পোস্ট নাটাল ডিপ্রেশন, বেবি ব্লু ও ইসলাম

১.
শম্পা প্রথমবারের মতো মা হয়েছে। অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে ইমার্জেন্সী সি-সেকশানের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম, সাথে ব্রেস্ট ফীডিং নিয়ে স্ট্রাগল শম্পাকে মানসিকভাবে অনেক নাজুক করে দিয়েছে। অকারণে কান্না, কেমন এক হাহাকার বুকে, সন্তানের পরিচর্যা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা এমন সব ব্যাপার সব সময় শম্পার সাথে ঘটছে। চারদিকে অনেক মানুষ কিন্তু কেউ যেন শম্পাকে বোঝে না। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে শম্পার কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে যায়।

২.
রাবেয়ার বাচ্চা হয়েছে কয়েক মাস পার হয়েছে। প্রাথমিক শারীরিক ও মানসিক ধাক্কাটা সামলে উঠেছে – সবার কাছে এমন মনে হলেও রাবেয়া কেন যেন কোনকিছুতেই আনন্দ খুঁজে পায় না। এর সাথে যুক্ত হয়েছে অল্পতেই বিরক্তি, অহেতুক দুঃচিন্তা, মাত্রাতিরিক্ত সংবেদনশীলতা, ঘুমের সমস্যা, কান্না করা।

সেদিন বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রচন্ড রাগ ও বিরক্তিতে নিজের চুল কেটে ফেলে নিজেই অবাক হয়ে গেল। কারণ মা হওয়ার আগের রাবেয়া এমন কিছু করার কথা ভাবতেও পারত না। এই পরিস্থিতি থেকে রাবেয়াকে উদ্ধার করে তার জামাই, ইসলামিক কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে আর সাথে ছিলো ডাক্তারের মেডিকেশান।

৩.
উপরে বর্ণিত এই দুই ঘটনাকে আমরা প্রায় এক করে বেবি ব্লু আর নয়তো পোস্ট নাটাল ডিপ্রেশন বলে আখ্যায়িত করে ফেললেও আদতে দুইটা ভিন্ন জিনিস।

প্রতি পাচঁজনের মধ্যে চারজন মা বেবি ব্লুর এই ধাপটি পার করে। বেবি ব্লু সাধারণত কয়েক দিন থেকে শুরু করে দুই সপ্তাহ বা আরও কিছু সময় পর্যন্ত স্থায়ী হয়। আর পোস্ট নাটাল ডিপ্রেশন দেখা দিতে পারে প্রধানত সন্তান জন্মের প্রথম বছরের যে কোন সময়ে।

কোন কোন গবেষকের মতে প্রথম দুই বছরের যেকোন সময়ে হতে পারে। সাধারণত প্রতি সাতজনের মধ্যে একজন মা এই ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এক স্টাডিতে বলা হয়েছে এশিয়ান দেশগুলোতে পোস্ট নাটাল ডিপ্রেশনের এই হার ৬৫% এর চেয়েও বেশি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেবি ব্লু উপযুক্ত ভালোবাসা ও যত্নের অভাবে পোস্ট নাটাল ডিপ্রেশনের দিকে মোড় নেয়।

পোস্ট নাটাল ডিপ্রেশনের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলোঃ

১) শরীরে প্রেগন্যান্সি ও ডেলিভারির কারণে হরমোনাল তারতম্য; সাথে ভিটামিনের ঘাটতি

২) পূর্বে কোন ডিপ্রেশনের ইতিহাস থাকা

৩) পরিবার থেকে পর্যাপ্ত সাপোর্ট না পাওয়া

৪) দাম্পত্য সমস্যা

৫) ঘুমের স্বল্পতা সাথে বাচ্চা লালন পালনের মানসিক চাপ।

বাংলাদেশের কিছু মানুষের মধ্যে স্টাডি করে জানা যায় প্রায় ৩৫.২% মা এই পোস্ট নাটাল ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয় যার মধ্যে একটা প্রধান কারণ হলো স্বামী কর্তৃক পাওয়া শারীরিক ও মানসিক আঘাত [১]।

পোস্ট নাটাল ডিপ্রেশনকে মুসলিম সমাজে অনেকেই শয়তানের ওয়াসওয়াসা, জিনের প্রভাব কিংবা দুর্বল ঈমানের কারণ বলে পাশ কাটিয়ে যায়; কিংবা বলা যায় এটাকে একমাত্র কারণ প্রমান করার মাধ্যমে মাকে আরও বিষন্নতার দিকে ঠেলে দেয়। এইসময় শয়তানের ওয়াসওয়াসা অবশ্যই একটা নিয়ামক হিসেবে কাজ করে কিন্তু অন্য ব্যাপারগুলোও মাথায় রাখা জরুরি।

তাই পোস্ট নাটাল ডিপ্রেশনে পরিবারের সহযোগিতা এবং ডাক্তার বা কাউন্সিলরের পরামর্শ দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। এসবের বাইরে আমরা আরও কিছু পদক্ষেপ নিতে পারি যা আমাদের সাহায্য করবে এই ডিপ্রেশন থেকে বের হয়ে আসার জন্য।

১) খাবারের প্রতি যত্ন নেওয়া:

এই সময়ে বাচ্চার পাশাপাশি নিজের যত্ন নিতে শেখা খুব প্রয়োজন। শরীরে ওমেগা-৩ এর ঘাটতি অনেক সময় ডিপ্রেশনের কারণ হয়। এজন্য ওমেগা-৩ যুক্ত খাবার, যেমনঃ মাছ, আখরোট, ও ফ্লাক্সসিড খাওয়া উচিত। ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে সেরোটোনিন (serotonin) এর স্বল্পতাও প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। খেজুর এই স্বল্পতা পূরণে সাহায্য করে।

২) পরিবারের সাহায্য:

নিজের মনের কথা, দুঃখ, দুঃশ্চিন্তা অন্যের সাথে শেয়ার করা উচিত। আপনি শেয়ার করলে শ্রোতা হয়তো আপনাকে সমাধান দিতে পারবে কিংবা সমাধান দিতে না পারলেও এই বলাটাও আপনার জন্য মানসিক শান্তির কারণ হবে। নিজের ও বাচ্চার কাজে স্বামী কিংবা পরিবার পরিজনের সাহায্য নেওয়া এই সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চার ন্যাপি চেঞ্জ থেকে শুরু করে যেকোন কাজে অন্যের সাহায্য নিতে দ্বিধা করা উচিত না।

৩) নিজেকে সময় দিন:

মা হওয়ার পর আমরা প্রথমেই নিজের পছন্দের কাজ বাদ দিয়ে বসে থাকি যা একদমই উচিত না। বাচ্চার দেখাশোনার পাশাপাশি নিজের একান্ত পছন্দের কাজগুলো অল্প হলেও চালু রাখেন; তা হতে পারে লেখালাখি, ক্র্যাফটিং, বই পড়া কিংবা গার্ডেনিং।

খাবারের পাশাপাশি নিজের ঘুমের প্রতি যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। বাচ্চা হওয়া মানেই ঘরে বন্দী হওয়া না। বাচ্চাকে নিয়ে বাইরে হাঁটতে যাওয়া, পরিবারের সদস্যদের সাথে বাইরে খেতে যাওয়া, বাচ্চাকে পরিবারের কারো কাছে রেখে একান্ত নিজের কিছু সময় কাটানো – এসব কিছু অনেক সাহায্য করে এই বিষন্নতা থেকে বের হয়ে আসতে।

৪) বাস্তব লক্ষ্য নির্ধারন করাঃ

আমরা সবাই “পারফেক্ট মা” হতে চাই। তাই সন্তান জন্মের পরে প্রাথমিক ধাক্কায় হতাশ হয়ে যাই এই “পারফেক্ট মা” থেকে বিচ্যুত হওয়ায়। এই সময়ে বাস্তবসম্মত প্রায়োরিটি লিষ্ট তৈরি করে সেই অনুযায়ী কাজ করুন।

বাসা খুব গোছানো থাকতে হবে, টেবিলে দুই তিন পদের তরকারি থাকতে হবে, সবকিছু আগের মতো করে বাচ্চাও “পারফেক্টলি” লালন পালন করতে হবে এই চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিন। আপাতত বাচ্চা আর নিজের যত্নকে প্রাধান্য দিয়ে বাকী কাজ করার চেষ্টা করা উচিত।

এছাড়াও মুসলিম মায়েদের আরও দুটো খুব দরকারি কাজ করা উচিত –

১) আল্লাহ্‌র সাথে সম্পর্ক স্থাপন:

কুরআনে বলা হয়েছে, “আল্লাহর স্মরণই হচ্ছে এমন জিনিস যার সাহায্যে চিত্ত প্রশান্তি লাভ করে” [১৩:২৮]

তাই আল্লাহ্‌র সাথে সম্পর্কের প্রতি যত্নবান হওয়া খুব দরকারি। বেশী বেশী কুরআন পড়ুন আর পড়তে না পারলে তিলাওয়াত শুনুন। বেশী বেশী যিকির করুন। নামাজ ও সবরের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র কাছে সাহায্য কামনা করুন।

২) দোয়ার শক্তি:

দোয়া মুমিনের অস্ত্র আর এর শক্তি অপরিসীম। নিজের ভাষায় বলা ছাড়াও হাদীসে বর্ণিত খুব সুন্দর কিছু দোয়া আছে যা এই সময়ে বেশী বেশী পড়া উচিত –

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম বলেন, মুসিবতগ্রস্ত ব্যক্তির দোয়া হচ্ছে,

★”হে আল্লাহ! তোমারই রহমতের আকাঙ্ক্ষী আমি। সুতরাং এক পলের জন্যও তুমি আমাকে আমার নিজের উপর ছেড়ে দিয়ো না। তুমি আমার সমস্ত বিষয় সুন্দর করে দাও। তুমি ভিন্ন প্রকৃত কোন মা‘বুদ নেই।” আবু দাউদ : ৪৪২৬

★মুসনাদে আহমদে রয়েছে, ইবনে মাসউদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বলেন, যে কোন বান্দার দুশ্চিন্তা বা পেরেশানী হলে, সে যদি এ দোয়া পড়ে আল্লাহ তার দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী দূর করে দেবেন এবং তার পরিবর্তে দেবেন আনন্দ।

اللهم إني عبدك، وابن عبدك، وابن أمتك، ناصيتي بيدك، ماضٍ فيَّ حكمك، عدل فيَّ قضاؤك، أسألك بكل اسم هو لك سميت به نفسك، أو أنزلته في كتابك، أو علمته أحداً من خلقك، أو استأثرت به في علم الغيب عندك أن تجعل القرآن العظيم ربيع قلبي، ونور صدري، وجلاء حزني، وذهاب همّي. إلا أذهب الله همه وحزنه، وأبدله مكانه فرحًا”.

“হে আল্লাহ ! নিসন্দেহে আমি তোমার দাস, তোমার দাসের পুত্র ও তোমার দাসীর পুত্র। আমার ললাটের কেশগুচ্ছ তোমার হাতে। তোমার বিচার আমার জীবনে বহাল। তোমার মীমাংসা আমার ভাগ্যলিপিতে ন্যায়সংগত।

আমি তোমার নিকট তোমার সেই প্রত্যেক নামের অসীলায় প্রার্থনা করছি – যে নাম তুমি নিজে নিয়েছ। অথবা তুমি তোমার গ্রন্থে অবতীর্ণ করেছ, অথবা তোমার সৃষ্টির মধ্যে কাউকে তা শিখিয়েছ, অথবা তুমি তোমার অদৃশ্যের জ্ঞান দ্বারা নিজের নিকট গোপন রেখেছ, তুমি কুর’আনকে আমার হৃদয়ের প্রশান্তি কর, আমার বক্ষের জ্যোতি কর, আমার দুশ্চিন্তা দূর করার এবং আমার উদ্বেগ চলে যাওয়ার কারণ বানিয়ে দাও”। (মুসনাদে আহমদ ১/৩৯১)

আর হ্যাঁ বাবা হিসেবেও আপনার অনেক কিছু করণীয় আছে। বাচ্চার দেখাশোনার দায়িত্ব স্ত্রীর সাথে ভাগ করে নেওয়ার মাধ্যমে দেখবেন আপনার সাথে বাচ্চার এক অন্যরকম বন্ডিং তৈরি হবে। সাথে আপনার স্ত্রী একটু বিশ্রাম পাবেন যা তাঁকে মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে সাহায্য করবে।

স্ত্রীর যত্নের দিকে খেয়াল করুন; তাকে নিয়ে ঘুরতে যান; স্ত্রীকে তার মার্তৃত্ব সম্পর্কিত কাজের জন্য এপ্রিশিয়েট করুন; মাঝে মাঝে স্ত্রীর জন্য ফুল বা কোন ছোট উপহার এনে চমকে দিন। স্ত্রীর অস্বাভাবিক আচরণের জন্য তাঁকে দোষারোপ না করে তাঁকে সহানুভূতি দেখান; প্রয়োজনে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।

মনে রাখবেন “সুস্থ মা মানে সুস্থ সন্তান”।

১. https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC5417480/

————————————-
নাঈমা আলমগীর