স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ‘রোজা’নামচা

আলগোছে আলমারি থেকে ২০১১র ডাইরিটা নামায় মিলি। দুপুরের পর এই সময়টা ওর কাটে ব্যালকনিতে।
স্মৃতিরোমন্থনে।

পুরোনো রোজনামচায় চোখ বুলানো যেন ওর জন্য থেরাপির মতো কাজ করে! উল্টাতে উল্টাতে বের হয় সে বছরের রামাদান মাসটা। তন্ময় হয়ে যায় মিলি।
জীবনের ছোট্ট একটা ট্রান্সিশনাল পিরিয়ডে , স্ক্যান্ডিনেভিয়ার শুভ্র সাদা বরফ ঘেরা একটা দেশে, একদা ও পার করেছিল ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ রামাদান!

সেবারের রমাদ্বানটা ছিল অনেকগুলো প্রথমের অভিজ্ঞতা।

বিয়ের পর প্রথম রোজা, দেশের বাইরে প্রথম রোজা আর নর্ডিক সামারের সাড়ে ২১ ঘন্টার রোজা! সবই মিলির জীবনে এই প্রথম!

আপামরের দাঁড়িপাল্লায় অসুন্দর হওয়ার সবগুলো যোগ্যতাই ওর ছিল। উচ্চতায়, রঙে , আকারে। মেধা ছিল কিনা জানেনা তবে মেধাতালিকায় কখনোই ছিল না ওর নাম।

আশেপাশের নেতিবাচক গুঞ্জন তাই অবধারিত ভাবে সংক্রামিত হয়েছিল মিলির কচি মনেও।

বিয়ে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভয় লাগতো ওর। তবু ডাইরিতে যত্ন করে লিখতো অনেক স্বপ্নময় দুআ। সুন্দর একজন জীবনসঙ্গীর জন্য। যদিও ওর মনে হতো খুব সুন্দর কিছু ঘটার আগেই বোধহয় জীবনটার পরিসমাপ্তি হবে।
কিন্তু না , ওর দুআ কবুল হয়েছিল আর ওর আশে পাশেই জলজ্যান্ত হেটে চলে বেড়াচ্ছিল! তাই বৃষ্টির পরে যেমন সবুজ সতেজ হয়ে উঠে পৃথিবী , তেমনি দুআ কবুলের পর আনন্দ আর কৃতজ্ঞতায় স্নিগ্ধ, শ্যামল হয়ে উঠেছিল ওর মন।

সেই পরিতৃপ্ত মন নিয়ে ও শুরু করেছিল এক নতুন রামাদান।

আগে রোজা তো রাখতো ঠিকঠাক কিন্তু দিনশেষে বাহারি ইফতারের অপেক্ষা , বাজার ঘুরে ঈদের জামা কেনা , চাঁন রাইতে রাত জেগে মেহেদী দেয়া আর ঈদের দাওয়াত খাওয়া তিন চারদিন পর্যন্ত। এগুলোই ছিল থিম ।

এবারের রোজায় ওর আটপৌরে মুসলিম পরিচয় যেন নতুন জৌলুশ পেলো সবার সামনে প্রেজেন্ট করতে যেয়ে।

“আই’ম এ মুসলিমা, আই’ম ফাস্টিং। দিস ইজ আওয়ার রামাদান”

লাঞ্চ কেন খাচ্ছেনা সহপাঠীদের প্রশ্নের উত্তরে বলতে হতো ওকে। ভাষা শিক্ষার ক্লাসের ভিনদেশী সহপাঠী। বলার সময় নিজের দেহে শিহরণ খেলে যেত ওর। যে শিহরণ দীর্ঘ ২৪ বছরে এভাবে কখনও ফীল করা হয়নি।

সাপের মতো পেঁচানো সারি সারি প্লাটফর্ম এর একটাতে থামতো ওর ট্রেন। ক্লাস শেষে প্রতিদিন বিশাল স্টেশন এর ভিতর দিয়ে, সাবওয়ে আর টার্কিশ কাবাবের দোকানের সুগন্ধকে পাশ কাটিয়ে মাথা নিচু করে বাড়ি ফিরত ও। ঈমানের যে অতুলনীয় , অপার্থিব মিষ্টতা অনুভব হতো ওই গন্ধ অগ্রাহ্য করার মাঝে , তেমন অনুভব ছোলা -পেঁয়াজু, আলুর চপের ঢাকায় কখনও হয়নি ওর।
বাসায় পৌঁছে আরো চার পাঁচ ঘন্টা নিমেষেই কেটে যেত। টোনাটুনির সংসারে চলতো নিত্য নতুন এক্সপেরিমেন্ট। বড়া বানিয়ে নুন দিতে ভুলে যাওয়া বা পুরি বানাতে যেয়ে বিস্কিট হয়ে যাওয়া ! তবুও কি তৃপ্তি !

রাত সাড়ে দশটায় হতো ইফতারের টাইম। ইফতার খেয়েই তারাবির জন্য দে ছুট। তারাবি পরেই তড়িঘড়ি করে সেহেরীর খাওয়া । কারণ ফজর রাত আড়াইটায়। অতঃপর ফজর পড়িয়া রাতের ঘুম ঘুমাতে যাও ! যেন ইন এ প্যারালাল ইউনিভার্স বসবাস করছে ওরা। যেখানে জগতের সব নিয়ম আলাদা!

জীবনে প্রথম তারাবির নামাজ মসজিদে যেয়ে পড়ার সৌভাগ্য হয় ওর। মসজিদে যেয়ে অবাক লাগে।
রংবেরঙের হিজাবের মতো ওদেরও কত রং! রক্তশূন্য ফর্সা স্কান্ডেনেভিয়ান তরুণী , আবলুস কাঠের মতো সোমালিয়ান বোন , আর বাদামি মিলি। এক ইমামের আল্লাহু আকবারে সবাই এক সাথে মাথা নুয়ানো ! পৃথিবীর কোন কোণ থেকে আসা কুপমণ্ডূক মিলি , যে কিনা জীবনে সমুদ্রটুকু ছুঁলো না , টেনিস কর্কের মতো ছুটি মানেই দাদা বাড়ি আর নানাবাড়ি ,এই পার আর ওই পার , আজ সে নানান দেশের, নানান বর্ণের মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছে।

সেই রামাদানটা মিলির জীবনের শ্রেষ্ঠ রামাদান ছিল। কারণ ওই প্রথম পুরো রাত জেগে ইবাদাত করতে পেরেছিলো ও। পারবেনাই বা কেন ? ঈশা টু ফজর দুটি ঘন্টা যে কেবল ! দেশ থেকে ফোনগুলোতে কত শঙ্কা বাজতো তখন।

“পারছো কিভাবে ? ২১ ঘন্টা ? বাপরে !”

আসলে এতো সহজ মনে হয় জীবনে আর কোনো রোজা যায়নি ওর। এ দেশের আবহাওয়ায় হিউমিডিটি কম হওয়ায় , পিপাসা লাগে না তেমন , ঘাম হয়না। শুষ্ক শান্ত রোজা। তবে এখন বুঝে অনেকটাই ডিপেন্ড করে মানসিকতার উপর। আর মানসিকতার বিপ্লব ঐভাবে না হলে এ রোজাটাও হয়তো কঠিনই হতো।

ইতিহাসের বইতে যেমন একটা রেনেসাঁর যুগ থাকে , তেমন ২০১১ ছিল মিলির জীবনে রেনেসাঁর বছর। আল্লাহর সাথে সম্পর্কটা সারাজীবন ছিল পড়াশুনা কেন্দ্রিক। রেজাল্টের আগে দিয়ে ঈমান আমল বেড়ে যেত , পার পেয়ে যাওয়ার পর যেই কে সেই।
পড়াশুনা কেন্দ্রিক সেই সম্পর্ক তখন একটু একটু করে কেন্দ্রবিচ্যুত হতে শুরু করেছে।

বিপদে দুআ আর ফলশ্রুতিতে বিপদমুক্তি এই দুই ছাড়িয়ে ওর জীবনের আরো অনেক বড় এক লক্ষ আছে যেটা ওর বুঝতে হবে। তবেই না বিপদগুলোর সার্থকতা !

দেশের বাইরে এসেই প্রথম রেগুলার ইসলামিক হালাকায় যাওয়ার একটা ট্রেন্ড এর সাথে পরিচিত হলো ও ,নর্ডিক মুসলিম সামার ক্যাম্প তো জীবনটাই বদলে দিলো , আর আশ্চর্য এক ঘটনার মাধ্যমে স্টাইলিশ হিজাবি থেকে মুমিনার ড্রেসকোডে উন্নতি হলো তার । জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গিতে হলো বিপ্লব।

সেই সব ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে শুরু করা রামাদানে ও যেন নিজের মধ্যে কোথায় এক স্বর্গীয় আত্নবিশ্বাস খুঁজে পেলো। এই প্রথম ওর আসে পাশের মানুষগুলো কেউ ওকে রূপ , গুন , মেধা , যোগ্যতা, টাকা পয়সায় না, তাক্বওয়ার নিক্তিতে মাপতে লাগলো।

পুরো ৩০টা রোজার পর যখন শাওয়ালের ৬ রোজাও পটাপট করে ফেলতে পারলো তখন থেকে খটকা লাগা শুরু হয় ওর।

একেকটা করে দুআ কবুল হয় আর একেকটা করে মাইলস্টোন ছোঁয় ও জীবনের। এবার যখন জীবনের আসল লক্ষ ও উদ্দেশ্যে নিয়ে ও অনেকটাই ক্লিয়ার , মনে মনে ভাবছিলো এবার কি ? এবার কোন মাইলস্টোন?

আর তখনই ওর রাব্ব ওকে সেই শুভ বার্তাটি পাঠালেন। ওহী না হলেও , রাব্ব তাঁর প্রতিটি বান্দাকে কোনো না কোন মাধ্যমে বার্তা পাঠানই। প্রেরক আর প্রাপকের সে কমিউনিকেশনের গভীরতা দ্বিতীয় কেউ উপলব্ধি করতে পারেনা।

রোজার মাসটা যাওয়ার পর পরই মিলি জানতে পারলো তারই রক্ত মাংস অনু পরমাণু দিয়ে তারই অস্তিত্বে বেড়ে উঠচ্ছে আরেকটি আগামী মানুষ।
এতো দিন ধরে আল্লাহ যেন তৈরী করলেন এই মিলিকে। এবার তাকে দিবেন সবচে গুরুত্বপূর্ণ এসাইনমেন্ট। তাঁর আরেক বান্দার হেফাজত , তারবিয়াত এর পুরো দায়িত্ব।

সেই রামাদানটা মিলির জীবনের শ্রেষ্ঠ রামাদান ছিল।

এখন এসাইনমেন্টস বেড়েছে।

আর সে এসাইনমেন্টস করতে করতে দিন রাতের ঠিক থাকে না। ইবাদত ওলোট পালট হয়ে যায় । কিন্তু ম্যাচিউরড মন এখন বোঝে। শয়তানের ওয়াসওয়াসা চেনে। মিলির বয়সের মতো , ভূমিকার মতো বদল হয়েছে ওর ইবাদাতের রূপও।

বিন্দু থেকে মিলির পৃথিবী ত্রিভুজ , চতুর্ভুজ হতে হতে এখন পেন্টাগন। ওরা জামাই , বৌ আর তিনটা বাচ্চা। ঘুমপাড়ানি তিলাওয়াত , রামাদান ক্রাফট , রামাদান স্টোরি বুক পড়ে শোনানো এখন মিলির ইবাদত। জীবন দিয়ে শেখা যে শিক্ষা ও ধরে রাখতো ডাইরির পাতায় এখন সে রেখে যেতে চায় প্রজন্মান্তরে।
ডাইরি লিখার সময় এখন একদম পায়না বললেই চলে। বরং কথা বলে প্রচুর। বাচ্চাগুলোই যেন একেকটা জলজ্যান্ত ডাইরি। বিশাল বিশাল চোখের তারায় কত প্রশ্ন ওদের। গুছিয়ে , বুঝিয়ে, ধৈর্য নিয়ে উত্তর দেয় মিলি। ও জানে ওই চোখের তারায় লেখা হয়ে যাচ্ছে একেকটা পেইজ যা ইন শা আল্লাহ সারাজীবন ওরা ধরে রাখবে ওদের বুকে।

আরেকটা রমাদান আসছে সামনে।

ডাইরি বন্ধ করে মিলি।

গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আসা ঝিরঝিরে বাতাস বুক ভরে টেনে নেয়। চোখ বন্ধ করে , চিবুক উঁচিয়ে বাতাসের মতোই অনুভব করে আরেক অসীম , অনন্ত সত্তাকে যাঁকে ও চোখে দেখেনি এখনও।
মনে মনে বলে ওঠে ,
“কবুল করো আমার জীবন। আমার সমস্ত ভুল ভ্রান্তি আবেগ দুর্বলতা ক্ষমা করে কবুল করো আমায়। এমন একটা জীবন কাটানোর তৌফিক দাও যে জীবন শেষে তোমার সাথে দেখা হবেই হবে। “

বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আকাশ থেকে পড়া বড় বড় ফোঁটার সাথে ছোট্ট একটা নোনা ফোঁটাও টুপ্ করে গড়িয়ে পড়ে মিলির গাল বেয়ে।

সযতনে সেটাকে মুছে নিয়ে, ওযু করে এসে আসরের নামাজে দাঁড়ায় ও।

স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ‘রোজা’নামচা
উম্ম ঈসা

(২০/০৫/১৯)