-“শোন, আমি যা করি, দেখে দেখে করো। আল্লাহু আকবর বলার সাথে সাথে উঠাবসা করবে। ওকে?”
ফিসফিস করে কনফিউযড চেহারার পাশের জাপানিটিকে বললো মালয় মেয়েটি। মেমটিও জাপানি কায়দায় মাথা হেলিয়ে দুলিয়ে বুঝিয়ে দিলো, সে পারবে।
আর পেছন থেকে আমি এমন সন্দেহজনক কথাবার্তা শুনে অতি আগ্রহের সাথে তাদের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম। যাবতীয় বিচিত্র ঘটনায় আমার বরাবরই ব্যাপক আগ্রহ!
————**
সেদিন বিকেলে:
বহুদিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না, সেদিন আমরা ঠিক করলাম পুত্রাজায়া মসজিদ দেখে আসবো। সেখানে আসরের সালাত পড়ে এদিক সেদিক ঘুরে আবার বাসায় ফিরে আসবো।
এটি মালয়েশিয়ার অন্যতম প্রধান একটি মসজিদ, এর সামনেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। প্রচণ্ড রোদ পার হয়ে মসজিদ চত্বরে প্রবেশ করে আমার প্রায় মাথা ঘুরে যাবার দশা হলো! এতো বিশাল আর এতো সুন্দর!! হালকা গোলাপি কারুকার্য পুরো এলাকা জুড়ে।
মাটির নিচে বিশাল এলাকা জুড়ে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা ওযু খানা ও রেস্টরুম। উপরে স্যুভেনির শপ, খাবার দোকান। এককথায়, সে এক এলাহি কারবার।
এদেশের মসজিদগুলো আসলেই দেখার মতো। বাচ্চাকাচ্চা ও পরিবারের লোকজন কে নিয়ে সময় কাটানোর জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা এখানে থাকে। অনেক মসজিদেই ক্লাস রুম, ক্যান্টিন, দোকান পাট ইত্যাদি থাকে। চাইলে সারাদিন ও এসব জায়গায় সময় কাটানো যায়।
এতো কিছুর মাঝে যে ব্যাপারটি মসজিদের প্রতি মানুষকে সবচাইতে বেশী আকর্ষিত করে, আমার ধারণা সেই জিনিস টি হলো, অদ্ভুত এক প্রশান্তি। অদেখা এই ভালো লাগার জন্যই একবার প্রবেশ করলে আর বের হতে ইচ্ছে করে না।
পুত্রাজায়া মসজিদটি পুত্রাজায়া লেকের ওপর নির্মিত। একদিকে লেকের স্নিগ্ধ জলরাশি আর অপর দিকে মসজিদের বিশালত্ব দেখতে প্রচূর পর্যটক আসে এখানে।
মালয়েশিয়ার বড় বড় বেশিরভাগ মসজিদে গেলে প্রায় সারাদিনই দেখা যায় রঙ বেরং এর পর্যটকদের ভীড়। এদের একটা ব্যাপার আমার খুব ভালো লেগেছে, তারা অমুসলিমদেরকেও মসজিদ এলাকার ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়, সালাত দেখতে দেয়। এটাও তো একধরণের দাওয়া দেয়া!
যেমন অফিসিয়াল যত ট্যুরেই যাই আমরা, সবগুলোতে সালাতের সময় বাস ভর্তি মানুষ নিয়ে তারা মসজিদে দাঁড়িয়ে যাবে। লম্বা সময় ধরে মসজিদে বিশ্রাম নেবে, ক্যান্টিনে খাবে, জামাতে সালাত আদায় করবে।
যদিও আমাদের ট্যুরগুলোয় দেখা যায় আমরা হাতে গোনা কিছু মুসলিম থাকি আর বেশিরভাগই অমুসলিম থাকে। তবুও তাদেরকেও এই সময়টা বাধ্যতামূলক আমাদের সাথে কাটাতে হয়।
মসজিদের সাথে একটা ক্লোক রুম থাকে, সংক্ষিপ্ত পোষাক পড়া মানুষেদের সেখান থেকে আজানুলম্বিত জোব্বা দেয়া হয়। সেই জোব্বার সাথে মাথার জন্য হুডি লাগানো থাকে। হাফপ্যান্ট পড়া ছেলেদের জন্য লুংগিও থাকে অনেক মসজিদে।
তাই সুন্দর মাসজিদসমূহে গেলে একটি অতি কমন দৃশ্য হলো, জোব্বা পড়া বিদেশীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে ও ফটাফট ছবি তুলছে। বিদেশী মেমগুলো হয়তো জানতেও পারে না, তাদেরকে বোরকা জাতীয় কাপড় পড়ায় সাধারণ সময়ের চেয়েও সুন্দর লাগতে থাকে।
—–—–*
তবে অমুসলিমরা যতই জোব্বাজাব্বা পড়ুক না কেন, জামাতের সময় তারা সালাতের মাঝখান দিয়ে হাঁটাহাঁটি করে না। অন্যপাশে ঘুরতে থাকে। কিন্তু আজকের জাপানী মেয়েটি ব্যাতিক্রম।
মেয়েদের অংশে প্রবেশ করেই দেখি, সালাতের খিমার পড়ে মেয়েটি বাচ্চাদের মতোন উত্তেজিত হয়ে প্রায় দৌড়াচ্ছে, (এখানে সালাতের যায়গায় প্রচুর খিমার থাকে) যেনো জামাত মিস না হয়।
এবং তার আচরণেই বোঝা যাচ্ছে, এই প্রথম সে এধরণের কোন স্থানে এসেছে। আমিও তাড়াতাড়ি করে মেয়েটির কাছাকাছি দাঁড়ালাম, উদ্দেশ্য মেয়েটি আরো কি কি করে তা দেখা ও সম্ভব হলে তার সাথে কথা বলা।
আমি নিশ্চিত বাংলাদেশে হলে, কখনোই মেয়েটিকে জামাতে দাঁড়াতে দেয়া হতো না। কেউ টের পেলে দূরদূর করে তাড়িয়ে দেয়া হতো।
মোটামোটি নির্বিঘ্নে আমাদের দেখে উঠাবসা করলো জাপানি মেম। সালাম ফেরানোর পর, দেখি ট্যুরিস্ট গাইড মালয় মেয়েটি, তাকে সুন্দর করে বোঝাচ্ছে, সালাতের স্টেপগুলো আর খুঁটিনাটি। সেও অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে শুনছে।
ঠিক তখন আমার মনে হলো, এর সাথে কথা বলতেই হবে। আর এতো ভালোবেসে কথা বলতে হবে, যেনো তার জীবনের প্রথম মসজিদে আগমন এর সুখস্মৃতির অংশ হতে পারি।
তার হাত ধরে জিজ্ঞেস করলাম, “আজকেই কি প্রথম কোন মসজিদে এলে?” মেমটি প্রথমে একটু অবাক হলেও জবাব দিল, আজই প্রথম বার!
এবার তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “তোমাকে আমাদের মাঝে পেয়ে আমরা খুবই আনন্দিত হয়েছি, আশা করি আজ প্রথমবার হলেও, ইন শা আল্লাহ্ আরো অনেক বার আসবে।”
আরো জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন লাগলো আমাদের সালাত পড়ে?”
তার উত্তরে আমি সত্যিই লজ্জা পেলাম। মেয়েটির কথা আটকে যাচ্ছিলো। তার আনন্দ, প্রশান্তি, উত্তেজনা ও ভালোলাগা প্রকাশ করার মতো পর্যাপ্ত শব্দ সে খুঁজে পাচ্ছিলো না। চোখ মুখ জ্বলজ্বল করছিলো, হঠাত পাওয়া এই অপার্থিব ভালো লাগার উত্তেজনায়!
তার ভাষায় সে শুধু বোঝাতে পারলো যে অসম্ভব ভালো লেগেছে এখানে। এবং সেই অনুভূতিতে কোন কৃত্রিমতা ছিল না, বরং ছিল শিশুর সারল্য ও সত্য আবিষ্কারের আনন্দ!
আমার হঠাৎ মনে হলো, প্রতি ওয়াক্ত সালাতের পর তো আমাদের অনুভূতি এমন হওয়া উচিত। এ মেয়েটি এখনো মুসলমান হয় নি, অথচ সে সালাতের যে স্বাদ পেয়ে গেলো, আমরা কি মুসলমান হয়েও এই তৃপ্তি নিয়ে সালাত শেষ করি??
কোথাকার কোন জাপানি মেম আমাকে বেশ লজ্জা দিয়ে গেলো সেদিন।
জাপানিরা পৃথিবীর সবচাইতে ভদ্র জাতি। মেয়েটিকে আমার বলতে ইচ্ছা হচ্ছিলো, তোমরা জাপানীরা যদি মুসলমান হতে, দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মুসলিম জাতিতে পরিণত হতে। তাদের মাঝে ঈমান ছাড়া, একজন প্রকৃত মুসলিমের যেমন হওয়া উচিত তার প্রত্যেকটি গুণাবলী বিদ্যমান।
পুত্রাজায়া মসজিদ থেকে আসার পরেও মেয়েটিকে ভুলতে পারছি না। আল্লাহ্ যেনো তাকে শাহাদাহ গ্রহণ করার তৌফিক দেন।
জাপানি মেমের মসজিদ গমন
– হাসনীন চৌধুরী
(১৮/০২/২০১৯)