ট্যাটু

চ্যানেল ঘুরাচ্ছিলাম। ‘ট্যাটু আজকে এক শিল্পের পর্যায়ে চলে গিয়েছে’– হঠাৎ এই কথা শুনে থামলাম সেই চ্যানেলে। ইটিভির “রূপ লাবণ্য” অনুষ্ঠান। কিভাবে পার্মানেন্ট ট্যাটু করা হয়, তার যত্ন নেওয়া হয় এসব বলা হলো এবং সবশেষে একজন ছেলে মডেলকে হাতে ট্যাটু করে দিলেন একজন ট্যাটু আর্টিস্ট।

আজকাল প্রায়ই ছেলে মেয়েদের দেখি হাতে, ঘাড়ে, কোমরে ট্যাটু আঁকা। আর সেই ট্যাটু দেখানোর জন্য তারা তেমনভাবেই ড্রেসআপ করে। মানে চুলটা একটু উঁচু করে বাঁধে যেন ঘাড়ের ট্যাটু দেখা যায়। কোমরের অনেক নিচে প্যান্ট পরে, হাতা গুটিয়ে রাখে অথবা স্লিভলেস হাতার জামা পরে।

মানুষের শরীরের চামড়ায় মোট সাতটি স্তর থাকে। এর মধ্যে দ্বিতীয় স্তরের চামড়ায় সুঁই বা এজাতীয় কোনো কিছু দিয়ে ক্ষত করে তাতে বাহারি রং দিয়ে নকশা করাকে উল্কি বা ট্যাটু বলে।

কোনটা টেম্পোরারি আর কোনটা পার্মানেন্ট ট্যাটু, তা দেখলেই বোঝা যায়। আগে সবাই টেম্পোরারি বা অস্থায়ী উল্কি লাগাতো। কিন্তু এখন যাদের দেখি, মোটামুটি সবার পার্মানেন্ট বা স্থায়ী ট্যাটু। মানে মানুষ এখন ট্যাটুতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। এই অভ্যস্ত হওয়ার ব্যাপারটা খুব সুক্ষ ভাবে ঘটেছে। বেশ কয়েক বছর থেকে বাচ্চাদের চকোলেট, চিপস, জুস অথবা চুইংগামের সাথে ফ্রি টেম্পোরারি ট্যাটু দেওয়া হচ্ছে। বাচ্চারাও মজা করে ঘাড়ে, গালে, হাতে লাগায়। গায়ে কয়েকদিন থাকে সেসব ট্যাটু। এই দেশে যখন ব্যাপারটা শুরু হয়, ঠিক সেই সময়টাতেই ‘LA INK’ আর ‘MIAMI INK’ নামে TLC চ্যানেলে ট্যাটুর উপর দুটো প্রোগ্রাম দেখাতো। মোটামুটি সবাই দেখতো প্রোগ্রাম দুটো। মানুষের মনের উপর সেই প্রোগ্রামের প্রভাব পড়া অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। কারণ তারা খুব সুন্দর আর নিখুঁতভাবে ট্যাটু আঁকতো। এর কিছুদিনের মাঝেই বাংলাদেশে ট্যাটু পার্লার হয়। ট্যাটু করানো বা উল্কি আঁকাটা সেই সময় খুব এক্সপেন্সিভ ছিল। এখন আর আগের মত এক্সপেন্সিভ না।

একজনকে দেখলাম আরবিতে ‘আলহামদুলিল্লাহ্‌’ ট্যাটু এঁকেছে। যেহেতু ধর্মীয় শিক্ষা আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে, ছোট থেকে মানুষ ট্যাটু দেখে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে, আবার সৌন্দর্যের সাথে এটা সম্পর্কিত – তাই সবকিছু মিলিয়ে ট্যাটু এখন মানুষের কাছে সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। এই ব্যক্তি শুধু যে আল্লাহর লানত কামাই করলো তা নয়, যতদিন সে বেঁচে থাকবে – আল্লাহর নাম লেখা নিয়ে নাপাক স্থানে যাওয়ার কারণে গুনাহের পরিমাণ বাড়তেই থাকবে।

১৯৭০-এর দশকে পশ্চিমা বিশ্বে জনপ্রিয়তা পেলেও এর প্রচলন শুরু হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৭০ অব্দের দিকে। সম্প্রতি জার্মানির একটি জরিপে উঠে এসেছে, ৩৫ বছরের কম বয়সী প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনের গায়ে ট্যাটু আঁকা আছে। ১৮৯১ সালে স্যামুয়েল ও রেলি প্রথম ইলেকট্রিক ট্যাটু মেশিন আবিষ্কার করেন। তাদের তৈরি ট্যাটু গানের সামনের দিকে কলমের মতো সুঁই যুক্ত করা হয় এবং এতে কালি জমা থাকারও ব্যবস্থা ছিল। এ যুগের বেশির ভাগ উল্কি/ট্যাটু আঁকা হয় সে রকম মেশিনেই।

একটি ট্যাটু গান প্রতি মিনিটে তিন হাজারবার চামড়ার এক মিলিমিটার পর্যন্ত ছিদ্র করে কালি ভরাট করে থাকে। এর মাথায় রয়েছে অত্যন্ত সূক্ষ্ম সুঁই। সুঁইয়ের মাথায় থাকে রং। প্রতিবার সুঁইকে যখন চামড়ার ভেতরে প্রবেশ করানো হয়, সেই সঙ্গে রংও ভেতরে প্রবেশ করে। রঙের পরিমাণ এক মিলিলিটারেরও কম হয়। চামড়ার যে স্তরে রংটি লাগানো হয় তার নাম ডের্মিস। এই স্তরে যেকোনো রং প্রবেশ করলে তা সারা জীবন থেকে যায়। পাশাপাশি রঙের সঙ্গে থাকা রাসায়নিকও শরীরের মধ্যে থেকে যায় সারা জীবন। এর ফলে হেপাটাইটিস, টিউবারকিউলোসিস, টিটেনাসের মতো বিভিন্ন রোগের সংক্রমণের আশঙ্কা আছে।

উল্কি আঁকা হারাম। উল্কি যে আঁকে এবং যে আঁকায়, তাদের দুজনের উপরই আল্লাহ্‌ লানত দিয়েছেন। একটা মানুষ সারাক্ষণ আল্লাহ্‌র লানত নিয়ে ঘুরে বেড়াবে, ব্যাপারটা কষ্টকর। তার আগেই মানুষকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া উচিৎ।

ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম বলেছেন, “যেসব নারী সৌন্দর্যের জন্য উল্কি অঙ্কন করে এবং যাদের জন্য করে এবং যেসব নারী ভ্রু উৎপাটন করে এবং দাঁত ফাঁকা করে, আল্লাহ তাআলা তাদের অভিসম্পাত করেছেন।”
[বুখারি, হাদিস : ৫৬০৪]

আরেকটি হাদিসে এসেছে, ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেন, “যেসব নারী নকল চুল ব্যবহার করে, যারা অন্য নারীকে নকল চুল এনে দেয় এবং যেসব নারী উল্কি অঙ্কন করে ও যাদের জন্য করে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহুআলাইহিওয়াসসাল্লাম তাদের অভিশাপ দিয়েছেন।”
[বুখারি, হাদিস: ৫৫৯৮, মুসলিম, হাদিস : ৫৬৯৩]

ইসলামের কিছু বিধান আমরা জানি না বলেই মানি না। ভ্রু প্লাক করার মতো ট্যাটু আঁকাটাও সেরকম একটি গর্হিত গুনাহের কাজ, যা আমাদের দ্বীনের জ্ঞানের অজ্ঞতার কারণে আমরা না বুঝেই করে ফেলি। বাচ্চারা যেন ট্যাটু না লাগায় সে ব্যাপারে বাবা- মায়ের খেয়াল রাখা দরকার। কারণ এই বাচ্চারা যখন বড় হবে তখন এটা তাদের কাছে সাধারণ ব্যাপার হয়ে যাবে। কাজেই এখন থেকেই আমরা সতর্ক হই। যারা ভুল করে করে ফেলেছি তারা তওবাহ করে ফেলি।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের অজ্ঞতার কারণে করা গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিন, আমাদের ‘ইলম বৃদ্ধি করে দিন, দুনিয়া আর আখিরাতে আল্লাহর লানত থেকে রক্ষা করুন, আমীন।

ট্যাটু
তাহনিয়া খান

অগাস্ট ২১, ২০১৯ইং