স্বপ্নের উলটোপিঠ

“জ্বি না, আমি ছবি তুলি না।” কিছুটা শক্ত কন্ঠে বললো নিশি।

পাত্রী দেখতে এসে পাত্রীর মুখে এমন দৃঢ় ও শক্ত কথায় অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো পাত্রের ভাবী। চেহারার হাবভাব এমন করলো যেন হ্যাইলির ধুমকেতু দেখেছেন তিনি। পরিস্থিতি সামাল দিতে নিশির বড় চাচি অযাচিত একটা বাড়তি হাসি যোগ করে বলে উঠলেন, “আমাদের মেয়েটা এসব ব্যপারে খুব সতর্ক। আর আজকালকার ছেলে মেয়ের মত স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয় না। হাহাহা…”

হাসির একটা ধর্ম আছে। অনেকটা ভাইরাসের মত। একজনের হাসি অন্যদের ঠোঁটেও হাসি ফুটাতে পারে। কিন্তু বড় চাচির হাসি আর কারো মুখে সামান্য হাসির রেখাও টানলো না। পাত্র পক্ষের কেউ কোনো ‘টু’ শব্দটিও করলো না। অনেকক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে নিশির দিকে সবাই তাকিয়ে রইলো। এই রুমে এখন নিশি ছাড়া মোট ৬ জন মানুষ আছে। পাত্র নিজে, পাত্রের বড় দুই বোন, পাত্রের ভাবী, পাত্রের মা ও নিশির বড় চাচি। প্রতিটা মানুষ এক দৃষ্টিতে নিশির দিকে তাকিয়ে আছে। নিশির নিজেকে মিউজিয়ামে রাখা কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মনে হতে লাগলো। সবাই এতোটাই মনোযোগ দিয়ে নিশিকে দেখছে যেন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা চলছে।

পিনপতন নীরবতা ভেঙ্গে নিশির বড় চচি বলে উঠলেন, “আপনারা তো কিছুই নিচ্ছেন না। একটু মিষ্টি নিন।”

বড় চাচির কথার কোনো উত্তর না দিয়ে পাত্রের বড় বোন বললেন, “ওনাকে আসতে বলি এখন?”

বড় চাচি কিছুটা ইতস্তত চোখে নিশির দিকে তাকালেন। নিশির আর বুঝতে বাকি রইলো না যে পাত্রের বড় বোন তার প্রাণ প্রিয় স্বামীর কথাই বলছেন। এসব নিয়ে একটু আগেই কথা হয়েছে। নিশি খুব দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিয়েছিলো যে কোনো গাইর মাহারামের সামনেই যাবে না নিশি। মিউজিয়ামে আসার আগেই এসব নিয়ে বিরাট ঝড়তুফান গিয়েছে।

ছোট চাচিকে এতো দিন ধার্মিক বলেই জানতো নিশি। অথচ ছোট চাচিই নিশিকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলো যে একদিন একটু ছাড় দিলে কিছুই হবে না। পাত্রের দুলা ভাইয়ের সামনে যাওয়া যাবে। অনেকক্ষণ যুক্তি তর্ক চললো।

“শুধুমাত্র পাত্র ও ফিমেইল যারা এসেছে তাদের সামনে আমি যাবো। অন্য কোনো পুরুষ মানুষ থাকলে আমি ওই রুমে যাবোই না”

“এটা কি করে হয়? ছেলের বন্ধু, বড় দুলাভাই ও মামা এসেছে। তাদের আমরা কি করে বলি এই কথা।”
“বাংলাতে বলতে পারো। বাংলায় বলতে বেশি সমস্যা মনে হলে ইংলিশে বলে দাও। তাতেও চলে।”
“নিশি, এভাবে কাউকে বলা যায় না। আমরা পারবো না।”

“তাহলে আমিও ওই রুমে যাবো না।”
“তুমি তো বুঝ, নিশি।”
“হ্যাঁ! চাচি। তুমিও তো বুঝ। পর্দা করাটা ফরয। এটা আমাদের খেয়াল খুশি মত পাল্টে নিলে হয় না।”
“দেখো, আমরা এখন এমন সমাজে থাকছি যেখানে ইসলামটা প্রতিষ্ঠিত না।”

“তাই তো কষ্টটা আমাদেরকেই বেশি করতে হবে।”
“অবশ্যই, আর তাই এতটুকু ছাড় দেয়া যায়। সমস্যায় পড়লে কুফুরি কালামও উচ্চারণ করার পারমিশন দেয়া আছে ইসলামে। ইসলাম এতো কঠিন না।”
“জীবন মৃত্যু সমস্যায় পড়লে… আমি এখন জীবন মৃত্যু সমস্যায় পড়িনি।”

“এই সমাজের সবাই তো এসব বুঝে না আর এখন ওদের বুঝানোটা আমাদের কাজও না, নিশি।”
“কে ওদের কিছু বুঝাতে বলেছে? তুমি শুধু এটুকু বলে দাও যে গাইর মাহাররাম কারো সামনেই মেয়ে যাবে না। ব্যাস।”

“কিন্তু ওরা তো তা মানতে চাচ্ছে না।”
“না মানতে চাইলে, বলে দাও যে মেয়ে দেখা হবে না। ও হ্যাঁ! খাবারগুলো খেয়ে যেতে বলবে কিন্তু। মা আর দিবা মিলে খুব কষ্ট করে রান্না করেছে। না খেয়ে গেলে ওরা কষ্ট পাবে।”

নিশির এমন দৃঢ় কন্ঠে শান্ত উত্তরে সবাই বুঝে নিলো যে কোনোভাবেই এটা সম্ভব না। তাই নিশিকে আর না ঘাটিয়ে পাত্রের বন্ধু, দুলাভাই ও মামাকে দেখা করতে অনুমতি দেয়া হলো না। কিন্তু নিশি মিউজিয়ামে আসার পর হঠাৎ যেন সবার মেমোরি লস হলো। সবাই আগের সব কথা ভুলে গেলো। বড় চাচির ইতস্তত চোখ উপেক্ষা করে পাত্রের বড় বোন তাহার প্রাণ প্রিয় স্বামীকে রুমে ঢুকতে দিলেন। নিশিও সাথে সাথেই নেকাবটা মুখের উপর টেনে নিলো। এবার রুমে হলো ৭ জন মানুষ সবার অপলক দৃষ্টি নিশির দিকে। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মনে হঠাৎ অনেক পুরানো একটা গান উদয় হলো, “পড়ে না চোখের পলক… টা না না না… কি আমার রূপের ঝলক… টা না না না…”

অনেকক্ষণ ৭জন মানুষের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা চললো। কারো মুখে ‘টু’ শব্দটিও নেই। তারপর পাত্রের মা বললেন, “ঠিক আছে তুমি এখন যাও, মা।”


“আমার ছেলে পছন্দ হয়নি।” নিশি মিউজিয়াম থেকে নিজের রুমে এসেই জানিয়ে দিলো।
“কেন?”
“চাচি, তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম যে আমি বিয়ের ক্ষেত্রে আগে দ্বীনকে প্রায়োরিটি দিবো। তারপর অন্য কিছু।”

“ওসব, তো বিয়ের পর ও ঠিক করে নেয়া যাবে।”
“না, চাচি যাবে না।”
“কেন? তুমি যানো, বিয়ের আগে আমি কত পর্দা করতাম…”

“কিন্তু এখন তুমি ছেড়ে দিয়েছ… তাই বলে তো…”
“ছেড়ে দেইনি, নিশি… বিয়ের পর তোমাদের ফ্যমিলির মানুষরাই আমাকে খ্যাত ডাকতো আরো কতো কি যে বলতো। এমন পরিবেশে কিভাবে…”

“এমন তো হবেই। আমাদেরকে তো আমাদের ইমানের লেভেল মতই পরীক্ষা করা হবে।”

“দুনিয়াটা এতো সহজ না, নিশি। এই দেখ, এখন ওদের সাথে মুখের উপর ছবি তুলতে না করে তুমি হয়তো ভাবছ যে তোমার ইমান এর দাবি ঠিক আছে। কিন্তু এতে তোমার বাবা-চাচাদের কতটা অসম্মান হলো।”
“আমাদের সম্মান ইসলামে, চাচি। এর বাইরে সম্মান খুঁজলেই আমরা শেষ…”

“উমার(রাঃ) এর টাইম আর এই টাইম সেইম না”
“সেইম হলে তো আমাকে এতো কথা বলতেই হতো না। অথচ তোমাকে আমি সবটা আগেই বলে রেখেছিলাম..”

“হ্যাঁ! বলে রেখেছিলে। ছেলের দাঁড়ি থাকতে হবে, ফরয ও সুন্নত মেইন্টেইন করতে হবে, হালাল ইনকাম হতে হবে। এসবটাই তুমি বিয়ের পর ধীরে ধীরে বুঝিয়ে বলতে পাড়বে। আর তা ছাড়া দাঁড়ি রাখা তো সুন্নত।”

“তুমি কি বুঝিয়ে বলে নিজের পর্দা করাটা কন্টিনিউ করতে পেরেছিলে, চাচি? আর হ্যাঁ! সুন্নত পালনই তো বুঝায় যে সে ইসলামের প্রতি কতটা ডেডিকেটেড… তাছাড়া ছেলেটা সুদি ব্যাংকে কাজ করে। আমি তো এটা আগে জানতামই না।”

“এভাবে তুমি কাউকে জাজ করতে পারো না, নিশি। আর এই যুগে সুদটুদ কে দেখে?”
“আমি দেখি। আর আমি তো রাস্তার কাউকে জাজ করতে যাচ্ছি না। যার সাথে আমার জীবন জড়ানোর কথা চলছে তাকে জাজ করার সব রাইটস আমাকে ইসলাম দেয়। এমন কি বিয়ের ক্ষেত্রে তো গীবত করার পারমিশনও আছে।”

“দাঁড়ি রাখা না রাখাটা এতো কোনো ইম্পর্ট্যান্ট বিষয় না। তা ছাড়া তুমি নিজে কয়টা সুন্নত প্র্যাকটিস করো?”
“অবশ্যই ইম্পর্ট্যান্ট। তা তোমার কাছে না মনে হতেও পারে। তবে আমি এতে ছাড় দিচ্ছি না।”
“সব দিক মিলিয়ে হয় না, নিশি। কোনো না কোনো দিকে ছাড় দিতেই হয়।”

“সেটাই তো। আমি তো সব দিকেই ছাড় দিচ্ছি। ছেলের ইনকাম কম হলেও আমার সমস্যা নেই, বাসা বাড়ী ছোট হলেও সমস্যা নেই। দ্বীন ছাড়া অন্য কোনো কিছুতেই সমস্যা নেই।”

“হ্যাঁ! তুমি দ্বীন ছাড় দিবে না আর আমরা অন্য কিছুতেই ছাড় দিবো না। আমাদের কি সমাজে কোনো সম্মান নেই। আমরা কেন আমাদের মেয়েকে আমাদের স্ট্যাটাসে থেকে নীচে বিয়ে দিবো।”
“কারণ, রিজিক আল্লাহ্‌র হাতে।”

“কিন্তু সমাজে আমাদের একটা নাম ডাক আছে। তুমি দেখ তোমার কাজিনদের কেমন ফ্যামিলতে বিয়ে হয়েছে।”

“ফ্যামিলি দেখে কি হবে, চাচি? তুমি দেখ, হৃদি আপুর দুইবার ডিভোর্স হয়েছে। সাবরিন আপুর হাসব্যন্ডের এক্সট্রা মেরিটাল এফেয়ার আছে যা তোমরা সবাই জানো তবুও কিছু না করে আপুকেই মানিয়ে নিতে বলছো। বিয়ে দেয়া নিয়েই তো তোমাদের কাজ, এরপর? এরপর কে দেখে সেই মেয়ে কেমন আছে?”
“সবাই দেখে।”

“তাহলে এখনো সাবরিন আপুর ব্যপারে তোমরা কিছু করছো না কেন? কেউ আসলে কারো কোনো উপকারই করতে পারে না যতক্ষন আল্লাহ্‌ না চান। তাই আমি আল্লাহ্‌ এর অবাধ্যতা করে কিছুই করছি না।”
“তুমি নিজের দিকে খেয়াল কর তো। আর কয় বছর আগেও কি তুমি এমন ছিলে?”

“না, এখন যেহেতু ব্যপার গুলা বুঝার তাওফিক আল্লাহ্‌ আমাকে দিয়েছেন তাই এখন এসব ব্যপার আমাকে দেখতেই হচ্ছে।”

অনেক কথার পর কিছুটা হাঁপিয়ে উঠলো দু’জনই। এমন সময় রুমে বড় চাচি এসে জানালো পাত্র পক্ষের সবাই মেয়ের সাথে একটু একা কথা বলতে চাচ্ছে।


প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হয়ে নেকাবের আড়ালে বসে আছে নিশি। রুমে নিশি ছাড়া ৮ জন মানুষ। পাত্রের মা, বড় দুই বোন ও ভাবির সাথে নতুন যোগ হয়েছে পাত্রের দুলাভাই, মামা ও পাত্রের প্রাণের বন্ধু। প্রত্যেকেই এক দৃষ্টিতে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় মনোনিবেশ করেছে।

“নেকাবটা একটু খোলো।” বললেন পাত্রের মা।
“না, আন্টি।”
“কেন?” পাত্রের বড় বোনের প্রশ্ন।
“আমি পর্দা করি।”

“আমরাও তো পর্দা করি। তাই বলে কি ঘরের মানুষদের সামনে এমন করি নাকি।” কিছুটা রুক্ষ কন্ঠে বললো পাত্রের ভাবি।

“একটু কষ্ট করে বাসায় গিয়ে আপনারা সূরা নূর এর ৩১ নং আয়াতটা পড়বেন এবং তাফসীরও পড়বেন।”
“একটু দেখতে দাও।” অনুরোধের সুরে বলে পাত্রের দুলাভাই ও বন্ধুর দিকে দেখিয়ে বললেন পাত্রের বড় বোন, “ওরা তো তোমার ভাই এর মতই।” এরপর পাত্রের মামার দিকে দেখিয়ে বললেন, “আর ইনি আমাদের মামা। ঘরেরই মানুষ। যদি বিয়ে হয়, তাহলে দেখবে যে ইনি কতটা মিশুক মানুষ।”

“আমাকে মাফ করে দিন, আপু।”

“আচ্ছা থাক আপু, আর এই একই কথা বলতে হবে না।” অনেকটা বিরক্ত কন্ঠে বললেন পাত্রের প্রাণের বন্ধু।
“আচ্ছা, তাহলে কি তোমাদের কিছু জিজ্ঞেস করার আছে?” আশাহত স্বর স্পষ্ট বড় বোনের কন্ঠে।

পাত্র মাথা নাড়লো। পুরুষদের মধ্যে কারোরই কিছু বলার নেই। কেমন যেন হতাশার কালো অন্ধকার ঢেকে গেছে তাদের দৃষ্টিতে।

“তোমার জন্ম তারিখ কি?” তীক্ষ্ণ কন্ঠ পাত্রের ভাবীর।
“১৯ মার্চ”
“সাল?”
“১৯৯৬”

হঠাৎ আবার নীরবতা নেমে এলো। নিশি এক দৃষ্টিতে কার্পেটের কারুকাজ পর্যবেক্ষণে মনোযোগ দিলো।

“কিন্তু, বায়োতে তো ২০০০ লেখা ছিলো।”
“বায়ো হয়তো মেয়ে লিখেনি।”
“তাই বলে এতো পার্থক্য করবে!!”
“মেয়ে তো তাহলে ঠিক বলছে মনে হচ্ছে।”
“হ্যাঁ! কেউ কি ইচ্ছে করে নিজের বয়স বাড়িয়ে বলবে নাকি!”
“মেয়ে ৯৬ বললো! তার মানে তো বয়স আরো বেশি মনে হচ্ছে।”

এমন আরো কিছু ফিসফিসে শব্দে কানাঘুষো কানে এলো নিশির। কার্পেটের কারুকাজের দিকে তাকিয়েই নিশি মনে মনে বললো, “বায়ো আমি লিখিনি। কে লিখেছে তা আমি জানিও না। আর তা ছাড়া বয়স লুকানোর একটা আজব চেষ্টা এ দেশে আছে তা বুঝি আপনারা জানেন না!!”

অদ্ভুতভাবে আবারও সবাই অপলক নয়নে নিশির দিকে তাকিয়ে রইলো। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে কেউ একজন বললো, “ঠিক আছে, তুমি যাও তাহলে।” যাও শুনেই স্বস্তি পেলো, কথাটা কে বলেছে তা আর খেয়াল করলো না নিশি।


নিশির রিমান্ড চলছে। মুরব্বী শ্রেণীর সাবাই নিশির উপর যারপরনাই খেপা। ছেলে যমুনা ব্যাংকে ভালো পোস্টে আছে। দেখতে শুনতে বেশ। ছেলের বাবাও তো রুই-কাতলা লেভেলের মানুষ। এমন সম্বন্ধ কেউ ধুরছাই করে নাকি। নিশি কালো আলখাল্লাটা গায়ে জড়ানোর পর থেকে তো ওর ভবিষ্যতটাই ঘোর কালো অন্ধকার লাগছে। একেবার অমাবস্যার আঁধার। অমাবস্যায় তো তাও তারার আলো মিটমিট করে। নিশির ভবিষ্যতে তাও নেই।

“দাড়ি থাকলেই কি তোমাকে আমরা যার তার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবো নাকি?” কন্ঠ ভরা বিরক্তি বড় ফুফুর।
“না, দাড়ি তো রবীন্দ্রনাথেরও ছিলো। দ্বীনদারিতা এবং আখলাক্বও খেয়াল করতে হবে।”

“তুমি বললেই হবে তাই না?” শাসনের স্বরে মা বললেন।
“বিয়েটা যেহেতু আমি করছি…”
“সামান্য একটা সুন্নত নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি কেন করছো তুমি?” ছোট চাচি বললেন।
“দাড়ি রাখা সুন্নত?”
“হ্যাঁ!”
“রাসুল(সাঃ) কে কি কখনোও দাড়ি ছাড়া দেখা গিয়েছে?” বিনয়ী জিজ্ঞাসু প্রশ্ন নিশির। যেন এর উত্তর নিশি জানেই না।
“না দেখা যায়নি।”
“আচ্ছা। তাহলে বিতর নামাজ কি?”
“ওয়াজিব”
“কেন?”
“কারণ, রাসুল(সাঃ) কখনোই তা বাদ দেন নি।”
“তাহলে দাড়ি ছাড়াও তো রাসুল(সাঃ) কে কখনো দেখা যায়নি।”
“কারণ দাড়ি একবার রাখলে আর কাঁটা যায় না।“

“বিয়ের ব্যপারে মুরব্বীদের কথা শুনতে হয়।” ছোট চাচি আর নিশির কথার মাঝেই বড় চাচি একটু বুঝাতে চেষ্টা করলনে।
“দেখ, নিজে বিয়ে করলে সমাজের পাঁচজন পাঁচ কথা বলে। তাছাড়া সুখও পাওয়া যায় না।” বড় চাচির সাথে তাল মিলালেন ছোট খালা।
“আমি কি কখনও বলেছি যে আমি নিজে বিয়ে করতে চাই?”

“তবে তুমি যে ডিমান্ডগুলো করছো তা তো পাওয়া সম্ভব না।” বললেন বড় খালা। খালার কন্ঠে রাগ স্পষ্ট।
“কেন? পাওয়া অবশ্যই সম্ভব। তবে তাদের তোমরা মেনে নিতে পারছো না।”
“হ্যাঁ! তুমি ছাড় দিবা সামাজিক স্ট্যাটাস। তাহলে আমরা সমাজে মুখ দেখাবো কি করে?” রাগান্বিত প্রশ্ন ছোট ফুফুর।

“এখন যেভাবে দেখাও। তবে বেশি সমস্যা মনে করলে নেকাব পড়ে নিতে পারো।”
“লাইফটা দুষ্টামির জায়গা না, নিশি। এতো দিক মিলায়ে তুমি কোনোদিনও পাবা না।“ তীক্ষ্ণ কন্ঠ বড় খালার।
“আমি এতো দিক চাচ্ছিও না। একটা দিকই চাচ্ছি। আর তা ছাড়া না পেলে কি আর করা।”
“কি আর করা মানে কি?” ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন মা।
“না পেলে আর কোথা থেকে বিয়ে করবো, সেটা বললাম।”

“বিয়ে তো করতেই হবে।” ছোট চাচির কন্ঠে ডোমিনেটিং ভাব।
“হ্যাঁ! আমিও তো তা জানি। তবে যাকে তাকে না। দ্বীন ও আখলাক প্রায়োরিটি।”
“এমন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।” বিরক্তি জড়ানো কন্ঠ ছোট ফুফুর।
“কি বলছ এসব? এই দুনিয়াতে কোনো দ্বীনদার ছেলে নেই?”

“তোমার জন্য তাদের প্রস্তাব আসতে হবে তো।”
“কেন তাদের প্রস্তাব আসতেই হবে? তোমরা কাউকে এমন মনে করলে নিজে থেকে প্রস্তাব দিলেই তো হয়।”
“দেখ মেয়ের কথা, বিয়ের প্রস্তাব নাকি মেয়ে পক্ষ দেয়।” তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে বড় ফুফু সবাইকে উদ্দ্যেশ করে বললো।

সবার মুখেই তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো। হাফ সেকেন্ডেরও কম সমইয়ের নীরবতা ভেঙ্গে ছোট চাচি বললো, “সেটা হয় না। তোমার কাউকে পছন্দ থাকলে বলো।“
“এখন তো মনে হচ্ছে থাকলেই মনে হয় তোমরা বেশি খুশি হতে। অথচ স্পষ্টভাবেই এসব হারাম।”
“তাহলে তোমার ডিমান্ডের ছেলে কোথায় পাবো?” প্রশ্ন বড় ফুফুর।

“তা আমি কি করে বলবো।”
“নিজে বানিয়ে নিয়ে আসো নিজের পছন্দের ছেলে।” ভয়াবহ কর্কশ কণ্ঠে বললেন ছোট চাচি।
“বিয়ে কি করবে না নাকি? আগে ছেকাটেকা খেয়ে এখন বিরহিনী হবার প্ল্যান করেছো মনে মনে?” বড় ফুফুর তাচ্ছিল্যের প্রশ্ন।
“এমন কিছুই না।”
“তাহলে কেমন? কবে বিয়ে করবে তুমি?” মায়ের এমন কোথায় খুব কষ্ট হচ্ছে নিশির।
“আল্লাহ্‌ যেদিন লিখে রেখেছেন।”
“তাই বলে কি আমরা চেষ্টাও করবো না?” ছোট চাচি জিজ্ঞেস করলেন।

“আমি চেষ্টা করতে নিষেধ করিনি বরং কিভাবে কি কি বেছে চেষ্টা করবে তাও বলে দিয়েছি।”
“কিছুই তো তোমার পছন্দ হয় না। তোমার তো আরব্য রাজপুত্র লাগবে।” বড় ফুফুর মুখটা ভয়ঙ্কর তাচ্ছিল্যে ভরে গিয়েছে। এমন চেহারার মানুষদের দিকে তাকাতে নেই। এক পলক তাকালেও পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়। মাথার দু’ পাশ দপদপ করে। শিরা-উপশিরার রক্ত চলাচল টের পাওয়া যায়।

নিশি কোনো উত্তর আর দিলো না। সবার কথায়, কন্ঠে ও মুখের ভাবভঙ্গিমায় স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে কেউ আর নিশির কথা শুনবার মুডে নেই। মনে মনে আয়তুল কুরসি ও আউজুবিল্লাহ পড়তে শুরু করলো। আর এক দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুতেই এমন সিচুয়েশনে রাগ হওয়া চলবে না। কন্ঠস্বর উঁচু করা চলবে না। এখন পান থেকে চুন খসলেও তা দ্বীনদারিতার দোষ হবে।

“আর পর্দা নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি কেন করলে ওদের সামনে?” কর্কশ কন্ঠে ছোট খালার প্রশ্ন।

নিশি এক মনে আয়তুল কুরসি পড়ে যাচ্ছে। মাথার দুই পাশের শিরা রাগে দপদপ করছে। এখন মুখ খুললে ড্রাগনের মত আগুন বেড়িয়ে আসতে পারে। তাই নিশি চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে।
“সত্যিই তো নিশি। এতো বাড়াবাড়ির তো কিছুই ছিলো না। নেকাব পড়া তো ফরয না। মুখ খোলা তো জায়েজ আছে।” বিরক্তিভরা প্রশ্ন ছোট চাচির।

ছোট চাচির ইসলাম নিয়ে ভালোই পড়াশোনা আছে। বাসায় আলাদা একটা রুম ভরা ইসলামিক বই। চাচি নিজেও পর্দা নিয়ে বেশ সচেতন। ফেমিলির সবাই এক সাথে হলে নেকাব পড়েই সব কাজ করেন। চাচির মুখে এমন কথায় খুব অবাক হল নিশি। তবু মনে মনে বললো, “এটাও আরো একটি পরীক্ষা ছাড়া কিছুই না।”

তারপর কন্ঠকে যথা সম্ভব শান্ত ও বিনয়ী করার আপ্রাণ চেষ্টা করে নিশি বললো, “হ্যাঁ, আমি জানি এটা নিয়ে ইখতেলাফ আছে। কিন্তু আমি যেহেতু মুখ ঢেকে রাখার মতটা ফলো করি তাই ঘরে বাইরে সব জায়গায় একটাই ফলো করার চেষ্টা করি।”

“এতো বেশি বাড়াবাড়ির কোনো দরকারই ছিলো না। এতো করে ওরা বললো। একবার একটু নেকাবটা খুলে দেখিয়ে আবার পড়ে নিতে পারতে।” বললেন বড় চাচি।

নিশি ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “সেটা হয় না। একবার যদি নেকাব খুলেই ফেলি তাহলে আর নেকাব পরে পড়ার কি মানে থাকে?”

অদ্ভুত দৃষ্টিতে সবাই তাকিয়ে আছে নিশির দিকে। যেন নিশি না নিশির চেহারার কোনো এলিয়ান এসেছে এই রুমে। নিশি চুপচাপ কার্পেটের কারুকার্য পর্যবেক্ষন করছে ও মনে মনে আয়তুল কুরসি পড়ছে।


রাত বাড়ার সাথে সাথে শহরের আঁধার বাড়ে না। রস্তার সোডিয়াম লাইটগুলো বার বার জানান দেয় যে এখন মানুষ সভ্য যুগের মানুষ। নিশির মাঝে মাঝে সেই প্রস্থর যুগে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। যখন মানুষ হাঁস-মুরগির সাথেই ঘুমিয়ে যেত। আর ভোরের কিরণ জাগার আগেই জেগে উঠতো।

রুম অন্ধকার করে বারান্দার আলো ছায়ার আঁধার দিকটায় বসে আছে নিশি। অপেক্ষা করছে কখন বাসাটা শান্ত হবে। সাবাই ঘুমোবে। বুকের ভেতরটা জমাট বেঁধে আছে। যেন গলার কাছে দলা পেকে আছে কিছু একটা। কয়েক গ্লাস পানি খেয়েছে। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। একজনের সাথে একটু কথা বললেই মনটা হালকা হয়ে যেতো। তাই এই নির্ঘুম অপেক্ষা নিশির।

ধীরে ধীরে ব্যস্ততা, কোলাহল শান্ত হয়ে এলো। ঘুমিয়ে পড়লো সন্ধ্যাতারাও। নিশাচর কিছু পাখির একাকীত্বের কান্না হঠাৎ হঠাৎ কানে আসে। রাস্তার সোডিয়াম লাইটেরও যেন এই নীরবতার সাথে কিছুটা ঝিমুনি এসেছে। নিশির গাল ভিজে যাচ্ছে। একজনের সাথে একটু কথা বলাটা এখন খুব দরকার।

সারাদিনের ঘাড়ত্যেরা, একগুঁয়ে, বদমেজাজি মেয়েটার জায়নামাজ ভিজে যাচ্ছে অশ্রুতে। মনের সবটা বলে দিলো তাঁকে।

“তুমি সবটা জানো, দেখো ও বুঝো। তুমি যা চাও তাই তো হবে। আর কে আছে তোমার ইচ্ছের বাইরে কিছু করবে। তুমি যদি চাও তাহলে আমাকে এই পরীক্ষা আজীবন দিতে হবে। না চাইলে এই পরীক্ষা ক্ষণিকের। আমার যেটুকু সহ্য করার ক্ষমতা আছে তুমি তো সেটুকুই নির্ধারন করেছো। নিশ্চয়ই তুমি তো কারো সাধ্যের বাইরে কিছুই চাপিয়ে দাও না, মালিক। বরং আমিই অধৈর্য হয়ে যাচ্ছি। রাব্বি, আমাকে ধৈর্য দাও, ইলম দাও, হিক্বমাহ্‌ দাও। এই সিচুয়েশনটা আমার জন্য সহজ করে দাও। আমি তো শুধু তোমাকেই সিজদাহ করি। তোমারই কাছে আশ্রয় চাই। তোমার কাছেই সাহায্য চাই।“

এটুকু বলে আর কিছুই বলতে পারলো না নিশি। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো সিজদারত অবস্থাতেই। হাজার স্মৃতি, হাজার কথার ছুটোছুটি চলছে মস্তিষ্কের আনাচে কানাচে। মুখে কিছুই বলা হচ্ছে না। শুধু কয়েকবার অস্পষ্টভাবে রাব্বি রাব্বি বলে ডেকে আবার থেমে গেলো নিশি। কি বলবে? কিভাবে বলবে? তিনি যে সবই জানেন। মুখে যা বলা যাবে তিনি তো তারচে’ অনেক অনেক বেশি জানেন। এভাবে ঠিক কতটা সময় কেটেছে হিসেব নেই। এক রাত ঘুমহীন কাটলে কি আর এমন হয়!! অনেক দূরের কোনো মসজিদ থেকে মোয়াজ্জিনের কন্ঠ ভেসে এলো।

ফজরের নামাজ শেষ করে নিশি প্রশান্তি নিয়ে ঘুমোতে এলো। সব কেমন যেন শান্তিতে ছেয়ে গিয়েছে। বুকের ভেতরের ভারি ভাবটা এখন আর নেই। নেই গলার কাছে দলা পাকানো কিছু একটা। সব কষ্ট যেন অশ্রু হয়ে জায়নামাজে মিশে গিয়েছে।


প্রশান্তিদায়ক একটা স্বপ্ন দেখে নিশির ঘুম ভাঙলো। স্বপ্নে মৃত দাদিকে দেখলো সে। স্বপ্নটা কিছুটা এমন। নিশির দাদি নিশিকে বলছে, “এতো অস্থির হবার কি আছে? আর এতো তাড়াহুড়োই বা কেন করছিস, তুই? আল্লাহ্‌র উপর ভরসা কর। তারপর নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দে তোর বাবাকে। দ্বীনের ব্যপারে এক চুলও ছাড় দিবিনা।”

সকাল থেকেই বাসার সবার মেজাজ কেমন যেন ফুরফুরে। গতকাল রাতেই যে এতো ঝড় তুফান হয়েছে তা যেন কারো মনেই নেই। নিশি স্বপ্নে যেমন দেখেছে তেমনটাই করলো। বাবার কাছে গিয়ে বুঝিয়ে বললো যে এই এই কারণে ও এই ছেলেকে বিয়ে করতে চাচ্ছে না। বাবাও কোনো প্রতিবাদ ছাড়াই মেনে নিলো।

গতকাল রাতেই সবাই ছিলো নিশির বিপক্ষে অথচ এক রাতেই সবার মন কিভাবে যেন চেঞ্জ হয়ে গেলো। রাতেই যে ছেলে সোনার টুকরা ছেলে ছিলো, সকালেই কেন যেন সবাই সেই ছেলেকেই আর পছন্দ করছে না। নিশি কিছু বুঝে উঠার আগেই আল্লাহ্‌ সবটা উল্টে দিলেন।

কিছুটা ইতস্তত করে নিশি ছোট চাচিকে জিজ্ঞেস করলো, “কি ব্যপার চাচি, তোমরা সবাই হঠাৎ ওই ছেলের ব্যপারে এমন নেগেটিভ হয়ে গেলে কেন?”

“আরে নিশি, আর বলো না। কাল রাতেই তোমার চাচার এক কলিগ কল দিয়ে জানালো যে এই ছেলের ইউকেতে একটা বউ আছে। পড়াশোনা করতে গিয়েছিলো যখন তখন সেখানের এক বাঙালি মেয়েকেই সে বিয়ে করে। কিন্তু ডিভোর্স না দিয়েই দেশে ফিরে ব্যাংকে চাকরি পায়। দেশে আর কেউকে জানায়নি যে সে বিবাহিত। ছেলের বাবা-মা বিয়ে দিতে চেয়েছে সেই বাধ্য ছেলের মতো বিয়ে করতে…”

ছোট চাচি বিরক্তিভরা কন্ঠে সোনার টুকরা ছেলের কীর্তিকলাপ বর্ননা করে যাচ্ছেন। আর নিশির চোখ দু’টো বার বার কৃতজ্ঞতায় ভিজে উঠতে লাগলো। আল্লাহ্‌র সাহায্য কত দ্রুত আসে। অথচ আমরা কতটা অধৈর্য, অকৃতজ্ঞ।


স্বপ্নের উলটোপিঠ
-নুসরাত জাহান মুন

(২৯/০৩/২০১৯)