অবক্ষয়

-হাসনীন চৌধুরী

বর অফিস যাবার পর সক্কাল সক্কাল ডোর বেলের শব্দে বেশ চমকে উঠলাম! এ সময় সাধারণত বাসায় কেউ আসে না। আক্ষরিকভাবে বলতে গেলে আমাদের এখানে কখনোই কেউ আসে না। কারন নতুন এই দেশে আমাদের পরিচিত মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা যাবে। পুরানা আমলের হাইরাইয এ এপারটম্যান্টে দেশ বিদেশের নানা ভাষার রঙ বেরঙের মানুষজন থাকতো।

দিনের বেলা দরজা খুললেই নিচ থেকে আরবী ভাষার কলকাকলী শোনা যেতো, বলা বাহুল্য সেসব কিছুই আ্মার বোধগম্য হতো না। যে ক’দিন লেবানন ছিলাম কেবল আরবী একটি বাক্য শিখতে পেরেছিলাম, তা হল “কুল্লু খালাস”, যার অর্থ ‘সব শেষ”!

যা হোক মূল কাহিনীতে ফিরে আসি, দরজা খুলে দেখি মাঝ বয়েসী একজন ভদ্র মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। স্পষ্ট বাংলায় জিজ্ঞেস করলেন আমি বাঙালি না কি?

সিঁড়িতে বরের সাথে কথা বলছিলাম, বাংলা ভাষা শুনে উনি ছুটে এসেছেন। যতদূর জানতাম পুরো বিল্ডিঙ্গে আমরা একমাত্র বাঙালি পরিবার। কথায় কথায় জানা গেল উনি একজন গৃহ পরিচারিকা, উপর তলায় লেবানিজ পরিবারে কাজ করেন।

ভীনদেশে নিজ ভাষাভাষী কাওকে পেলে অন্যরকম আত্মার বন্ধন অনুভূত হয়। তাই উনাকে নিয়ে ঘরে বসালাম। মহিলার সাথে যতই কথা বাড়াতে লাগলাম, ততই মনে হতে লাগলো তিনি বোধহয় কিছুটা অপ্রকৃতস্থ! বাঙালি পেয়ে গড়গড় করে মনের যত জমে থাকা কষ্ট আছে, সব বলে দিতে লাগলেন।

এদেশে একবার এলে তিন বছরের আগে কেউ দেশে ফিরে যেতে পারে না। যেতে হলে নিজের পয়সায় টিকেট কেটে যেতে হয়, যা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। তাই শারীরিক, মানসিক শত অত্যাচার সহ্য করে হলেও অমানবিক তিনটি বৎসর তাদের কাটিয়ে দিতে হয়।

এ মহিলা দু বছর চার মাস আগে এ দেশে এসেছিলেন, এই ক’বছরে তার জীবন পুরো ওলট পালট হয়ে গেছে। গৃহকর্ত্রী নিয়মিত গায়ে হাত তুলতো। সেই সাথে গালাগালি তো ছিলোই।

এর মাঝে মহিলা খবর পান, তার স্বামী দেশে আরো একটি বিয়ে করেছে, বড় মেয়ের ঘর ভেঙ্গে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। বেচারী এতো সব ভয়ংকর খবর শোনার পরেও দেশে যেতে পারেন নি। তার পাঠানো কষ্টের অর্থ দিয়েই তার স্বামী আরেক মেয়ের সাথে বিয়ে করে আনন্দে দিন কাটাচ্ছিল।

এসব শুনে তিনি এখানে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়তে লাগলেন আর দিন গুনতে লাগলেন কবে আট মাস শেষ হবে ও দেশে যেতে পারবেন। জানি না, শেষপর্যন্ত দেশে যেতে পেরেছিলেন কি না কিংবা দেশে গিয়ে তার সংসার ফিরে পেয়েছিলেন কিনা।

লেবানন সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে প্রতিবছর এই মহিলার মতো অজস্র বাঙালী লেবার ভিসায় আসেন ও তাদের অধিকাংশই হন গৃহপরিচারিকা। মাসে মাত্র একশ থেকে দুশ ডলারের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এরা বিদেশে কাজ করতে আসেন। যদিও আজকাল ঢাকা শহরে দু তিনটে বাসায় ঠিকে কাজ করলেই এর কাছাকাছি উপার্জন করা যায়!

তবু বিদেশ গিয়ে অঢেল টাকা কামানোর এক অলীক স্বপ্নে বিভোর হয়ে এই নারীরা সংসার-আপনজন পেছনে রেখে অনিশ্চিত প্রবাসে পাড়ি জমান। এদের মাঝে কেউ কেউ ভালো থাকেন আবার অনেকেই শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের স্বীকার হন।

বাংলাদেশের এম্বেসি থেকে তারা কখনোই বলতে গেলে তেমন কোন সুরক্ষা পান না। এম্বেসির সাথে যোগাযোগ করা ঠিকানা বা যোগাযোগ করার মতো স্বাধীনতা বা শিক্ষাগত যোগ্যতাও বেশিরভাগ মহিলার থাকে না।

একবার লেবাননের এক গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম, সেখানে গ্রামের বাড়িতেও দেখেছিলাম তেরো চোদ্দ বছরের এক বাঙালি কিশোরী কাজ করতে এসেছে। আমি নিজে বাঙালি হয়ে সেদিন এমন অসহায় এক দেশী কিশোরীকে অচেনা দেশে ফেলে এসেছিলাম। তাকে কোন সাহায্যও করতে পারি নি।

গৃহপরিচারিকা ছাড়াও দোকানদার, মেথর, মিস্ত্রী ইত্যাদি শ্রম নির্ভর সকল ক্ষেত্রে বাঙ্গালিদের সংখ্যা লক্ষ্যনীয়। বাঙালি মানেই এখানে শ্রমিক, তাই পর্যটক হিসেবে কোন বাঙালি এখানে এসেছে দেখলে অনেকেই অবাক হয়।

এখানে হাই অফিশিয়াল বাঙালির সংখ্যা অত্যন্ত কম। আমরা যখন সেখানে ছিলাম, পুরো লেবাননে পরিবার সহ বসবাস করছে (লেবার ভিসায় আসে নি) এমন বাঙালি পরিবার ছিল সম্ভবত মাত্র পাঁচটি। যার ভেতর চারটি পরিবারই কাজ করতো জাতিসংঘে। আমাদের আতিক ভাই ছিলেন শ্রমিক ভিসায় আসা বাঙ্গালিদের নিকট বেশ আস্থাভাজন মানুষ।

আশ পাশের বাঙ্গালিরা তাদের নানা সমস্যায়, সালিশীতে প্রায়ই তার কাছে আসতো। আতিক ভাইদের থেকে আমরা প্রবাসী বাঙ্গালিদের সম্পর্কে এমন অনেক তথ্য জানলাম, যেগুলো বিশ্বাস করা আসলেই কষ্টকর ছিল!

বাংলাদেশীরা যখন শ্রমিক ভিসায় আসেন, তখন কোন কোম্পানী বা যাদের বাড়িতে কাজ করবেন, তাদের সাথে কন্ট্রাক্ট করতে হয়। কোন নির্দিষ্ট মানুষ/কোম্পানীর স্পন্সরশীপ পেলে তবেই এদেশে আসতে পারে। এবং অন্তত তিন বছর একই মালিকের কাছে কাজ করতে হয়। এরপর ভিসা রিনিউ করতে হয়, নতুবা দেশে ফিরে যেতে হয়।

আবার এর মাঝেও ব্যবসার গন্ধ আছে, অনেক বাঙালী তাদের স্পন্সসরদের সাথে চুক্তি করেন, মাসে নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ প্রদানের বিনিময়ে তাদের থেকে মুক্তি নেন। এর ফলে তারা স্বাধীনভাবে বাইরে বসবাস ও কাজ করা শুরু করতে পারেন। বিষয়টি অবৈধ হলেও এখানে এটি বেশ জনপ্রিয় পন্থা।

স্বাধীনভাবে বাইরে কাজ করার সুবিধার সাথে কিছু অসুবিধাও আছে। এক্ষেত্রে যেমন অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়, উপার্জনের একটি বড় অংশ স্পন্সরকে দিতে হয়, আবার সেই সাথে একাকীত্বের দরুন কারো কারো নৈতিক অবক্ষয়েরও সূচনা হয়। অনেক বাঙালি শ্রমিক সেখানে লিভ টুগেদার করা শুরু করে দেয়।

দেখা যায় তাদের হয়তো দেশে স্বামী/স্ত্রী, সন্তান আছে। কিন্তু বিদেশের জীবনে সংগীর অভাব কাটানোর জন্য বাংলাদেশী মহিলা ও পুরুষ একত্রে বাড়িভাড়া নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মতো বাস করতে থাকে। আবার চুক্তি শেষে তারা দেশে যখন চলে আসে, তখন যার যার স্বামী বা স্ত্রীর কাছেও অনেক সময় ফিরে যায়। পরিবারের লোকজন জানতেও পারে না, তাদের আপনজন বিদেশে কেমন জীবন যাপন করে এসেছে।

কেবল মাত্র লেবাননেই নয়, যেকোন দেশেই একাকী থাকলে ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব হলে এমন নৈতিক অবক্ষয় ঘটা প্রায় অনিবার্য। লেবানন থেকে ফিরে আসার সময় বিমানবন্দরে অনেক বাঙালি মহিলাকে দেখেছি, কয়েক বছর বিদেশে চাকরি করেই কাপড় চোপড় থেকে শুরু করে ব্যবহারে পর্যন্ত কেমন যেন শালীনতাহীন হয়ে গেছে! অথচ দু তিন বছর আগেও এরা হয়তো কারো ঘরের লাজনম্রর জননী বা বধু ছিল!

লেবাননে যত দিন ছিলাম অত্যাচারিত, দুঃখী প্রবাসী বাঙালি যেমন দেখেছি, কিছু সুখি মানুষের দেখাও পেয়েছিলাম। যেমন আমার বাসার সামনের দোকানের তরুনী সেলস গার্লটি ছিল সদাহাস্যময়ী।

তার পরিকল্পনা ছিল, সে এখান থেকে অর্থ জমিয়ে দেশে ফিরে যাবে। সেখানে তার পারিবারিক ভাবে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে বেসরকারি ভার্সিটিতে পড়ুয়া এক ছেলের সাথে। মেয়েটির চোখেমুখে সর্বদা থাকতো আনন্দের ঝিলিক ও সুন্দর ভবিষ্যতের প্রত্যাশা।

সেখানে আরো একটি সুখি দম্পতির সাথে পরিচয় হয়েছিল। আমরা যে সুপারস্টোরে গ্রসারি শপিং করতে যেতাম সেখানে তারা সেইলস এ ছিল। ভদ্রলোকের নাম ছিল মোহাম্মদ। মোহাম্মদ ভাই ও তার স্ত্রী বিয়ের পরই এখানে টাকা কামাতে চলে এসেছিলেন, তাদের স্বপ্ন কয়েক বছর পর বড় অঙ্কের অর্থ নিয়ে দেশে ফিরে যাবেন ও ব্যবসা করবেন।

একদিন মোহাম্মদ ভাই আমাদেরকে তাদের বাসায় দাওয়াত করেছিলেন। একটি বিল্ডিঙের চিলেকোঠায় তারা থাকতেন। সেখানে ভাড়া হিসেবে সেই দালানের সিঁড়ি ধুয়ে দিতে ও বাড়িওয়ালার টুকিটাকি কাজ করে দিতে হত। পলেস্তারা খসে পরা, ভাঙ্গা আসবাবে ভরা তাদের সংসার আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা শ্রীহীন মনে হলেও, উষ্ণ আপ্যায়ন ও দাম্পত্য সুখের ছোঁয়ায় ছোট্ট চিলেকোঠাটিও অপূর্ব হয়ে উঠেছিল।

ভূমধ্যসাগরের তীরের এই দেশটিতে থাকাকালীন সময়ে হরেক রকমের প্রবাসী বাঙালির সাথে পরিচয় হয়েছিল সত্যি, কিন্তু একটি ক্ষেত্রে সবার ভেতর বেশ বড় একটি মিল ছিল!

তারা সবাই অত্যন্ত স্বল্প অর্থের বিনিময়ে প্রাণান্ত পরিশ্রম করতো। কিন্তু এতো পরিশ্রমের পরেও অন্যান্য দেশের নাগরিকদের তুলনায় বাঙালি শ্রমিকেরা কম মজুরি পায় প্রায় সকল ক্ষেত্রে। কারন বাংলাদেশ থেকে একে তো অদক্ষ শ্রমিক পাঠানো হয়, তার উপর তাদের নিরাপত্তা বা সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য কোন উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া হয় না।

যদিও বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশের অন্যতম আয়ের উৎস। তবুও মনে করি অত্যন্ত বাধ্য না হলে, আপনজনদের এভাবে বিদেশে না পাঠানোই ভালো।

বিশেষ করে নারীদের কোনক্রমেই পাঠানো উচিৎ নয়! হয়তো অল্প কিছু মহিলার চারিত্রিক অবক্ষয় হয়, কিন্তু সিংহভাগ নারীরা যে কি পরিমান অনিরাপদ জীবন যাপন করেন সেখানে তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়।

সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়র নিজের কন্যা, স্ত্রী বা জননীকে এমন ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে পাঠানোর চেয়ে নিষ্ঠুরতা আর কিছুই হতে পারে না। এর পরিবর্তে দেশে থেকে স্বল্প আয়ের জীবিকা নির্বাহ করা, নিঃসন্দেহে ঢের নিরাপদ ও মানবিক।

#roudromoyee_probondho