হাজার মাসের চেয়েও উত্তম

চোখের পলকে চলে গেল পবিত্র রামাদানের বিশ দিন। শুরু হবে এবার আসল মিশন- লাইলাতুল কদরের খোঁজ।

লাইলাতুল কদরের মর্যাদা ও ফযীলাত:

আরবি ‘লাইলাতুল’ অর্থ হলো রাত এবং ‘কদর’ শব্দের অর্থ সম্মান কিংবা ভাগ্য- উভয়ই। সুতরাং ‘লাইলাতুল কদর’ (لَيْلَةِ ٱلْقَدْرِ) হলো সম্মানিত ও মহিমান্বিত এক রাত, যাতে মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়। ফার্সিতে একেই বলা হয় ‘শবে কদর’।

লাইলাতুল কদরে ইবাদত করার মহান ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে উভয়ই কুরআনে ও হাদীসে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উল্লেখ করেছেন যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে ও প্রতিদানের আশায় লাইলাতুল কদরে নামায পড়বে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে, সুবহান আল্লাহ!

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন:

إِنَّآ أَنزَلْنَٰهُ فِى لَيْلَةِ ٱلْقَدْرِ

নিশ্চয়ই আমি এ (কুরআন) কে অবতীর্ণ করেছি মর্যাদাপূর্ণ রাত্রিতে (শবে কদরে)। (আল-কদর, ৯৭:১)

অর্থাৎ, এই রাতে কুরআন অবতীর্ণ আরম্ভ করেছেন। অথবা তা ‘লাওহে মাহ্ফূয’ হতে দুনিয়ার আসমানে অবস্থিত ‘বাইতুল ইযযাহ’তে এক দফায় অবতীর্ণ করেছেন। আর সেখান থেকে প্রয়োজন মোতাবেক নবী (সাঃ) এর উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং তা ২৩ বছরে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। (তাফসীর বায়ান)

এ সূরাতেই ‘লাইলাতুল কদর’ কে আল্লাহ তাআলা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম বলেছেন। অর্থাৎ এই এক রাতের ইবাদত এক হাজার বছর অর্থাৎ ৮৩ বছর ৪ মাসের ইবাদত অপেক্ষাও শ্রেয়! একবার ভেবে দেখুন, রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত স্বল্পায়ুর হওয়া সত্বেও কি অপরিসীম সাওয়াব অর্জন করার সুযোগ পাচ্ছে! সুবহানাল্লাহ।

এই সুবর্ণ সুযোগের রাতটি রামাদান মাসেই এসে থাকে; অন্য কোন মাসে নয়। কারণ মহান আল্লাহ বলেছেন-

شَہۡرُ رَمَضَانَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ فِیۡہِ الۡقُرۡاٰنُ ہُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الۡہُدٰی وَ الۡفُرۡقَانِ

“রমাদান মাস, এতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের হেদায়াতের জন্য এবং হিদায়াতের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী রূপে।” (আল-বাকারা:১৮৫)

পবিত্র কুরআনেই আরেক জায়গায় আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন-

فِیۡہَا یُفۡرَقُ کُلُّ اَمۡرٍ حَکِیۡمٍ

“সে রাতে প্রত্যেক চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত স্থির হয়।” (সূরা দুখান- ৪)

অর্থাৎ এ বছর যেসব তাকদীর সংক্রান্ত বিষয় প্রয়োগকৃত হবে, সেগুলো লওহে মাহফুয থেকে নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে দেয়া হবে। নতুবা আসল বিধি-বিধান আদিকালে হতেই লিপিবদ্ধ।
[ইমাম নববী: শারহু সহীহ মুসলিম, ৮/৫৭]

হাদিসেও এসেছে এ রাতের মাহাত্ম্য এর বর্ণনা-

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে তিনি বলেন: “যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে এবং প্রতিদানের আশায় লাইলাতুল কদরে নামায পড়বে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।”
[সহীহ বুখারী (১৯০১) ও মুসলিম (৭৬০)]

★ কোন রাতটি লাইলাতুল কদর:

ঠিক কোন রাতটি লাইলাতুল কদর তা নিয়ে আলেমদের মাঝে বিভিন্ন অভিমত রয়েছে। ‘ফাত্হুল বারী’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে এ সংক্রান্ত অভিমত ৪০ টির উপরে পৌঁছেছে।

হাদীস অনুযায়ী এ রাতটি রামাদানের শেষ দশকে। আর এটি রামাদানের বেজোড় রাতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লামবলেছেন: “রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাত গুলোতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান কর।”
[সহীহ বুখারী (২০১৭) ও সহীহ মুসলিম (১১৬৯), তবে শব্দচয়ন ইমাম বুখারী]

আবার অনেকের মতে রামাদানের ২৭ এর রাত লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী।

হাদীসে আছে :
উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, তিনি বলেন যে, আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি যতদূর জানি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে যে রজনীকে কদরের রাত হিসেবে কিয়ামুল্লাইল করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা হল রামাদানের ২৭ তম রাত। (মুসলিম)

কদরের রাত হওয়ার ব্যাপারে সম্ভাবনার দিক থেকে পরবর্তী দ্বিতীয় সম্ভাবনা হল রামাদানের ২৫ তারিখ, তৃতীয় হল ২৯ তারিখে। চতুর্থ হল ২১ তারিখ। পঞ্চম হল ২৩ তারিখের রজনী।

সর্বশেষ আরেকটি মত হল- মহান এ রাতটি আসলে পরিবর্তনশীল। অর্থাৎ প্রতি বৎসর একই তারিখে বা একই রাতে তা হয় না এবং শুধুমাত্র ২৭ তারিখেই এ রাতটি আসবে তা না। আল্লাহর তাঁর ইচ্ছায় কোন বছর তা ২৫ তারিখে, কোন বছর ২৩ তারিখে, কোন বছর ২১ তারিখে, আবার কোন বছর ২৯ তারিখেও হয়ে থাকে।

অতএব, কারো পক্ষে নির্দিষ্ট কোন রাতের ব্যাপারে এ নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব না যে, এটিই ‘লাইলাতুল কদর’। বিশেষ করে, যখন আমরা জানি যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটি কোন রাত তা সুনির্দিষ্টভাবে উম্মতকে জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে তিনি জানিয়েছেন যে, আল্লাহ তাআলা এর জ্ঞান উঠিয়ে নিয়েছেন। হাদিসে আছে-

উবাদা ইবনে সামিত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম ‘লাইলাতুল কদর’ এর ব্যাপারে খবর দিতে বের হলেন।এ সময় দু’জন মুসলমান ঝগড়া করছিলেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন :

“আমি তোমাদেরকে ‘লাইলাতুল কদর’ এর ব্যাপারে অবহিত করতে বের হয়েছিলাম। কিন্তু অমুক অমুক ব্যক্তি বিবাদে লিপ্ত হওয়ায় তা (সেই জ্ঞান) উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। আশা করি উঠিয়ে নেয়াটা তোমাদের জন্য বেশি ভাল হয়েছে। তোমরা সপ্তম (২৭ তম), নবম (২৯ তম) এবং পঞ্চম (২৫ তম) তারিখে এর সন্ধান করো।”
[সহীহ বুখারী (৪৯)]

এই রাতটি গোপন রাখার পেছনে মূল রহস্য হল মুসলমানদেরকে রামাদানের শেষ দশকের সবগুলো রাতে বেশি বেশি ইবাদত, দোয়া ও যিকিরের উপর সক্রিয় রাখা। একই রহস্যের কারণে জুমার দিনের যে সময়টিতে দোয়া কবুল হয় তা সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি।

★ লাইলাতুল কদরের আলামত:

সে রাতের কিছু আলামত হাদীসে বর্ণিত আছে। সেগুলো হল :

(১) রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না।
(২) ঐ রাতে গরম বা শীতের তীব্রতা থাকবে না।
(৩) মৃদু বাতাস থাকবে।
(৪) সে রাতে ইবাদত করে অপেক্ষাকৃত অধিক তৃপ্তিবোধ করবে।
(৫) কোন ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ স্বপ্নে আগে থেকেই জানিয়েও দিতে পারেন।
(৬) ঐ রাতে হালকা বৃষ্টি হতে পারে।
(৭) সকালে হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্য উঠবে, যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মত।
(সহীহ ইবনু খুযাইমাহ- ২১৯০, বুখারী- ২০২১, মুসলিম- ৭৬২ নং হাদীস)

★ লাইলাতুল কদর এর বিশেষ নামাজ ও গোসল:

লাইলাতুল কদরের নামাজের ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ নিয়ত, রাকাত সংখ্যা বা পদ্ধতি নেই। আমাদের দেশে যা যা প্রচলিত আছে সব বানোয়াট। এছাড়া এ রাতে বিশেষ গোসল করার হাদীসটিও জাল।

★ রমাযানের শেষ দশ রাতে রাসূল (সাঃ) এর ইবাদত:

রামাদানের প্রথম ২০ রাত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরো রাত জাগতেন না। কিছু সময় ইবাদত করতেন, আর কিছু সময় ঘুমিয়ে কাটাতেন। কিন্তু রামাদানের শেষ দশ রাতের পুরো অংশটাই ইবাদত করে কাটাতেন। সে সময় তিনি কুরআন তিলাওয়াত, সলাত আদায়, সদাকা প্রদান, যিকর, দু‘আ, আত্মসমালোচনা ও তাওবাহ করে কাটাতেন।

হাদীসে এসেছে সে সময় তিনি শক্ত করে তার লুঙ্গি দিয়ে কোমর বেধে নিতেন। এর অর্থ হল, রাতগুলোতে তাঁর সমস্ত শ্রম শুধু ইবাদতেই নিমগ্ন ছিল। নিজে যেমন অনিদ্রায় কাটাতেন তাঁর স্ত্রীদেরকেও তখন জাগিয়ে দিতেন ইবাদত করার জন্য।

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত: “শেষ দশক প্রবেশ করলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোমর বেঁধে নামতেন। তিনি নিজে রাত জাগতেন এবং তাঁর পরিবারবর্গকে জাগিয়ে দিতেন।”
[সহীহ বুখারী (২০২৪) ও সহীহ মুসলিম (১১৭৪)]

আবার কদরের রাতের ইবাদতের সুযোগ যাতে হাতছাড়া হয়ে না যায় সেজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ দশদিনের পুরো সময়টাতে ইতেকাফরত থাকতেন। (মুসলিম- ১১৬৭)

★ রমাযানের শেষ দশ রাতে আমাদের ইবাদত:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে এ রাত কাটাতেন এর পূর্ণ অনুসরণ করাই হবে আমাদের প্রধান টার্গেট। এ লক্ষ্যে আমাদের নিম্নবর্ণিত কাজগুলো করা আবশ্যক :

(১) নিজে রাত জেগে ইবাদত করা এবং অন্যান্যদেরকেও জাগিয়ে ইবাদতে উদ্বুদ্ধ করা।

(২) অর্থসহ কুরআন তিলাওয়াত করা। সম্ভব হলে তাফসীর সহ।

(৩) লম্বা সময় নিয়ে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ পড়া। এসব সালাতে কিরাআত ও রুকু-সিজদা লম্বা করা। রুকু থেকে উঠে এবং দুই সিজদায় মধ্যে আরো একটু বেশী সময় অতিবাহিত করা, এসময় কিছু দু‘আ আছে সেগুলে পড়া।

(৪) সিজদায় বেশি বেশি দু‘আ করা। কেননা সিজদাবনত অবস্থায় মানুষ তার রবের সবচেয়ে নিকটে চলে যায়। ফলে তখন দু‘আ কবুল হয়।

(৫) বেশী বেশী তাওবা করা, আস্তাগফিরুল্লাহ পড়া। শির্ক, সগীরা ও কবীরা গোনাহ থেকে মাফ চাওয়া।

(৬) বেশি বেশি যিকর করা, নিরবে ও একাকী। এভাবে যিকর করার জন্যই আল্লাহ কুরআনে বলেছেন :

“সকাল ও সন্ধ্যায় তোমার রবের যিকর কর মনে মনে বিনয়ের সঙ্গে ভয়ভীতি সহকারে এবং জোরে আওয়াজ না করে। এবং কখনো তোমরা আল্লাহর যিকর ও স্মরণ থেকে উদাসীন হয়ো না।” (আরাফ : ২০৫)

(৭) একাগ্রচিত্তে ও বার বার দু‘আ করা। আর এসব দু‘আ হবে বিনম্র চিত্তে কবুল হওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে। দু‘আ হবে নিজের ও আপনজনদের জন্য, জীবিত ও মৃতদের জন্য, ক্ষমা ও রহমত লাভের জন্য, দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের কল্যাণের জন্য।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রাতে নিম্নের দু‘আটি বেশী বেশী করার জন্য উৎসাহিত করেছেন :

اللّٰهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّيْ

অর্থ- হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাকারী, তুমি মাফ করতেই পছন্দ কর, অতএব তুমি আমাকে মাফ করে দাও
(আল্লাহুম্মা ইন্নাকা ‘আফুউন, তু’হিব্বুল ‘আফওয়া, ফা’ফু ‘আন্নী)
[সুনান ইবনে মাজাহ, বই ৩৪ , হাদিস ২৪]

★ মাসিক অবস্থায় নারীর ইবাদত:

যেহেতু যে নারীর মাসিক শুরু হয়েছে তার জন্য সলাত আদায় করা নিষিদ্ধ তাই তিনি , সলাত ব্যতীত অন্য সব ইবাদত করার জন্য রাত জাগতে পারেন।যেমন:

১। কুরআন তেলাওয়াত: অধিকাংশ আলেমের মতে, মাসিক অবস্থায় পুরা আরবি মুসহাফ ব্যতীত যে কোনো কুরআন পড়া যাবে, যেমন- অর্থ সহ আরবি কুরআন কিংবা শুধু বাংলা কুরআন।

২। যিকির করা: যে নারীর মাসিক শুরু হয়েছে তিনি বেশী বেশী সুবহানাল্লাহ, আলহামদু লিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, সুবহানাল্লাহি ওয়াবি হামদিহি ওয়া সুবহানাল্লাহিল আযিম পড়তে পারেন।

৩। ইস্‌তিগফার করা: তিনি বেশি বেশি ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’(আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি) পাঠ করতে পারেন।

৪। দোয়া করা: তিনি আল্লাহ তাআলার কাছে বেশি করে দোয়া করতে পারেন এবং তাঁর কাছে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ প্রার্থনা করতে পারেন।

৫। সাদকা করা: বেশি বেশি সাদকা করার মাধ্যমে নিজের ও অন্যের কল্যাণ সাধন করা সম্ভব।

এগুলো ছাড়াও তিনি লাইলাতুল কদরে অন্যান্য যে কোন ইবাদত পালন করতে পারেন।

★ রাসূলের ইতিকাফ:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার রামাদানের প্রথম দশদিন ইতিকাফ করেছিলেন; তারপর মাঝের দশদিন ; এরপর তাঁর কাছে প্রতীয়মান হয়েছিল যে, লাইলাতুল ক্বদর শেষ দশকে। এর পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি শেষ দশকে ইতিকাফ করে গেছেন। একবার তিনি শেষ দশকে ইতিকাফ করতে পারেননি। তাই শাওয়াল মাসে সেটার কাযা পালন করেছেন। শাওয়াল মাসের প্রথম দশকে তিনি ইতিকাফ করেছেন।
[সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম]

যে বছর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যু হয়েছে সে বছর তিনি ২০ দিন ইতিকাফ করেছেন।
[সহিহ বুখারী (২০৪০)]

এর কারণ সম্পর্কে বলা হয় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর আয়ু শেষ হয়ে আসার বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন; তাই তিনি নেকীর কাজ বেশি করতে চেয়েছেন। তবে আরো মজবুত অভিমত— কারণ আগের বছর তিনি মুসাফির ছিলেন। এর সপক্ষে প্রমাণ করে নাসাঈ, আবু দাউদ ও ইবনে হিব্বান প্রমুখ কর্তৃক সংকলিত উবাই বিন কাব (রাঃ) এর বর্ণিত হাদিস; হাদিসটির ভাষ্য আবু দাউদের:

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাদানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। একবছর তিনি সফরে থাকায় ইতিকাফ করেননি। তাই পরের বছর তিনি বিশদিন ইতিকাফ করেছেন।” [ফাতহুল বারী]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছোট আকৃতির তাবু পাতার নির্দেশ দিতেন। মসজিদে তার জন্য এটি পাতা হত। তিনি তাতে অবস্থান করতেন এবং মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে তাঁর রবের অভিমুখী হতেন। যাতে করে নির্জনতার বাস্তব রূপ পূর্ণ হয়। একবার তিনি তুর্কি তাবু (ছোট তাবু)-তে ইতিকাফ করেছেন এবং তাবুর মুখে একটা ছাটাই দিয়ে রেখেছিলেন।
[সহিহ মুসলিম (১১৬৭)]

তিনি সারাক্ষণ মসজিদে অবস্থান করতেন। শুধু প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ থেকে বের হতেন না। আয়েশা (রাঃ) বলেন: “যখন তিনি ইতিকাফে থাকতেন তখন প্রয়োজন ছাড়া বাসায় আসতেন না।”
[সহিহ বুখারী (২০২৯) ও সহিহ মুসলিম (২৯৭)] মুসলিমের অপর এক রেওয়ায়েতে আছে: “মানবিক প্রয়োজন ছাড়া”।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ অবস্থায়ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করে চলতেন। তিনি আয়েশা (রাঃ) এর কামরার দিকে মাথা ঢুকিয়ে দিতেন। আয়েশা (রাঃ) তাঁর মাথা ধুয়ে চিরুনি করে দিতেন। হাফেয ইবনে হাজার বলেন, এ হাদিসে মাথা আঁচড়ানোর অধিভুক্ত হিসেবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সুগন্ধি ব্যবহার, গোসল করা, মাথা মুণ্ডন করা, পরিপাটি হওয়া ইত্যাদি জায়েয হওয়ার পক্ষে প্রমাণ রয়েছে।

আয়েশা (রাঃ) বলেন: “ইতিকাফকারীর জন্য সুন্নত হল— রোগী দেখতে না যাওয়া, জানাযার নামাযে না যাওয়া, কোন নারীকে স্পর্শ না করা ও শৃঙ্গার না করা এবং একান্ত যে প্রয়োজনে বের না হলে নয়; এমন প্রয়োজন ছাড়া বের না হওয়া।”
[সুনানে আবু দাউদ (২৪৭৩), আলবানী হাদিসটিকে সহিহ সুনানে আবু দাউদ গ্রন্থে সহিহ বলেছেন]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী সাফিয়্যা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাদানের শেষ দশকে মসজিদে ইতিকাফ করা কালে তিনি তাঁর সাথে দেখা করতে আসেন। তিনি কিছু সময় তাঁর সাথে কথা বলেন। এরপর চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ান। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তাকে পৌঁছে দেয়ার জন্য তা সাথে উঠে দাঁড়ান।
[সহিহ বুখারী (২০৩৫) ও সহিহ মুসলিম (২১৭৫)]

★ নারীদের ইতিকাফ

এ নিয়ে আলেমগণ এর ভিতর মতভেদ রয়েছে। অনেকের মতে মেয়েদের ইতিকাফ ঘরের ভিতর, নিরিবিলি স্থানে। যেমনটা বলা হয়েছে-

“মহিলাগণ তাদের ঘরে নামাযের স্থানে ইতিকাফ করবেন। তাদের জন্য মসজিদে ইতিকাফ করা জায়েয নয়। ঘরে নামাযের জন্য পূর্ব থেকে কোনো স্থান নির্দিষ্ট না থাকলে তা নির্দিষ্ট করে নিবে। অতপর সেখানে ইতিকাফ করবে।”
(ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২১১)

“যে মহিলার স্বামী বৃদ্ধ, অসুস্থ বা তার ছোট ছেলে-মেয়ে আছে এবং তাদের সেবা-শুশ্রূষা করার কেউ নেই, তার জন্য ইতিকাফের চেয়ে তাদের সেবাযত্ন করা উত্তম। মাসিক অবস্থায় ইতিকাফ করা সহীহ নয়।
(আলবাহরুর রায়েক ২/২২৯; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২১১)

“মহিলাগণ তাদের ইতিকাফের নির্দিষ্ট স্থান থেকে বিনা ওজরে ঘরের অন্যত্র যেতে পারবেন না। গেলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে।”
(বাদায়েউস সানায়ে ২/২৮৪)

আবার অনেক আলেমের মতে পুরুষ ও নারী উভয়ের ইতিকাফ মসজিদে হবে। মসজিদে না করতে পারলে বা অসুবিধা থাকলে ইতিকাফ করার দরকার নেই।

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে একদা এই (ঘরে ইতিকাফ করার) বিষয়ে জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেন, “এটা একটি বিদআত।” আল-নাওয়ায়িও এমনটাই বলেছেন-

“কোন পুরুষ বা মহিলার জন্য মসজিদ ব্যতীত কোথাও ইতিকাফ করা বৈধ নয়, তা সে তার নিজের বাসার মসজিদ বা কোথাও সালাতের জন্য পৃথককৃত জায়গাই হোক না কেন।” [আল মাজমু’ (৬/৫০৫)]

তাছাড়া আলেমদের মতে ঘরে ইতিকাফের বৈধতা থাকলে উম্মুল মুমিনিনগণ একবার হলে তা করতেন।

অবশ্য মসজিদে ইতিকাফ করার ক্ষেত্রে আলেমগণ নিম্ন লিখিত বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে বলেছেন-

১. মহিলাদের মসজিদে ইতিকাফ করা বৈধ, শুধুমাত্র যদি না ফিতনার আশঙ্কা থাকে।

২. নারী তার স্বামীর অনুমিত ব্যতীত ইতিকাফ করবে না, এতে কারো ইখতিলাফ নেই। যদি সে স্বামীর ‎অনুমতি ব্যতীত ইতিকাফ করে, তাহলে স্বামীর অধিকার রয়েছে তার ইতিকাফ ভঙ্গ করানো। ইতিকাফের অনুমতি দেওয়ার পর স্বামী যদি কোনো কারণে তার ইতিকাফ ভাঙতে চায়, তাহলে তার অধিকার রয়েছে।

৩. ইতিকাফ আরম্ভ করে প্রয়োজন হলে তা ভঙ্গ করা বৈধ।‎

৪. স্বামীর জন্য নিজ স্ত্রী ও পরিবারকে আদব শিক্ষা দেওয়া, তাদের সংশোধন করা জায়েজ।

৫. যদি ইতিকাফকারী নারীর মাসিক আরম্ভ হয়, তাহলে তার ইতিকাফ ভেঙে যাবে, সে মসজিদ ত্যাগ করবে, অতঃপর পবিত্র হয়ে পূর্বের ইতিকাফ শুরু করবে।

৬. যদি কেউ নফল ইবাদতের নিয়ত করে, কিন্তু এখনো তা শুরু করেনি, তাহলে সে তা একেবারে ত্যাগ করতে পারে, আবার ইচ্ছা করলে পরবর্তীতে আদায় করা বৈধ।

সঠিক পন্থা সম্বন্ধে আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।


প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, হাজার বছরের থেকেও উত্তম এই রাত যেন হেলায় হারাবেন না। জীবনের শেষ রামাদান ভেবে আকুল হয়ে আল্লাহর কাছে কল্যাণ ও হিদায়াত চান- নিজের জন্য, পরিচিত সকলের জন্য, গোটা মুসলিম উম্মাহর জন্য।

মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে এই রাতে রাসূলের সুন্নাহ মোতাবেক সর্বোচ্চ ইবাদত করার এবং সকলকে ক্ষমা আদায় করে নেওয়ার তৌফিক দিন। আমিন।

হাজার মাসের চেয়েও উত্তম
বিনতে আব্দুল্লাহ

(৩০/০৫/১৯)