ক্কুররাতা আইয়ুন

১।

ফজর হয়েছে। কোন মতে হাঁচড়ে পাচড়ে পাশ ফিরে বিছানায় উঠে বসল রুমি। দুই পায়ের মাঝের জয়েন্টে এত ব্যথা যে পা ফেলে হাঁটতে পারবে না সে। রোমান ওযু করে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসা পর্যন্ত বিছানায় বসেই অপেক্ষা করল। ও বের হয়ে আসলে বলল, “আমার কাছে একটু আসো। আমি একা উঠতে পারব না।”

রোমানের কাঁধে ভর দিয়ে শুধুমাত্র পায়ের আঙ্গুলের সাহায্যে একটু একটু করে এগিয়ে গিয়ে ও ওযু করে আসল। কিন্তু পা ধোবে কিভাবে? ও যে পা নাড়তেই পারছে না! পেলভিক জয়েন্টে এই ব্যথাটা অনেক আগে থেকেই অল্প অল্প হচ্ছিল। এখন এই শেষ সময়ে এসে খুব বেড়ে গেছে, বিশেষ করে সকালে ঘুম থেকে উঠলে অসহ্য অবস্থায় গিয়ে পৌঁছে। কোনমতে আবার ঘরে ফিরে চেয়ারে বসল রুমি। রোমান ওয়াশরুম থেকে বালতিতে করে পানি নিয়ে আসল। রুমির পা-টা নিজেই তুলে ধুয়ে দিল। সালাতের জন্য ভালো করে ওড়না পরে চেয়ারে বসেই সালাত আদায় করল রুমি।

২।

ঘুমটা মোটামুটি ভালোই হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ্‌। চোখ মেলে তাকিয়ে খুব সুন্দর একটা দৃশ্য দেখল রুমি। বেডের বিপরীতে হাসপাতালের বড় জানালাটা। সকালের ঝকঝকে রোদ এসে পড়ছে ঘরটায়। পেছনে চেরী গাছের পাতাবিহীন শুকনো ডাল আর থোকা থোকা ফুটে থাকা সাদা চেরী দেখা যাচ্ছে। সেই জানালার সামনেই ওদের এক দিনের মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছে রোমান।

রোমানের মুখে গত দুইদিনের ক্লান্তির ছাপ, মোচ গজিয়ে উঠেছে, আগাছার মতো কিছু দাড়ি গালের ওপর দেখা যাচ্ছে। রুমির যে রাতে লেবার পেইন ওঠে সে রাতে নিজে তো ঘুমাতে পারেইনি, রোমানকেও ঘুমাতে দেয়নি, একটু পর পরই ব্যথায় ওকে ডেকে তুলেছে আর ওর হাত ধরে থেকেছে। বেচারা সেই রাত থেকে ঘুমাতে পারছে না।

আর এখন তো ডেলিভারির ধকল সামলাতে রুমির প্রচুর বিশ্রাম প্রয়োজন। সে চোখ মেলেই রাখতে পারছে না। কাল রাতে বাবু হওয়ার পর থেকেই ও ঘুমাচ্ছে। মেয়ে খেতে চাইলে রোমান মেয়েকে ওর কাছে দেয়। খাইয়ে ও আবার ঘুমিয়ে যায়। এদিকে রোমান নিজে সজাগ থেকে মেয়ের খেয়াল রাখছে।

ক্লান্ত রোমানের কোলে সযত্নে ধরা ওদের মেয়েটা, পেছনে সকালের সুন্দর রোদ আর জানালা দিয়ে দেখা যাওয়া চেরী ফুলের গাছের দৃশ্যটাকে রুমি দুই চোখের পাতায় ভালো করে এঁকে নিল। কখনো ভুলবে না সে এই অপার্থিব সুন্দর ছবিটা ইনশাল্লাহ!

৩।

মেয়েকে নিয়ে ঘরে ফিরেছে ওরা তিনদিন হাসপাতালে থাকার পর। রুমির পোস্ট পার্টাম ক্লান্তি কাটতে এখনো অনেক সময় লাগবে। দিনের বেলা টুকটাক কাজ করে যদিও কিন্তু রাতের ঘুমটা মড়ার মতো ঘুমায়। কিন্তু মায়ের মন ঠিকই টের পেয়ে যায় বাচ্চার কখন ক্ষিদে লাগল। বেঘোরে ঘুমানোর মাঝেও মেয়ে যখন খাওয়ার জন্য মাথা এপাশ-ওপাশ নাড়ে ঠিকই ঘুম চোখে মেয়েকে খাইয়ে নেয়। ব্রেস্টফিডিং এর এটা একটা সুবিধা, ঘুমের মাঝেই পাশ ফিরে খাইয়ে নেয়া যায়।

এক ঘণ্টা কি হোল না কি মেয়েকে খাইয়েছে? এখনই আবার নড়াচড়া শুরু করেছে! ঘুমের ঘোরেই রুমি দেখল রোমান তড়াক করে উঠে গেল। সোজা ওয়াশরুমে গিয়ে হাসপাতাল থেকে দেয়া ওয়াইপ্স হিসেবে ব্যবহার করার কাপড়গুলোর একটা ভিজিয়ে আনল। খুব সাবধানে মেয়ের ছোট কম্বল সরিয়ে তার বাথরুম পরিষ্কার করে দিল।

রুমি মনে মনে ভাবল, রোমানকে এসব কে শেখাল? কিভাবে ও জানল আমার এখন বিশ্রাম খুব বেশি প্রয়োজন, ওর এই সহযোগিতাটা আমার এখন খুব দরকার?

৪।

“আসসালামু আলাইকুম ভাবি।”

“ওয়ালাইকুম সালাম ভাবি। কেমন আছেন আপনি আর আপনার মেয়ে?”

“আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভাবি আমরা ভালো আছি। আপনার শরীর কেমন?”

“আমি আছি মোটামুটি ভাবি। আমি খুবই লজ্জিত ভাবি যে গত দেড় মাসেও আপনাদের দেখতে আসতে পারলাম না। ছেলের দেখাশোনা, সংসারের কাজ আর জানেনই তো আপনার ভাই ঘরের কাজ করতে পারেনা। কিছু বোঝেই না কী করবে! সব কিছু একা করে আসলে এই শরীরে খুব ক্লান্ত হয়ে যাই।”

“কী যে বলেন ভাবি, কোন সমস্যা নাই। আমি বুঝি। আপনি ফোন দিয়েছেন খুব ভালো লাগছে।”

“আমারও তো ডেট ঘনিয়ে আসল। দুয়া করবেন ভাবি।”

“অবশ্যই। ইনশাল্লাহ আমরাই হাসপাতালে আসব আপনাকে আর আপনার বাবুকে দেখতে।”

“খুব খুশি হব তাহলে। আপনার মেয়ের জন্য একটা ছোট্ট গিফট কিনেছিলাম অনেক আগেই। যাকারিয়ার আব্বু একদিন আপনাদের বাসায় গিয়ে দিয়ে আসবে। দুয়া করবেন ভাবি, খুব ভয় লাগছে। বিদেশে একা দুইটা ছোট বাচ্চা নিয়ে কিভাবে কী করব আল্লাহ্‌ই ভালো জানেন। ওদের বাবা তো এসব বোঝেই না। দেশ থেকেও কারো আসার সুযোগ নেই।”

“চিন্তা করবেন না ভাবি, আল্লাহ্‌ই সব ব্যবস্থা করে দিবেন। আর আমরা তো আছি, যে কোন প্রয়োজনে বলবেন।”

ফোন রেখেই মনে মনে ভাবল রুমি, ভাবিকে একদিন না, কয়েকদিন রান্না করে পাঠাবে ইনশাল্লাহ। আর সাথে সাথে গিয়ে একটা শুকরিয়ার সিজদা দিল। সিজদায় গিয়ে দুয়া করল, “হে আল্লাহ্‌, সমস্ত প্রশংসা তোমার যে তুমি আমাকে একজন দয়ালু স্বামী দিয়েছ। আমি যেন তাঁর ভালো স্ত্রী হতে পারি।”

ক্কুররাতা আইয়ুন

বিনতে খাজা

জুন ১৫, ২০১৯ইং