে কার জন্য কি কি কেনা বাকি সব একে একে লাইন দিয়ে আসা শুরু হলো…বিরক্ত চেহারার টেইলর আসলো…মার্কেটের ভিড় আসলো…ম্যাচিং ওড়না আসলো…নতুন জুতা আসলো…হঠাৎ আদিবার খেয়াল হলো এতক্ষন কতটুকু কি তিলাওয়াত করেছে তা থেকে কিছুই মনে করতে পারছেনা আর! বুঝলো রামাদান মাসে শয়তান শিকল বন্দি থাকলেও সার্বক্ষণিক সঙ্গী প্রবৃত্তি আল্লাহর আনুগত্য করতে পদে পদে বাধার সৃষ্টি করে।

আক্রমণ থেকে বাঁচতে মহান আল্লাহ এর কাছে সাহায্য চেয়ে আদিবা দুআ করলো,

“আল্লা-হুম্মা আ-লিমাল গাইবি ওয়াশ্শাহা-দাতি, ফা-ত্বিরাস সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদ্বি, রাব্বা কুল্লি শাই’ইন ওয়া মালীকাহু, আশহাদু আন লা-ইলা-হা ইল্লা আনতা, আ’উযু বিকা মিন শাররি নাফসী ওয়া মিন শাররিশ শাইত্বা-নি ওয়া শিরকিহী।” [৩]

(হে আল্লাহ! হে গায়েব ও উপস্থিতের জ্ঞানধারী! হে আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা! হে সব কিছুর রব্ব ও মালিক! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই। আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই আমার আত্মার অনিষ্ট থেকে এবং শয়তানের অনিষ্ট থেকে ও তার শিরক বা ফাঁদ থেকে।)

===

বুট বুট, বুট বুট। এইবার পুরোপুরি মনোযোগ হারালো ফারিহা। শব্দের সাথে এখন স্পষ্ট কথাও ভেসে আসছে। ফারিহা এতক্ষন খুব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো বিষয়টা উপেক্ষা করতে। কিন্তু অবশেষে কিছুক্ষন আগের প্রশান্ত মনের একাগ্রতা হারিয়ে সম্পূর্ণ বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলো সে।

পরিতৃপ্ত মনে হিসাব শেষ করে খাতাটা বন্ধ করে আসরের সলাতে দাঁড়িয়েছিল ফারিহা। ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ যাকাতের হিসাব কিভাবে করতে হয় বিয়ের পর তার স্বামী তাকে শিখিয়েছে। বারাকাল্লাহ, মহান আল্লাহ তাকে যাকাত দানকারীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সামর্থ দিয়েছেন। ফারিহার প্রতি বছরের যাকাত হিসাব করার একটা খাতা আছে। মহান আল্লাহ এর নামে শুরু করে পবিত্র কুরআন থেকে বেশ কিছু আয়াত লিখেছে সে। যেমন,

“…বস্তুতঃ তোমরা যা কিছু ব্যয় কর, তা তোমাদের নিজেদের জন্যই এবং তোমরা তো শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই ব্যয় করে থাক এবং যা কিছু তোমরা মাল হতে ব্যয় করবে, তোমাদেরকে তার ফল পুরোপুরি দেয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি অন্যায় করা হবে না।” [আল-বাকারাহ ২:২৭২]

“যারা তাদের দানের বস্তু দান করে আর তাদের অন্তর ভীত শংকিত থাকে এ জন্যে যে, তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের কাছে ফিরে যেতে হবে।” [আল-মুমিনুন ২৩:৬০]

যাকাত প্রদানের নিয়ত একমাত্র আল্লাহ তা’য়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই হতে হবে। ফারিহা এরপর লিখে রেখেছে আধুনিক হিসাবে যাকাতের নিসাব, স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত ভরি আর রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন তোলা। এর কম অলংকারের যাকাত ফরয হয় না। মহান আল্লাহ এর বিধান কত সুন্দর আর সহজ।

স্বর্ণ ও রূপা ছাড়া অন্য কোনো ধাতব অলংকারের উপর যাকাত নেই। তার খুব অবাক লেগেছিলো যখন জেনেছিলো, হিরা, মণি-মুক্তার মতো মূল্যবান পাথর ব্যবসা পণ্য না হলে তাদের যাকাত ফরয নয়। প্রতি রামাদান মাসে এক চন্দ্রবর্ষ পূর্ণ হওয়ার, স্বর্ণের বর্তমান বাজার মূল্য জেনে, আনন্দের সাথে মহান আল্লাহ কে শুকরিয়া জানিয়ে, নিজের গহনার যাকাতের হিসাব সে নিজেই বের করে।

এরপর সব হিসাব মিলিয়ে তার স্বামী তাদের বাকি সম্পদের যাকাতের সাথে তা আদায় করে। কুরআন মাজীদ থেকে সূরা আত-তাওবার ৬০ নম্বর আয়াত থেকে যাকাতের নির্ধারিত আট শ্রেণীর খাত গুলো এরপর লিখেছে।

ফারিহা বিয়ের আগের, বিয়েতে পাওয়া, দৈনন্দিন ব্যবহৃত ছোট ছোট স্বর্ণের [৪] প্রত্যেকটা গহনা কত ক্যারেট, কত ভরি বা গ্রাম, সব এক এক করে মেপে ওজন সহ লিখে রেখেছে। নতুন গহনা কিনলে বা আগের কিছু কমলে তা টুকে রাখে সে হিসাবের জন্য। সে কোনো মতেই চায়না কিয়ামতের দিনে এই সম্পদ বিষধর সাপ হয়ে গলায় ঝুলে মুখের দু’পাশে কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার জমাকৃত সম্পদ [৫]। যাকাত সঠিকভাবে আদায় না করলে জাহান্নামের আগুনে নিয়ে যেতে ছোট একটা আংটিই যথেষ্ট!

হিসাবের চেয়ে বরং বরাবরই বেশি দিতে চেষ্টা করে সে, যা কিছু মহান আল্লাহ এর জন্য দেয়া হয় তাই তো জমা হয়ে থাকবে, ইনশাআল্লাহ। রামাদান মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রবাহমান বায়ু অপেক্ষাও অত্যধিক দানশীল হতেন [৬]।

সব শেষ করে প্রশান্ত চিত্তে সলাতে দাঁড়ানোর পর এক রাকাত শেষ করতে না করতেই পিছনে শুরু হলো বুট বুট শব্দটা। কে আর? চুলায় দিয়ে আসা ছোলা বুট! “আমাদের যে সিদ্ধ দিয়েছো, চুলার আগুনের তাপ বেশি না কম খেয়াল আছে? পুড়ে মরবো নাকি শেষে!” সাথে এসে তাল মিলালো পিঁয়াজুর ডাল, “হায়রে, আমাদের যে কোন সময় বাটাবাটি করবে বুঝলামনা এখনো?” ফারিহা সলাতে মনোযোগ আনতে চেষ্টা করতেই উটকো লেবুর দল ভেউ ভেউ কান্না জুড়লো, “আমাদের শরবত বানিয়ে ফ্রিজে রাখোনাই কেন এখনো, আমরা কখন ঠান্ডা হবো?..ই..ই..” এরপর একে একে লাইন ধরে আসতে থাকলো বেগুনির জন্য গোলানো বেসন…যোগ দিলো সাথে বারান্দার পানির জন্য অপেক্ষমান গাছ…শুকাতে দেয়া কাপড়…সাইলেন্ট করতে ভুলে যাওয়া ফোনের পিক পিক…

ফারিহা এরপর আর মনে করতে পারলোনা সে তৃতীয় না চতুর্থ রাকাত শেষ করেছে। কোন সূরা পড়লো যেন আগের রাকাতে? মহান আল্লাহ এর সামনে দাঁড়ালে সারা বছরের সঙ্গী প্রবৃত্তি সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় চিন্তার রাজ্যে টেনে নিয়ে যেতে চায়। ফারিহা মহান আল্লাহ তা’আলার নিকট আশ্রয় চেয়ে দুআ করলো,

“ইয়া মুকাল্লিবাল কুলুব সাব্বিত কালবি আলা দিনিক।“ [৭]

(হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত দৃঢ় রাখুন।)

===

টুট টুউট টুট টুউউউউ…শিস বাজিয়ে যেন নোটিফিকেশনের শব্দ দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে কেয়ার। চোখ বন্ধ করে অদম্য ইচ্ছাকে দমন করার চেষ্টা করছে সে, “না কেয়া না, এ এক বিরাট ফাঁদ তুমি জানো, ডাকে সারা দিওনা, নির্ঘাত পা পিছলে গর্তে পরবে, প্রতিবার এই ফাঁদে পর তুমি!” তবুও যেন তাকে হাতছানি দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে স্ক্রিনের নীলাভ আলোকরশ্মি…

গত বছর রামাদানে অত্যাধিক খাওয়া কাফিরের সদৃশ্য [৮] জানার পর থেকে পরিমিত খাওয়ার ব্যাপারে খুব সচেতন থাকছে কেয়া। বাসার সবাই মিলে পেট টাপ্পুস করে অত্যাধিক ইফতারির পর হাঁসফাঁস করতে রাজি না এবার কোনোমতেই। ওদিকে বাসায় নিয়ম করেছে সবাইকে সুষম সাহরী করতে হবে কেননা সাহরীতে বরকত রয়েছে [৯]।

আজকে সব কাজ শেষে বিছানায় শুয়ে দুআ ও যিকির আযকার বিষয়ে একটা বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল কেয়া। সেখান থেকে খুব সুন্দর ছোট দুইটা দুআ শেখার পর থেকে তার খুব ইচ্ছা করছে সবার সাথে ফেইসবুকে শেয়ার করতে।

মহান আল্লাহ এর পক্ষ থেকে রামাদান মাস সংযম ও নিজেকে তাকওয়াশীল হিসেবে গড়ে তোলার সর্বোত্তম সময়। পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত হতে উদ্যোগ নিয়ে আত্মশুদ্ধি নিয়ে ভাবতে যেয়ে টের পেয়েছে ফেইসবুকের প্রতি তার চরম আসক্তি। জীবনের উত্তম সময়গুলো যেন গপাগপ খেয়ে ফেলে ফেইসবুক। ভালো লেখা পড়বে, সাদাকায় জরিয়ার আশায় কিছু শেয়ার করবে এই নিয়তে ঢুকলেও প্রতিবার একগাদা খারাপ অভিজ্ঞতা নিয়ে বিষন্ন হয়ে বের হয়ে আসে কেয়া।

এইতো সেদিন ঢুকেছিলো ইসলামিক কিছু ভালো লেখা পড়ার জন্য। একটা লেখা পড়া শেষ করতে না করতেই সারা বছরের অভ্যাস বশতঃ অজান্তে স্ক্রল করে নিচে নেমে দেখে যে, মিলি আপু আর ভাইয়া বন্ধুদের সাথে দল বেঁধে কোথায় সাহরী পার্টি করবে তার প্ল্যান করছে।

মিলি আপু তো গতকালকেই গ্যাস্ট্রিকের সমস্যার জন্য রোযা রাখতে পারবেনা সেই দুঃখে পোস্ট দিয়েছিলো! আরো স্ক্রল করতেই চোখে পড়লো, রুমি কয়েকটা পথশিশুকে খাবার প্যাকেট কিনে দিচ্ছে তা লাইভ ভিডিও করে সবাইকে দেখাচ্ছে। আবার লিখেছে তার নাকি কমপক্ষে ৫ কেজি ওজন কমানোর টার্গেট এই রামাদানে। হায়রে নিয়ত!

রাবেয়া আপু মিস করে শেয়ার দিয়েছে গতবছরের বিশাল ইফতার পার্টির আয়োজনের টেবিল ভরা সব খাবারের ছবি। তারপরে তো সাজিয়ার সিজনাল হিজাব পরা বেকায়দা অবস্থা দেখে ফিক করে হেসে ফেললো কেয়া। সারা বছর নানা রকম হেয়ার কালার করে ছবি দেয় আর এখন রামাদান মুবারক সাজ সেজেছে! প্রবৃত্তির তাড়নায় নির্দ্বিধায় সবাই দেখিয়ে বেড়ায় আর সে নীরব সাক্ষী হয়।

রামাদান মাস পুরোটাই রহমত এবং বরকত দ্বারা পরিপূর্ণ। রোযাদারের তো শুধু দুইটা আনন্দ হওয়ার কথা, ইফতারের সময় আর মহান রবের সাথে সাক্ষাতের সময়! মহান আল্লাহ বিশেষ প্রতিদান দিবেন যে শুধুমাত্র তাঁর জন্য পানাহান পরিত্যাগ করে সিয়াম রাখবে এবং পাশাপাশি স্বীয় প্রবৃত্তি দমন করবে [১০]। জীবনের অতি মূল্যবান নিয়ামত সময় কে ক্ষতিগ্রস্থ করে বিনিময় – গীবত, হিংসা, অন্যের গোপন দোষ, মিথ্যাচার, খারাপ ধারণা আরো কত কি কুড়াচ্ছে। এ প্রতিটা মুহূর্তের জবাবদিহি করতে হবে। অথচ রোযা জাহান্নাম হতে বাঁচার ঢাল স্বরূপ।

এই যদি জীবনের শেষ রামাদান হয়! ভাবতেই অদম্য আকর্ষণ থেকে নিজেকে দমনের সিদ্ধান্ত নিয়ে গা ছেড়ে উঠে একটা সাদা কাগজ বের করলো কেয়া। সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে লিখলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতারে দুআ করতেন,

“যাহাবায যামাউ অবতাল্লাতিল উরুকু ওয়াসাবাতাল আজরু ইন শা-আল্লাহ।” [১১]

(পিপাসা দূরীভূত হল, শিরা-উপশিরা সতেজ হল এবং ইন শা-আল্লাহ সওয়াব সাব্যস্ত হল।)

এরপর কাগজটা খাবার টেবিলের সামনে লাগাতে লাগাতে ভাবলো, জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পেতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাদান মাসে পরিবারের সবাইকে নিয়ে কোমর বেঁধে ইবাদত করতেন, বেশি বেশি দান সাদাকা করতেন, বিশেষ করে শেষ দশ রাতে [১২]। ফেসবুকে শেয়ার দিলে হয়তো বেশিরভাগ মানুষই তার মতো একবার পড়েই স্ক্রল করে সরে যাবে। কয়জনই বা আমলে নিবে! কিন্তু এখন বাসার সবাই এই লেখা দেখে ইফতারির সময় পড়বে।

কেয়ার কাজ দেখে বুয়া এসে জিজ্ঞাসা করলো “এইডা কি করতেসেন আফা?” চট করে মাথায় একটা বুদ্ধি এসে গেলো কেয়ার, এই নিশ্চিত সাদাকায় জারিয়া কি আর হাতছাড়া করা যায়? মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে বললো, “এই যে বুয়া, তোমাকেই বাসার সবার আগে সামনে পেয়েছি! রামাদানের শেষ দশ দিন বেশি বেশি পড়ার জন্য হাদিস থেকে ছোট্ট একটা দুআ এখনই মুখস্ত করে ফেলতো আমার সাথে! আয়িশা (রা) কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লাইলাতুল কদর পেয়ে গেলে এই দুআ করতে বলেছেন। আমার সাথে সাথে বলো,

“আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’য়ফু আন্নি।” [১৩]

(হে আল্লাহ! আপনি সম্মানিত ক্ষমাকারী, আপনি ক্ষমা করতেই পছন্দ কর, অতএব আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।)

===

পরিশিষ্ট

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন শুধুমাত্র তাঁর জন্য কৃত সকল ইবাদত আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করে নিন, প্রকৃত সংযম ও প্রবৃত্তির অনিষ্ট দূর করে সর্বত্র কল্যাণ দান করুন, তাকওয়া অবলম্বনে সহায়তা করুন এবং আমাদের পূর্বের সকল দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করে পুরষ্কৃত করুন। [১৪]

“আল্লাহুম্মা ইন্নি আ’উযু বিকা মিন মুনকারাতিল আখলাকি ওয়াল আ’মালি ওয়াল আহওয়ায়ি” [১৫]

(হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকটে গর্হিত চরিত্র, গর্হিত কাজ ও কু-প্রবৃত্তি হতে আশ্রয় চাই।)

আমিন।

[১] আল-বাকারাহ ২:১৮৫ এবং সহিহ বুখারী ১৮৯৯ [২] মুসলিম ৮০৪ [৩] আন-নাহাল ১৬:৯৮ এবং তিরমিযী ৩৩৯২, আবূ দাউদ ৫০৬৭ [৪] আবু দাউদ ১৫৬৩, ১৫৬৫ [৫] আল-ইমরান ৩:১৮০ এবং বুখারী ১৪০৩ [৬] আন-নাসায়ী ২০৯৫ [৭] তিরমিযী ২১৪০, ইবনে মাজাহ ৩৮৩৪ এবং মুসলিম ২২০৩ [৮] সহিহ বুখারী ৫৩৯৬, মুসলিম ২০৬২ [৯] আন-নাসায়ী ২১৪৯ [১০] ইবনে মাজাহ ১৬৩৮, সহিহ বুখারী ১৯০৪, মুসলিম ১১৫১, তিরমিযী ৭৬৪ [১১] আবূ দাঊদ ২৩৫৭ [১২] আত-তাহরীম ৬৬:৬ এবং সহিহ বুখারী ২০২৪, মুসলিম ১১৭৪ [১৩] ইবনু মাজাহ ৩৮৫০, তিরমিজি ৩৫১৩ [১৪] সহিহ বুখারী ১৯০১ [১৫] তিরমিজি ৩৫৯১

হাদিস রেফারেন্সগুলো sunnah[dot]com হতে সংগৃহীত।


শিকলমুক্ত শত্রুর মুখোমুখি
– নাবিলা হাসিন

(২৫/০৫/২০১৯)