ফিরে আয়, প্লিজ!

-সিহিন্তা শরীফা

ক্লাস শেষে বাসায় ফিরে দেখি আমার ঘরে ছোট্ট একটা পাখির খাঁচা। ভেতরে কিউট এক জোড়া মুনিয়া পাখি ঘোরাঘুরি করছে। সেদিন ছিল আমার জন্মদিন। মার কাছ থেকে উপহার পাওয়া পাখিগু্লোর নাম দিলাম কিচির আর মিচির। সারাদিন ওদের খাবার দেয়া, মিনারেল ওয়াটারের বোতল কেটে ওদের খাবার আর পানির পাত্র বানিয়ে খাচায় সেট করা, বসে বসে ওদের কার্যক্রম দেখা – এসব করেই দিনটা পার করে দিলাম। পরের দিন ক্লাস থেকে ফিরে দেখি মিচিরকে কেমন যেন স্বাস্থবান মনে হচ্ছে! মানে মিচির নামের শুকনো-পাতলা পাখিটা হঠাৎ মোটা-তাজা হয়ে গেছে, সাইজেও আগের চাইতে বড়। পরে আসল ঘটনা জানলাম। তুই খাঁচার দরজা খুলে কী করতে গিয়ে একটা পাখি উড়ে চলে গিয়েছিল। চুপচাপ আরেকটা পাখি কিনে এনে রেখে দিয়েছিলি সেখানে।

মা যখন প্রথম জব করা শুরু করলেন, তুই তখন ছোট্ট একটা বাচ্চা। বাথরুমের ট্যাপ ছেড়ে পানির শব্দে ভয়ে চীৎকার করে কাঁদতিস। আমি তোর দেখাশোনা করতাম – চুল আচড়ে দেয়া থেকে শুরু করে ভাত মেখে দেয়া, মাছ বেঁছে দেয়া…। অনেক জেদী ছিলি, তোর সব জেদ সব রাগ আমি সহ্য করতাম। একা একা খেলার সময় আমি তোকে সময় দিতাম। A B C D , অ আ ক খ পড়াতাম। ধর্মের বই, গল্পের বই পড়ে শোনাতাম। আমার ঘাড়ে চড়ে সার্কাস সার্কাস খেলা ছিল তোর খুব পছন্দের একটা খেলা। আদর করে কত নামে তোকে ডাকতাম, মনে আছে তোর?

স্কুলে যখন ভর্তি হলি, ক্লাস থেকে বের হয়ে আমার ক্লাসের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতিস। ছোট্ট দুই হাতে চোখ মুছে ফুঁপিয়ে কাঁদতিস। বাসায় ফেরার সময় আমার জামা পেছন থেকে ধরে ধরে হাঁটতিস। একবার স্কুল ছুটির পর রাস্তায় ভীড়ের মাঝে হারিয়ে গেলি। তোকে খুঁজতে বেরোলাম রিকশায় করে। অনেকক্ষণ পর যখন সেই রিকশাওয়ালা বলল এভাবে পাওয়া যাবে না, মাইকিং এর ব্যবস্থা করেন – হাউমাউ করে কেঁদে দিয়েছিলাম আমি।

তোকে বলা হয়নি – পাঞ্জা লড়ার সময় আমি প্রত্যেকবার ইচ্ছে করেই হেরে যেতাম। তোর আঁকা ছবিগুলো কিসের ছবি এঁকেছিস না বুঝেই প্রশংসা করতাম। মা তোর উপর রেগে গেলে তোর পক্ষে সাফাই গাইতাম। তোকে আড়াল করে কখনো নিজের ঘাড়ে দোষ নিতাম। একসাথে তোর পছন্দের কিছু খেতে বসলে তোকে বেশি দিয়ে আমি কম নিতাম। ছোট্ট একটা ক্যান্ডি আমি তোকে না দিয়ে একা খেতে পারতাম না।

সেই তুই ধীরে ধীরে একদিন বড় হয়ে গেলি। আমার চাইতে লম্বা, হাতগুলোও আমার হাতের চাইতে বড়। আমাকে গীটার লেসন দিতিস যখন, তোর মত করে ধরতে পারতাম না বলে হাসতিস। বাসার পিসিতে তুই মিউজিক কম্পোজ করতিস আর আমি ভয়েস দিতাম। মনে আছে আমরা এফএল স্টুডিওতে লিংকিং পার্কের গান করেছিলাম? হা হা হা। জানিস, আমার জীবনে তুই একমাত্র মানুষ যাকে আমি তুই করে বলতাম!

সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে সব বদলে যাচ্ছিল। তুই বড় হয়ে গেলি। নতুন সব বন্ধু জুটলো। ওদের সাথেই কাটতে লাগলো দিনের বড় একটা অংশ। আমিও ভার্সিটিতে উঠে স্রোতে গা ভাসালাম।

ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়ছিল আমাদের চিন্তা-চেতনা, আইডিওলজিতে। একসময়ের নাস্তিক আমি সৃষ্টিকর্তাকে চিনতে পারলাম যেদিন, যখন তাঁর পাঠানো বিধানকে নিজের way of life হিসেবে মেনে নিলাম – অদ্ভুত এক আলোর পৃথিবী খুঁজে পেলাম যেন।

তারপর…কী থেকে কী হয়ে গেল! ছিটকে দু’জন দূরে সরে গেলাম যেন। ধরা ছোঁয়ার বাইরে, অনেক অনেক দূরে। আমার নতুন পৃথিবীতে শুরু করলাম নতুন জীবন। আর তুই হারিয়ে গেলি, ভেসে গেলি সেই পুরনো স্রোতে। কেমন যেন অচেনা হয়ে গেলি তুই।

এরপর বছরে এক কি দু’বার দেখা হতো আমাদের। তুই আর স্বাভাবিক হতে পারিসনি। সত্যের পথে আহবান জানিয়েছিলাম – গ্রহণ করতে পারলি না তুই। উল্টো আমার চোখের সামনে বিভ্রান্তির কালো গহবরে তলিয়ে যেতে লাগলি। নিকষ কালো পৃথিবীতে, অশান্তির জীবনটা বেঁছে নিলি। আর, আমার সাথে সব রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিলি।

তুই জানিস না আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি যেদিন ফেসবুকে আমাকে ব্লক করেছিলি। যখন তোর বদলে ফেলা নতুন নাম্বারটা আমাকে দেয়া হয়নি। যখন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আর বছরের পর বছর আমাদের দেখা হওয়া তো দূরের কথা – কথাও বলা হয় না আর। তুই জানিস না, মার কাছে ফোন করে এখনো তোর খোঁজ নিই আমি।

অসুস্থ হয়ে তুই হাসপাতালে ভর্তি। আমার ছোট ছোট বাচ্চাদের রেখে দেখতে যাওয়া সম্ভব ছিল না। দূর থেকে শুধু কেঁদেছি আর দুআ করেছি। সেই সত্ত্বার কাছে দুআ করেছি যার হাতে তোর প্রাণ। যার অনুমতি ছাড়া একটা নিঃশ্বাস ফেলা সম্ভব না। যিনি তোর, আমার আর সবকিছুর স্রষ্টা। সবকিছুর!

আমি তোকে বোঝাতে পারব না তোর জন্য আমার কত কষ্ট হয়। এখনো আগের মতই স্নেহ করি, ভালোবাসি। সেই আল্লাহর কাছে আমি তোর হিদায়াতের দুআ করি – যিনি তোর আর আমার মালিক। সত্যপথের সন্ধান করেছিলাম বলে যিনি আমাকে অন্ধকার থেকে আলোতে ফিরিয়ে এনেছিলেন।

তুইও ফিরে আয়। দেখবি, সুশৃঙ্খল এই জীবনধারায় শুধু শান্তি আর শান্তি। বড় বড় কষ্টগুলোকেও এখানে তুচ্ছ মনে হয়। যে কোন স্যাক্রিফাইস হাসিমুখে করা যায়। স্বার্থপরের মত শুধু নিজের জন্যে না – সত্যিকার অর্থে অপরের জন্য বাঁচা যায়।

জেনে রাখিস, একদিন এমন একটা সময় আসবে – প্রত্যেকটা কাজের হিসেব নেয়া হবে। প্রতিটা মানুষের মুখোশ উন্মোচিত হবে সেদিন। দেখবি কত কুৎসিত তোর চারপাশ – সৌন্দর্যের মিথ্যা আবরণে ঢাকা এই চাকচিক্যময় দুনিয়া। গান-বাজনা মনকে নিয়ন্ত্রণ করে। স্যাটানিক গানগুলো তো শুধুই শয়তানের পথে হাতছানি দেয়। নিজের অজান্তে তোর সত্ত্বাটা একসময় শয়তানের দাসত্ব বরণ করে ফেলে। এর থেকে বের হওয়া খুব কঠিনরে। কিন্তু একবার বেরিয়ে আসতে পারলে তোকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। দুনিয়ার জীবন একটাই। বিশ্বাস কর, সাময়িক ভালো লাগাগুলো আসলে ভ্রম ছাড়া কিছুই না। যদি তুই বুঝতিস!

আমার এই আহ্বান অস্বীকার করলে অনন্তকালের আগুনে জ্বলবি তুই, একথা ভাবতেই দুই দশক আগের সেই ছোট্ট নিষ্পাপ মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সময় আর সঙ্গ কতটা বদলে দেয় মানুষকে। কারো চোখ খুলে দেয়, আর কাউকে বানিয়ে দেয় চোখ থাকতেও অন্ধ।

একবার পেছন ফিরে চেয়ে দেখ ভাই, কত আকুল হয়ে ডাকছে তোর বোন! দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে সৃষ্টিকর্তার কাছে আত্মসমর্পণ কর। সব কষ্ট, সব বেদনা পেছনে ফেলে অসীম আনন্দের সেই বাগানে হাসিমুখে মৃত্যুহীন জীবন কাটাব আমরা।

ফিরে আয়, ভাই আমার!

……………………..……..

#রৌদ্রময়ী_খোলা_চিঠি