এনফিলের লাঠি

একদিন অন্ধ ছেলেটি সমুদ্রের ধার দিয়ে হাঁটছিলো। হাতে ছিলো ফুলের নকশা কাটা মিশমিশে কালো বাঁকা লাঠি। এনফিলের লাঠি। যেদিন ও খুঁজে পেয়েছিলো ওর হারানো শব্দ সেদিন থেকেই এই লাঠিটা ওর নিত্যসঙ্গী। এনফিল এর যখন ভীষণ রকম একলা লাগে তখনই ও এমন শুনশান গভীর রাতে সমুদ্রের ধার ঘেঁষে হেঁটে বেড়ায় যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রবল ক্লান্তি ওকে আচ্ছন্ন করে। এরপর ও যখন বাড়ি ফিরে যায়, ওর দুচোখে নেমে আসে রাজ্যের ঘুম।

গ্রামটার নাম লিনসো হিল। লিনসো হিল ছিলো সবুজ রঙের ছোট বড় পাহাড়ে ঢাকা একটা অপার্থিব সুন্দর গ্রাম যার বাঁ পাশ ঘেষে গাঢ় নীল পানির সমুদ্র। গ্রামের মানুষগুলোকে তখনো কলুষতা স্পর্শ করে নি। পৃথিবী পঁচে যেতে তখনো বেশ বাকী ছিলো। সততা আর হিংসার যে বিপরীত কোন শব্দ থাকে তারা খুব একটা বুঝতো না।

এনফিল ছেলেটা থাকতো গ্রামের দক্ষিণ পাশের “ফ্রাংক টেইলরিং হাউজ” এর পেছনে যে ছোট বাড়িটা, সেই বাড়ির ছোট ঘরটাতে। এনফিলের বয়স সতেরো। ফ্রাংক এনফিলের চাচার নাম। ভীষন রাশভারী মানুষ। কিন্তু ভেতরটা শিশুদের মতই একেবারে নরম। এনফিল বাবা মা কে হারিয়েছে ওর যখন বয়স মাত্র দুই । এক প্রবল ঝড়ের রাতে বজ্রপাতে ওর বাবা যখন বিদ্যুৎতাড়িত, ওর মা দৌড়ে যায় ওর বাবাকে বাঁচাতে। শেষ পর্যন্ত উঠোনে শক্ত হয়ে পরে থাকে দুটো লাশ।
বাবা মা কেমন হয় ওর জানা নেই। বুঝ হবার পর থেকে আপন বলতে বোঝে চাচাকেই। যদিও এই অসম্ভব রাগী মানুষটাকে ও খুবই ভয় পায় আবার এও বোঝে চাচা তাকে অত্যধিক ভালোবাসেন। এমন একবেলা জীবনে আসে নাই যে বেলায় চাচা এনফিলকে ছাড়া খাবার খেয়েছেন। মধ্যবয়স্ক ফ্রাংক কখনো বিয়ে করেন নি। কেনো করেন নি তা নিয়ে গ্রামজুড়ে নানানরকম কল্প কাহিনী প্রচলিত কিন্তু সত্যিটা ফ্রাংক ছাড়া কেউ জানে না এমনকি এনফিলও না। দুই বছরের এনফিলকে রেখে যখন ওর বাবা মা চলে গেলেন ফ্রাংক তখনই সীদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিয়ে থা করবেন না।

উনি দর্জি মানুষ। এই গ্রামের মানুষদের কাপড় বলতে গেলে উনিই সেলাই করেন।মানুষ উনাকে নামে মাত্র মূল্য দেয়। উনি কিছু বলতেও পারেন না।

আগে বাড়ি গিয়ে গিয়ে অর্ডার নিয়ে আসতেন। কিন্তু এখন আর পারেন না। শরীরটা খুব একটা ভালো যায় না। তাই এনফিলকেই পাঠায় লোকের বাড়ি গিয়ে গিয়ে অর্ডার বুঝে আনতে। সেই থেকেই যত বিপত্তি। মেজাজ কতক্ষণ ঠিক রাখা যায়, ওর চাচা প্রায়ই ভাবেন।
এনফিলের প্রধান সমস্যা হলো ও মনে রাখতে পারে না। ওর চাচা সবার মত ওকেও স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু একবছর চেষ্টা করবার পর টিচাররা সকল আশা ভরসা ত্যাগ করে ওর চাচাকে জানিয়েছিলো নতুন কিছু শেখানোর সাথে সাথে এনফিল আগের সব কিছু ভুলে যায়। কোনভাবেই শেখানো যায় না। এরপর থেকে এনফিল বাসাতেই থাকতো আর চাচাকে বিভিন্ন জিনিস এগিয়ে পিছিয়ে দিতো।

চাচা অসুস্থ হবার পর থেকে এনফিল যখন থেকে অর্ডার নেয়া শুরু করে তখন থেকে অভিযোগ এর পাহাড় জমতে থাকে ফ্রাংক টেইলর এর বিরুদ্ধে। কারো কাপড় টাইট, কারো ডাবল সাইজের, কারো খাটো আবার কারো লম্বা।

অথচ এনফিল যখন একবাসা থেকে অর্ডার নিয়ে বের হতো পরবর্তী বাসায় ঢোকা পর্যন্ত জোরে জোরে বলতে থাকতো আগের মাপ গুলো যাতে ভুলে না যায়। কিন্তু পরের অর্ডার নিতে নিতে আগের অনেক কিছুই সে ভুলে যেতো। দিন শেষে চাচাকে এসে কোনরকম সব গুলো অর্ডার জমা দিলেও আসল মাপের সাথে এনফিলের বলা অর্ডারের থাকতো আকাশ পাতাল ফারাক। ফ্রাঙ্ক প্রায় সারাদিনই এনফিল কে বকাঝকা করতেন।

এক রবিবার সকালে এনফিল যখন অর্ডার নেয়ার জন্য ঘর থেকে বেরোবে তখন চাচা ওকে ডাকলেন। এনফিল রুমে ঢুকে দেখে চাচা বিছানায় শোয়া বেশ কাশছে।

-এনফিল।
-জি চাচা।
– কাল রাত থেকে শরীরটা বেশ খারাপ। টেবিলের উপর একটা চিঠি লেখা আছে। তুই এক কাজ কর রিভার্স হিলে যা। সেখান গিয়ে পার্কার বৈদ্যর কাছে চিঠিটা দিবি। এরপর সে যেই ওষুধ দিবে তা নিয়ে আসবি।
– জি চাচা। আজ অর্ডার নিতে যাবো না?
– সূর্য্য হেলে পড়ার আগে ফিরতে পারলে যাস্। ওষুধ নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত আসতে পারিস কিনা তার ঠিক নাই আবার অর্ডার। যা এখন।
এনফিল মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায়। আশেপাশের তিন গ্রামের মাঝে এই রিভার্স হিলেই একজন মাত্র বৈদ্য আছে।

এনফিল চিটিটা পকেটে ভরে দক্ষিণ দিক বরাবর হাঁটছিলো। রাস্তার দুপাশ ঘেঁষে সারি সারি পাইন গাছ। এনফিল হঠাত থমকে দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে একটা গাছের কাছে বসে পড়ে ও। অদ্ভুত সব পাখিরা ডাকছে। ডান দিকের গাছে বেয়ে একটা কাঠবিড়ালি নেমে এসেই দৌড়ে পালিয়ে গেলো। এনফিল এর পুরো শরীর আতংকে জমে গেছে। এনফিল ভুলে গেছে ও এইখানে ঠিক কেন এসেছে। এমন কি ওর পকেটের চিঠিটার কথাও মনে নেই। ও শুধু বুঝতে পারছে খুব জরুরী কিছু ও ভুলে গেছে। একবার ভাবলো বাড়ি ফিরে যাবে। গিয়ে চাচা কে জিজ্ঞেস করবে কেনো ওকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ফিরে গেলে চাচা অসম্ভব বকাঝকা করবে। তাই ও পাইন গাছটার নিচেই বসে রইলো। রাতে চাচা ঘুমিয়ে গেলে চুপিচুপি বাড়ি ফিরে যাবে।

দুপুর প্রায় পরে এসেছে। এনফিল এর প্রচণ্ড খিদা পেয়েছে। গলাও শুকিয়ে কাঠ। এমন সময় এক বৃদ্ধ লোক হেঁটে এনফিলের দিকে আসলেন।

– এই যে যুবক তুমি এখানে মন খারাপ করে বসে আছো কেন হে?
এনফিল কিছু বললো না।
– আমার নাম রিগারিতো। আমাকে বলতে পারো তোমার সমস্যার কথা। কে জানে তোমার কাজে আসতে পারি।
এনফিল বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললো ওর সমস্যার কথা। ঠিক কেনো এখানে এসেছে ওর মনে নাই। ও সারা জীবনের কথাও বললো যে ও প্রায়ই বিভিন্ন জরুরী জিনিস ভুলে যায়। কিছুতেই মনে করতে পারে না।

বৃদ্ধ লোকটা রহস্যময় হাসলো এনফিলের দিকে তাকিয়ে। বললো
-হে যুবক। তুমি ভাবো। ভাবো যখন সূর্য উঠেছিলো। এরপর যখন তুমি জেগেছিলে। ভাবতে থাকো। বিছানা থেকে উঠলে। এরপর পরিষ্কার হলে। সকালের খাবার খেলে….। ঠিক এমন করে ভাবতে থাকো। তোমার চোখ দুটো বন্ধ করো।

এনফিল চোখ বুজলো। ও ভাবতে থাকে। ওর রুম ওর চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ওর বিছানা। ও জেগে উঠেছে। বাথরুম গেলো। লাল যবের রুটি আর ল্যাসিনো নামের সবজি। রেডি হলো। ওর চাচা ওকে ডেকে পাঠালো। চাচা খুব করে কাঁশছে।

এনফিল প্রবল বিস্ময়ে চোখ খুললো। ওর সব মনে পড়েছে। সব। উত্তেজিত ভঙ্গীতে পকেটে হাত দিয়ে চাচার চিঠি খানা বের করলো।

– মি. রিগারিতো আমি খুঁজে পেয়েছি। আমার হারানো শব্দ আমি খুঁজে পেয়েছি। ‘পার্কার বৈদ্য’!! আমাকে উনার কাছে যেতে হবে। ওষুধ আনতে হবে।
চিৎকার করে বললো এনফিল। বৃদ্ধ লোকটি হাসলেন। তার হাতে থাকা নকশা কাটা কালো লাঠিটা এগিয়ে ধরলেন এনফিলের দিকে।
– এটা রাখো। হারিয়ো না। এটা তোমাকে মনে করিয়ে দেবে রিগারিতোর কথা।
এনফিল লাঠিটা নিয়েই ছুট দিলো পার্কার বৈদ্যর বাড়ির দিকে। পেছনে ফিরে তাকালো না।

এনফিল যখন বাড়ি ফিরেছে তখন সন্ধ্যে গড়িয়ে প্রায় রাত ছুঁই ছুঁই।

– চাচা ওঠো। আমি ওষুধ এনেছি। এখন থেকে আর অর্ডারে ভুল করবো না আমি। দেখে নিও। চাচা!
এনফিলের চাচা আর কোনদিন ওঠে নি। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান গুলো শেষে ক্লান্ত এনফিলে যখন একলা ঘরটাতে ফিরে এসেছে তখন গভীর রাত।

এনফিলের পরদিন খুব বেলা করে ঘুম ভাঙে। রাজ্যের আলস্য যেন ওর চোখের দুই পাতায় এসে জমেছে। এনফিল চোখ মেললো যখন তখন যদিও পড়ন্ত সকাল। তবু এনফিলের মনে হচ্ছে কুচকুচে কালো রাত। এনফিল কিছু দেখতে পাচ্ছে না। কিচ্ছু না। কিন্তু স্মৃতি গুলো মাত্র হয়ে যাওয়া বৃষ্টির পর পাইনের কচি পাতার মত তাজা। ও সব মনে করতে পারছে সব। ও আর কিচ্ছু ভুলবে না।