হঠাৎ একদিন!

“সেকি! ফ্রীজের ওই কোণায় একটা চুল রয়ে গেছে তো, ঠিক করে সব কেচেকুচে নাও না, এমন করে কেউ ঘর মুছে নাকি? আমার সময় আছে এই গরমের মধ্যে এসিরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে তোমার কাজকারবার সব এভাবে পর্যবেক্ষণ করার? একটা কাজও তো ঠিক করে হয়না তোমার দ্বারা ! শুনে রাখো ঝর্ণার মা, আমার সাথে বেশি বেশি করলে না একেবারে মাইনে থেকে দুইশ টাকা কেটে রেখে দিবো এই বলে দিলুম হ্যাঁ….!”

ভরদুপুরে সূর্যের তেজোদীপ্ত রোদের চেয়েও আরো তেজ গলায় চেঁচাচ্ছেন মিসেস রুমানা। এই মাত্রই ফেইসবুকে “রমাদানে সদাচরণ” নিয়ে একখান স্টেটাস দিয়ে রুম থেকে বের হয়েছেন রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে। গতরাত সাবিহা ভাবীদের বাসার বর্ণাঢ্য “ইফতার পার্টি” থেকে ফিরতে ফিরতে বেশী দেরি হয়ে যাওয়ায় এমনই চিতপটাং হয়ে মরার মতো এক ঘুম দিয়েছিলেন যে সেহরির জন্য আর উঠতেই পারেননি। সেজন্যই আরকি আজ রোজাটাও রাখা হয়নি।

যদিও পাশের ফ্ল্যাটের ওই ‘হুজুরনি ভাবী’ আসমা আপা একদিন লেকচার দিয়েছিলেন- সাহরি খাওয়া সুন্নাহ আর রোজা হলো ফরয, তাই সাহরি কোনোভাবে মিস হয়ে গেলেও রোজাটা যেনো মিস না হয়, কিন্তু তাতে কী? সারাটা দিন রোজা রাখবো আর পার্টি থেকে এত্তো ভাজাপোড়া খেয়ে যদি ভোররাতে সালাদ টাইপ হেলদি কিছু না খাওয়া হয়, তাহলে তো ডায়েটের বিশাল বড় ক্ষতি হয়ে যাবে! তখন যদি আবার শরীর খারাপ হয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটাছুটি করতে হয়? সেই ভয়ে রোজাটা ভাবলেন আজ নাই রাখবেন! আর এমনিতেও, পুরো মাস…এর মধ্যে কেবল একটা দিন রোজা না রাখলে তেমন কিইবা হবে? কেও তো আর জানছেনা তাই না! মাগরিবের সময় একটা ঘোমটা দিয়ে সবার সাথে ইফতারের জন্য বসে গেলেই সবাই স্বাভাবিকভাবে বুঝে নিবে তিনিও বুঝি সবার মতো আজ রোজা ছিলেন। ব্যাস! ফির টেনশন কি ক্যায়া বাত!

এদিকে আরো দুই বাসায় কাজ করে আসা ঝর্ণার মা রাতে আধখানা জিলাপি আর খেজুর খেয়ে শত কষ্ট এবং ভ্যাপসা গরমকে উপেক্ষা করে রোজা রেখে কাজ করছেন আর মনে মনে ভাবছেন, পকেটের জমানো ত্রিশ টাকা দিয়ে বাসায় না খাওয়া ছোট্ট মেয়েটার জন্য আজ কী কিনে নেয়া যায়! বুয়ার মেয়েটার নাম রেখেছে ফারিহা আফরোজ ঝর্ণা। স্কুলে সবাই ফারিহা নামে চিনলেও বাসায় অবশ্যি ওকে ঝর্ণা নামেই বেশি ডাকা হয়। আট বছরের বাবাহীন মেয়েটাও আজ মায়ের সঙ্গে রোজা রেখেছে। বলা বাহুল্য যে তারা রোজা রাখুক বা নাই রাখুক, তাদের প্রতিদিনই একইরকম যায় – পিপাসায়, ক্ষুদায়, অনাহারে, তৃষ্ণায়!

তবুও শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই এই সিয়াম পালন। যাই হোক, এসব বেদনাময় ভাবনা-চিন্তার মাঝখান দিয়ে হঠাৎ মনে পড়ে গেলো সুরাহ আলে-ইমরানের ১৩৯ নং আয়াতটি, যেখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সমগ্র মানবজাতি কে সান্ত্বনা স্বরূপ বলছেন,
“ وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا“
“তোমরা হীনবল হয়ো না এবং চিন্তিতও হয়ো না…….”

সাথে সাথেই বুয়ার মুখে একরাশ চাঁদহাসি! আল্লাহ আছেন তার পাশে, চিন্তার কোনোই কারণ নেই। পরম করুণাময় একমাত্র তিনিই আর-রাজ্জাক (জীবিকাদাতা) নিশ্চয়ই কোনো ব্যবস্থা তিনি ঠিকই করে দিবেন। ওহ! বালতিটা রান্নাঘরের বারান্দায় রাখতে রাখতে হঠাৎ মনে পড়লো আজ কেনো জানি পাশের বাসার আসমা আপা যাওয়ার সময় দেখা করে যেতে বলেছেন। আল্লাহই ভালো জানেন আবার কোন কাজটা করা বাকি রয়ে গেছে!

* কাজ শেষে –

– “ঠিহাসে আফা ওহন মুই যাইগা…”
– “হুম, ঠিকাছে, কাল তাড়াতাড়ি চলে এসো, এক মিনিটও যদি এদিক ওদিক হয়েছেনা, তোমার খবর করে দিবো বুঝলে….মাথায় থাকে যেনো।“
– “জ্বী আইচ্ছা। আফা ওহন আসি। আসসালামু আলাইকুম।”

এই বলতে বলতেই দরজা লাগিয়ে দিয়ে পাশের বাসায় কলিং বেল চাপলো ঝর্ণার মা। মনের মধ্যে বড়ই টেনশন এবং অস্থিরতা কাজ করছে। এই ক্লান্ত শরীর নিয়ে আবার কোন কাজ জানি করতে হয়!

– “বাহ বাহ এসে গেছো! নাও ভেতরে এসো, এইযে এখানটায় বসো…”

-“আফা আবার আইতে কইলেন যে? ওই কোণার রুমের বাথরুমডা ধুইয়া দিতে হইবো নি?

– “না না, সে জন্যে না, আজ বিকেলে মেহমান আসবে, বাসায় আলুর চপ, হালিম, এটা ওটা বেশ অনেক কিছুরই আয়োজন আলহামদুলিল্লাহ! ভাবলাম তোমাকে বাটিতে করে কিছু দিয়ে দিবো…..”

এ বলতে না বলতেই রান্নাঘরে ঢুকে পড়লেন তিনি। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আবার বের হলেন সবুজ রঙ্গের একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে। ব্যাগের ভিতরটায় দেখেই বোঝা যাচ্ছে খাবার ভর্তি দুটো বাটি। ঝর্ণার মা’র মনে খুশির ঝর্ণাধারা একেবারে খিলখিল করে বয়ে যাচ্ছে। সেই খুশি আর দেখে কে! খুশিতে মন বর্ষাকালের মেঘনা নদীর মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে আর মনে মনে বলছে, “শোকর আলহামদুলিল্লাহ!!! আল্লাহ তুমি পরম দয়ালু, পরম মহিমাময়….”

————– ♠ ————— ♠ ————– ♠ —————- ♠ —————- ♠ ————-

আমরাও কি পারিনা আমাদের বাসার কাজের বুয়াটার মুখে এরকমই একটা হাসি ফুটাতে? পারিনা আল্লাহর জন্য তাদেরও বাটিতে করে একটু ইফতার দিয়ে দিতে? বা ইফতারের সময় আসতে বলতে? একটুও কী পারিনা তাদের সিয়াম পালনে খানিকটা সাহায্য করতে? এভাবে আল্লাহকে খুশি করতে?

—————————-
হঠাৎ একদিন
সাদিয়া জান্নাতি

মে ২৮, ২০১৮ইং