কল্পনা!

বই মেলায় এসেছি এক ঘণ্টার মতো। বেশ কয়েকটা প্রকাশনী ঘুরে এসেছি। কাগজের বই খুব কমই আছে। কাগজের তৈরি বই এখন দূর্লভ বস্তু। এর জায়গা দখল করেছে চুম্বকের বই।

হ্যাঁ, চুম্বক। প্রতিটি পৃষ্ঠা খুব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম চুম্বক দিয়ে তৈরি। এর উপর লেখার প্রক্রিয়া টা খুব সরল। অসংখ্য ছোট ছোট চুম্বকের উপর এম ই বি যন্ত্রের সাহায্যে সেই একই আকৃতির চুম্বক পৃষ্ঠার চুম্বকগুলোর সাথে বিপরীত মুখীভাবে বসানো হয়।

লেখনীর চুম্বকগুলোর আকর্ষণ ক্ষমতা যে পৃষ্ঠায় আছে সেটার সাথেই শক্তিশালী ভাবে আটকে থাকার ক্ষমতা রাখে। ফলে বিপরীত পৃষ্ঠার সাথে শক্তভাবে লেগে যেতে পারেনা,যাতে পৃষ্ঠা উল্টাতে অসুবিধা হয়৷

বইয়ের এই প্রক্রিয়া টি বানিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করার কারণ হলো কাগজ স্বল্পস্থায়ী। সহজেই ছিঁড়ে যায়। মাঝের কয়েক শতাব্দীতে বই বলতে মূলত মানুষের মাঝে ছিল মোবাইল ফোনের স্ক্রিন। সেই সময়ই কাগজে মুদ্রিত বইয়ের চাহিদা কমতে থাকে। গত শতাব্দীতে এই মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারকারীর সংখ্যা এতই বেড়ে যায় যে, এর তেজস্ক্রিয়তায় কোটি কোটি মানুষ মরণব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এই আকস্মিকতায় পৃথিবীর গবেষকেরা বিস্তর চিন্তাভাবনা করে মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার কমিয়ে আনতে ইবুক এর মাধ্যমে বই প্রকাশ, ক্রয় বিক্রয় বন্ধ করে দেন।

বলা বাহুল্য, মানুষের বই পড়ার চাহিদা সেই সময় হঠাৎ করেই প্রচুর বেড়ে যায়। কারণ সেই সময়ে মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছিল, বই পড়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময়কার মনীষীদের পরিশ্রম সফল হয়। কিন্তু ইবুক কাগজের বইয়ের তুলনায় কম দামী ও রক্ষণশীল হওয়ায় এই পদ্ধতিতেই বই প্রকাশ বেড়ে যায়। এই বই পড়া মোবাইল গেমসকেও হার মানায়। যা উপকারের সাথে ডেকে আনে সীমাহীন ক্ষতি। প্রচুর সময় ধরে ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখার কারণে তারা প্রায় অন্ধ হয়ে যায়।

বর্তমানে চুম্বক বই খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর জন্য যেকোনো অবস্থাতেই বই পড়া খুব সহজ হয়ে গিয়েছে। কেউ শুয়ে শুয়ে বই পড়লেও গ্র‍্যাভিটির কারণে বইয়ের পাতা নিচে নেমে পাঠকের পড়ার ব্যাঘাত ঘটাবেনা। কারণ এক পাতা অন্য পাতার সাথে যে বলে আটকে থাকে তা মহাকর্ষের তুলনায় বেশি কিন্তু মানুষ নিজের শক্তি দিয়ে সহজেই পাতা উল্টাতে পারবে। বইয়ের কভার পৃষ্ঠার তুলনায় বেশি সংখ্যক চুম্বক দিয়ে তৈরি।

এই বইগুলোর অক্ষত থাকার সম্ভাবনা কয়েকশ বছর। ফলে কোনো মূল্যবান বই হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ও কম। স্কুলের পাঠ্যবই ও এই পদ্ধতিতে মুদ্রিত। এমনকি খাতাও এই সূক্ষ্ম চুম্বকের সমন্বয়ে গঠিত। কলমে নির্দিষ্ট কয়েকটি ফোর্স সেট করা থাকে। প্রয়োজনীয় ফোর্সে আপনা আপনিই সেট হয়ে অতি ক্ষুদ্র চুম্বক বের হয়ে খাতার সাথে আটকে যায়। ফলে লেখা লেখকের হাতের লেখার অনুরূপ ই হয়।

বই মেলা থেকে বাসায় ফিরে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাঁদের পাহাড় নিয়ে বসেছি। আঠারো উনিশ শতকের বিখ্যাত বইগুলো ও এই চুম্বকীয় পদ্ধতিতে বাঁধাই করা হয়ে গেছে। ওহ হ্যাঁ, এটা ২৫২০ সাল। জনসংখ্যা বেড়ে ৩০ বিলিয়ন। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে মানুষ নেই।

একটি ঘরেই যেন সব কাজকর্ম সম্পন্ন করা যায় সেজন্য তৈরি হয়েছে ফিকলিং ম্যাটার। এর এক খণ্ড একটি সামসিন মেশিনে বসিয়ে সেখানে যা প্রয়োজন তা টাইপ করে ইনপুট করা হয়৷ দশ সেকেন্ডের মাঝে সেই কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি তৈরি হয়ে যায়। আমি সোফায় বসেছিলাম।

বেশ রাত হয়েছে৷ সোফার এক জায়গায় চাপ দিতেই সেটা আগের ফিকলিং ম্যাটারে ফিরে এলো। সামসিন মেশিনে এই ম্যাটারের খন্ড টি রেখে বিছানা ইনপুট দিতেই দশ সেকেন্ড পর সোফার জায়গায় বিছানা চলে এলো। শুয়ে পড়লাম।

সকাল ৮ টায় ঘুম থেকে উঠলাম। সূর্য উঠেছে সাতটায়। এখন দিন-রাতের দৈর্ঘ্য একদম ঠিক পঁচিশ ঘণ্টা। বিছানার পরিবর্তে রান্নাঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র চলে এলো। খাবার বানিয়ে খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

বাংলাদেশ এস্ট্রোফিসিক্স একাডেমির একজন গবেষক হিসেবে জয়েন করেছি বেশিদিন হয়নি। আমার কাজে প্রফেসর হারিস খুব খুশি। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কাজে তাঁকে সর্বোচ্চ আশানুরূপ ভাবে সাহায্য করতে পেরেছি। পাশাপাশি তিনিও আমার গবেষণায় প্রচুর সহযোগিতা করে চলেছেন।

আগামী সপ্তাহে প্ল্যানেট নাইনে যাচ্ছি কিছু পর্যবেক্ষণের জন্য। সাতদিন পর চলে আসবো। গতকাল একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণ অবলোকন করেছি৷ আমার ক্যাটাডিওপট্রিক টেলিস্কোপের মাধ্যমে এটাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে জানতে পেরেছি, এই এক্সপ্লোশন টি ২৫৭ আলোকবর্ষ দূরে সংঘটিত হয়েছে। অর্থাৎ ৮১০৪৭৫২ বছর আগে এটা হয়েছিল। এটি সম্পর্কে আরো কিছু অধ্যয়নের জন্য প্ল্যানেট নাইন উপযুক্ত স্থান৷ সেখানে আমার বেশ কিছু বন্ধু আছে৷

বর্তমানে যে পরিমাণ মানুষ রয়েছে,তাদের জন্য একটি উপযুক্ত স্থান খুঁজে বের করা আবশ্যকীয় কার্যক্রমে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহে মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেছে তিনশ বছর আগে। সৌরজগতের বাইরে ট্রাপিস্ট ওয়ান এর “ই” নামক গ্রহে ইতিমধ্যে বিভিন্ন রোভার স্পেসক্র‍্যাফট পাঠানো এবং সেখানে জীবন সম্ভাবনার বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। ২৬০০ এর মধ্যেই সেখানে মানুষের বসতি স্থাপন সম্ভব পর হয়ে যাবে।

এটুকু লিখেই থেমে গেলাম। ঘুমাতে যাওয়ার জন্য আম্মু ডাকছেন। ডায়েরি বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ভাবতে লাগলাম আসলেই কি এমন কিছু হবে? নাকি সবই আমার কল্পনা?

কল্পনা!
মাহিমা রহমান

জুন ২২, ২০১৯ইং