ভালোবাসি তাঁরে

হামিদা মুবাশ্বেরা
দৃশ্যপট ১ঃ

আপনি কি সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে পারেন যেন অপারেশনটা শুক্রবারের মাঝেই করা হয়? কান্না ভেজা কণ্ঠে বললো শম্পা। ওপাশ থেকে ডাক্তার ভদ্রমহিলা বললেন যে দেখেন, এটাতো আমার এখতিয়ারের উপর না, এটা নির্ভর করছে হসপিটালে বেড খালি হচ্ছে কী না তার উপর। বেড খালি হওয়া মাত্রই আমরা আপনাকে জানাবো। কিন্তু আমি কি জানতে পারি যে আপনি কেন এত তাড়াহুড়া করছেন? আপনি কি ইনফেকশনের আশংকা করছেন? সোমবার হলেও খুব একটা দেরী হবে না কিন্তু!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো শম্পা। বলবে না বলবে না করেও বলেই ফেললো——–দেখুন, আমি আমার সুপারভাইসরকে ব্যাপারটা জানাতে চাই না। যদি শুক্রবারের মাঝে ডিএনসিটা হয়ে যায় তাহলে আমি উইকএণ্ডে রেস্ট নিয়ে সোমবারেই কাজে যেতে পারবো। যদি সোমবারে করেন, তাহলে আমার ছুটি নিতে হবে, যেটা আমি এড়াতে চাচ্ছি।
ভদ্রমহিলা শুনে আর কথা বাড়ালেন না, বললেন আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।

ঘণ্টা দুয়েক পর হসপিটাল থেকে ফোন আসলো যে বেড পাওয়া গেছে………শুনে শম্পা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো!

মানুষের জীবন কত অদ্ভূত! এবারো মা হওয়া হচ্ছে না এই অনুভূতির চেয়ে সুপারভাইসরকে ব্যাপারটা বলতে হবে না এই অনুভূতিটা দেহ মনে স্বস্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে! গতবারের অভিজ্ঞতা মনে করলে এখনো গা গুলিয়ে ওঠে শম্পার, একটা বিবমিষার অনুভূতি জাগে। গতবার যখন জানিয়েছিলো যে ওর মাত্র একটা মিসক্যারেজ হয়েছে, তাই সে ঊনার কয়েকটা ক্লাসে উপস্থিত থাকতে পারে নাই, ঊনি ওকে ‘প্রফেশনালিজমের’ উপর লেকচার দিয়েছিলেন ১০ মিনিট। তারপর থেকে ভদ্রলোককে স্রেফ অমানুষ মনে হয় ওর। কিন্তু ডিপার্টমেন্টের নিয়মটা এমন যে ঊনার কাছে ওর জবাবদিহিতা করতেই হবে, কোনো অন্যথা নেই।

জ্ঞান ফেরার পর ধাতস্থ হতে বেশ কিছু সময় লাগলো শম্পার। ফুল অ্যানেস্থিশিয়ার অভিজ্ঞতা এই প্রথম, এর আগের বার যখন মিসক্যারেজ হয়েছিলো, তখন ওষুধ দিয়ে লেবার পেইন ইন্ডিউস করে বের করেছিলো মাংসের দলাটা, ডিএনসি করা হয় নি।

হুম, মাংস পিণ্ডই তো বলা যাবে এটাকে, আল্লাহ সুবহানুহু ওয়া তা’লা প্রাণ দিলে সেটাই হতে পারতো তার অনাগত সন্তান। এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মনে হল নামাযের ওয়াক্তের কথা। অস্ফুট কণ্ঠে রিয়াজকে ডাক দিলো। ওর বোধ হয় একটু চোখ লেগে এসেছিলো, শম্পার ডাক শুনে ধরফরিয়ে উঠলো। শম্পা ওর মোবাইলের খোঁজ করলো। এক সিনিয়র আপুকে মেসেজ দিয়ে রেখেছিল এই সময়ে নামায পড়ার নিয়মটা জানতে। দেখলো ঊনি মেসেজ দিয়ে রেখেছেন যে যেহেতু প্রেগন্যান্সীর মেয়াদ ৭৯ দিন পার হয়ে গেছে, তাই এখন নামাজ পড়তে হবে না……রেফারেন্সও দিয়েছেন। সেটা পড়ার এখন ধৈর্য্য হলো না শম্পার। মনে হলো একটা ভার হাল্কা হয়ে গেলো। আর কোনো টেনশন নেই এখন, নিশ্চিন্তে রেস্ট নিতে পারবে ও এই দুটো দিন………দু চোখ বন্ধ করলো শম্পা……

দৃশ্যপট ২ঃ

কিছুটা দৌড়ে গিয়ে বাথরুমের বেসিনে গিয়ে হরহর করে বমি করলো স্নিগ্ধা। এই গরমের মাঝে এতক্ষণ চুলার পাশে থাকার জন্য নাকি পাশের বাসার খালাম্মার তির্যক মন্তব্যের জন্য বমিটা হল, আল্লাহই জানেন। কিন্তু বমিটা হয়ে শরীরটা একটু ভালোই লাগছে বরং। একটু শুবে ভেবেছিলো, কারণ আদনান ঘুমাচ্ছিলো, কিন্তু ওর বমির শব্দেই হয়তোবা ভয় পেয়ে উঠে গেছে ও। আধো ঘুমের মাঝেই কাঁদতে কাঁদতে পাশে মাকে খুঁজছে, তাড়াহুড়ো করে গিয়ে ওর পাশে শুলো, আস্তে আস্তে পিঠ চাপড়ে দিতে থাকলো। ছেলে আবার ঘুমিয়ে গেলে সাবধানে উঠলো, খুব শুতে ইচ্ছা করলেও উপায় নেই। আরো ২ পদ রান্না তখনো বাকি। পেটে ৫ মাসের একটা আর কোলে ২ বছরের একটা নিয়ে একহাতেই প্রতিদিন ৫ পদের মত রান্না করতে হয়। রোযার মাসে যেন খাওয়া দাওয়া আরো বেড়ে যায় সবার! অদ্ভূত ব্যাপার! ৮জনের পরিবারের ৫ পদের মত রান্না করতে গিয়ে প্রতিদিনই হাঁপিয়ে ওঠে স্নিগ্ধা। তাও ভাগ্যিস যে ও নিজে রোযা না। নিজে রোযা থাকতে হলে কী অবস্থা যে হত! তবু মানুষের কথার শেষ নেই। পাশের বাসার আন্টিও এসে বলছিলেন যে “ও কী তুমি রোযা করছো না! আমরা যে তোমাদের বয়সে থেকেছি গো!” শুনে পিত্ত্বি জ্বলে গেলেও চুপ করে ছিলো ও। যদিও মনে চাচ্ছিলো যে চিৎকার করে বলে যে আল্লাহ আমাকে যে অবকাশ দিয়েছেন, আপনি সেটা কেড়ে নেয়ার কে, শুনি! কিন্তু চুপ করে থাকার এক অদ্ভূত ক্ষমতা অর্জন করেছে ও গত চার বছর ধরে যৌথ পরিবারে সংসার করতে গিয়ে!

দৃশ্যপট ৩ঃ
আলহামদুলিল্লাহ! দুজনেই একসাথে বলে উঠলো, ইমাম সাহেব যখন জানালেন যে ডিভোর্সটা হয় নি। বুক থেকে যেন কে এক মণি ওজন নামিয়ে দিলো!
রাত্রি আর সৈকত, সাথে ওদের তিন বছরের ছেলে ফয়সাল এসেছিলো ইমাম সাহেবের সাথে কথা বলতে, লজ্জার মাথা খেয়েই এসেছিলো।
ঘটনাটা ঘটেছিলো একদম হুট করেই। ইদানিং মন-মেজাজ মারাত্মক খারাপ থাকে রাত্রির। মিসক্যারেজটা হওয়ার পর থেকে লক্ষ্য করেছে যে মেজাজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে, বিশেষ করে মাসের নির্ধারিত সময়টাতে……ইদানিং অনেক দীর্ঘ সময় ধরে এটা থাকে, মাত্রাটাও আগের চেয়ে কয়েক গুণ। বিদেশের সংসারে এক হাতে সব করতে গিয়ে ছেলের সব দুষ্টুমিই ইদানিং অসহ্য লাগে, সৈকতের সাথে খিটমিটটাও অসহনীয় মাত্রায় চলে যাচ্ছিলো। নিজে যে একটা চরম বিরক্তিকর মানুষে পরিণত হচ্ছে এটা নিজেই টের পাচ্ছিলো রাত্রি।

সরকারী ছুটির দিন, সৈকতও বাসাতেই ছিলো। কিন্তু কোথায় বাসায় থেকে ছেলেকে একটু সময় দিবে, তা না……সকাল থেকে ল্যাপটপেই মুখ গুঁজে আছে। সেটা দেখে প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হলেও চুপ করেই ছিলো রাত্রি। মাত্রই সব কিছু গুছিয়ে দুপুরে একটু শুতে গেছে, ছেলের তখন খেলার ঝোঁক উঠেছে………কিছুতেই শোবে না। সৈকত বাসায় আছে, ও দেখবে মনে করে একাই শুয়েছিলো রাত্রি, চোখও লেগে এসেছিলো!
ধরাম করে একটা শব্দ শুনে চমকে উঠে ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখে তার গুণধর পুত্র একা একাই টিভি ওন করতে গিয়ে টিভির উপরের শখের ফুলদানীটা ফেলে দিয়েছে, সাথে পুরা ড্রয়িং রুমের কার্পেট পানিতে ভেজা। সাবান পানি দিয়ে খেলেছে একা একা। সৈকতের টিকিটা দেখা যাচ্ছে না, নিশ্চয়ই স্টাডি রুমে এখনো ল্যাপটপ নিয়েই বসে আছে!

এই অভিনব দৃশ্য দেখে কোথা থেকে কী হয়ে গেলো রাত্রির……মাথায় যেন রক্ত উঠে গেলো……ছেলেকে ধরে দিলো মাইর! ছেলেও মায়ের এমন অগ্নিমূর্তি দেখে ভয় পেয়ে গগন বিদারী চিৎকার দিয়ে উঠলো। সেই কান্না শুনে সৈকত এসে ছেলেকে রাত্রির হাত থেকে জোর করে কেড়ে নিতে গিয়ে রাত্রির গায়েই হাত তুলে বসলো!

রাত্রি তখন স্রেফ জ্ঞান শূন্য। সৈকতের উপর জমে থাকা সারাদিনের রাগ ফুঁসে উঠলো, প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলে উঠলো যে তোমার সংসারের নিকুচি করি আমি……বলে গাড়ির চাবিটা নিয়ে ঝড়ের বেগে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে ধরলো। সৈকতেরও মাথায় কী ভুত চাপলো, ও বলে বসলো যে বেরিয়ে যে যাচ্ছো, এটাই শেষবারের জন্য বেরিয়ে যাওয়া এটা মনে থাকে যেন, তোমাকে ডিভোর্স দিচ্ছি, তোমার মত hot headed একটা মানুষের সাথে সংসার করতে করতে আমারো নাভিঃশ্বাস উঠে গেছে………

অবশ্যই রাত্রি আর সৈকত কেউই ভেবে চিনতে বলে নি, যা বলেছে রাগের মাথাতেই বলেছে। পরে দুজনেই খুব অনুশোচনাতে ভুগছিলো, বুঝে উঠতে পারছিলো না যে কী করা উচিৎ। একই শহরে চাচার বাসা আছে, সেখানে গিয়ে চাচা-চাচীকে সব খুলে বলার পর ঊনারাই ইমাম সাহেবের সাথে কথা বলানোর ব্যবস্থা করলেন।
ইমাম সাহেব সব শুনে বললেন যে রাত্রি যেহেতু ওর মাসের বিশেষ সময়টা পার করছিলো, তাই এইসময়ে তালাক্ব কার্যকর হয় নি। ভদ্রলোক বেশ বিচক্ষণ। অতি সত্ত্বর রাত্রিকে ডাক্তার প্লাস কাউন্সেলরের কাছে যেতে বললেন, কারণ ঊনার ধারণা হরমোন্যাল ইমব্যালেন্স থেকে রাত্রির এমন হচ্ছে। ওদের দুজনকেই এরপর থেকে সাবধান হয়ে যেতে বললেন, কারণ রাগের মাথায় উচ্চারণ করা তালাক্বও কার্যকর হয়ে যায় যদি না ব্যক্তি একেবারেই হিতাহিত জ্ঞান শূন্য থাকে………

শুনে ওরা দুজনেই মাথা নাড়লো। সাবধান হতে হবে, আর চিকিৎসাও করাতে হবে যাতে এভাবে রাত্রি মেজাজের উপর নিয়ন্ত্রণ না হারিয়ে ফেলে সেজন্য…

……………………....

আমি এখানে আমার প্রতিবেশীদের মাঝে যে হালাক্বা নেই, সেখানে একটা ভিডিও দেখানোর পর একবার এক ভাবি জিজ্ঞেস করলেন যে আল্লাহকে কিভাবে ভালোবাসবো! যা করি তা তো জান্নাতে যাওয়ার জন্য করি, জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য করি, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার কোনো অনুভূতি তো কখনো আসে না……শুনে আমি ঊনাকে বললাম যে আমাদের আল্লাহ কে এটা জানতে হবে, ঊনার সৃষ্টি বৈচিত্র্য দেখতে হবে ব্লা ব্লা। আল্লাহকে যত চিনবো, তত ঊনাকে ভালোবাসতে পারবো ইনশাল্লাহ। কথাগুলো বলছিলাম ঠিকই, কিন্তু নিজের কানেই কেমন বেসুরো ঠেকছিলো। মনে হচ্ছিল আমি ঊনাকে যা বলছি সেগুলো স্রেফ থেওরী আওড়াচ্ছি।

জীবনের একটা সুদীর্ঘ সময় আমি ভাবতাম যে ইসলাম যে সত্য ধর্ম এটা বোঝার সঠিক উপায় এটা না যে আমরা এটার আইন কানুন গুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করবো। কারণ আমাদের সীমিত বুদ্ধি দিয়ে আমরা সবসময় এগুলোর পেছনের প্রজ্ঞা বুঝতে পারবো না……কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নানা ঘটনায় আমার মনে হয়েছে যে ইসলামী নানা আইনগুলোর মাঝে আল্লাহর যে পরিচয় ফুটে উঠেছে সেটা আমার মাঝে ঊনার জন্য অদ্ভূত এক অনুভূতি সৃষ্টি করছে……সেই অনুভূতিটা কৃতজ্ঞতার সীমা ছাড়িয়ে অন্য কিছু……হুম, সেটা ভালোবাসার অনুভূতি।

আগের পর্বে যে কাহিনী গুলো তুলে ধরেছি সেগুলো অধিকাংশই আমার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা। কিন্তু আমি এখানে শুধু নারী বান্ধব নিয়ম কানুন গুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছি। ধীরে ধীরে, নানা অভিজ্ঞতার আলোকে এই উপলব্ধিটা আমার হয়েছে যে কিছু কিছু সময়ে যখন দুনিয়ার কেউ ছাড় দেয় না, তখন আল্লাহ ছাড় দেন। একজন নারী তার মা হওয়ার পরিক্রমার মাঝ দিয়ে নানা ধরণের মানসিক এবং শারীরিক জটিলতার মাঝ দিয়ে যান । আমাদের সমাজ সেগুলো বিবেচনা করাতো দূরে থাক, Acknowledge ই করে না! অথচ আমার রাব ঠিকই জানেন যে এই সময়টা কঠিন একটা সময়। তাইতো মাসের বিশেষ সময়টাতে সালাত আদায় করতে হয় না, রোযা রাখতে হয় না, তালাক্ব কার্যকর হয় না….. গর্ভাবস্থায় কিংবা বাচ্চা দুধ খাওয়ার বয়সী হলে রোযা না রাখার সহজতা থাকা…… The list can go on and on……

আমার মনে আছে যে আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, তখন আম্মার ইউট্রাসে একটা টিউমার হয়েছিলো, জরায়ু আর ডিম্বাশয় দুটাই ফেলে দিতে হয়েছিলো। তারপর থেকে আম্মার মাঝে নানা ধরণের পরিবর্তন এসেছিলো। মাত্র চল্লিশ পেরোনো আম্মার তখন অনেক হট ফ্লাশ হত, একটুতেই রেগে যেতেন। আম্মার এই অকারণ রাগ করার স্বভাবে অভিমান হত খুব, উল্টা আম্মার সাথে চিল্লাচিল্লি করতাম।

আজকের আমি যখন পিছন ফিরে তাকাই, তখন আমার তীব্র আফসোস হয়। আম্মা যে আসলে তখন কত ধরণের হরমোনাল ইমব্যালেন্সের মাঝে দিয়েই যাচ্ছিলেন, আম্মা নিজেও কি তা জানতেন! যদি জানতেন তাহলে নিজে হয়তো একটু সচেতন হতে পারতেন, আশে পাশের মানুষগুলো তাকে ভুল কম বুঝতো, সম্পর্কগুলো হয়তো এত তিক্ত রূপ নিতো না……

নানা প্রোপাগাণ্ডার সম্মুখীন হয়ে বহু শিক্ষিত মেয়েকে আমি দেখেছি মনে প্রাণে এটা বিশ্বাস করতে যে ইসলামে নারীদেরকে যথাযথ মর্যাদা দেয়া হয় নাই। আমি যখন উপরে উল্লেখিত আইনগুলোকে For granted হিসেবে না নিয়ে এই আঙ্গিকে দেখা শুরু করলাম তখন আমি আবার নতুন করে উপলব্ধি করলাম যে নিশ্চয়ই ইসলাম এমন এক সত্ত্বা থেকে আগত যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, আমার কষ্টগুলো বোঝেন এবং সেই অনুযায়ী আমাকে ছাড় দেন। চিন্তা করে দেখুন তো যে দুনিয়ার কোনো প্রতিষ্ঠান আপনাকে ছাড় দেবে মাসের বিশেষ সময়গুলোতে? হয়তো তীব্র তলপেটের ব্যথায় আপনার দম নিতেও কষ্ট হচ্ছে। তবু যেতে হবে অফিসে, স্কুলে, সবখানে। রান্না করতে হবে, সন্তানদের দেখভাল করতে হবে………শুধু কী করতে হবে না? আল্লাহর প্রতি দায়িত্বগুলো! সেখান থেকে অব্যাহতি!

ফেসবুকে আমি অনেক সময় আমার ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছি, আমার জীবনের কঠিন কিছু সময়ের ব্যাপারে কথা বলেছি। সে কারণে কী না জানি না, তবে বহু বোন, যারা অনুরূপ অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে যাচ্ছেন, তারা আমাকে মেসেজ পাঠান পরামর্শের জন্য। মাঝে মাঝেই তাদের কারো কারো কাহিনী শুনে আমার চোখ ভিজে আসে………তারপর যখন আমি আমার নিজের জীবনের ঘটনা ক্রমগুলো মনে করি, তখন আবার সাহস পাই…

ইসলামী জীবন দর্শনের যে দিকটা আমার কাছে খুব অভিনব লাগে, সেটা হচ্ছে ‘Not having a specific definition of blessing or test’। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলা দরকার। আমরা যখন দেখি যে কারো জীবনটা কানায় কানায় পূর্ণ, সন্তান, সম্পদ, খ্যাতি এসব অনেক কিছুই আছে, আমরা ভাবি যে সে খুব blessed! কারো জীবনে যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, ধরেন সন্তান হচ্ছে না বা মারা গেছে বা অসুখ বিসুখ ইত্যাদি, আমরা ভাবি যে they are going through test/difficulties. কিন্তু আমরা যদি কুরআনীয় দৃষ্টিভঙ্গী দেখি, তাহলে বুঝবো যে এগুলো কোনোটাই কিন্তু সাফল্য বা পরীক্ষার মাপকাঠি নয়। ফিরাঊনের সব কিছু ছিলো তবু সে আল্লাহর চোখে সবচেয়ে ঘৃণিত এবং অভিশপ্ত ব্যক্তি। আবার সূরা কাহফে মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং খিদির আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাহিনী থেকে আমরা বুঝি যে আপাত দৃষ্টিতে খুব খারাপ কিছু আসলে আমাদের ভালোর জন্য হতে পারে। ওই কাহিনীর সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় আমার কাছে হচ্ছে- কোনো খারাপ কিছু ঘটার মাঝে কী প্রজ্ঞা ছিলো এটা আমি এই জীবনে টের পেতে পারি, যেমনটা নৌকার মালিক পেয়েছিলো, আবার নাও পেতে পারি, যেমনটা খিদির আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বাচ্চাটাকে হত্যা করেছিলেন, তার মা-বাবা কখনোই বোঝে নি!

আমি আমার নিজের , সাথে চারপাশের বহু, বহু মানুষের অভিজ্ঞতা এবং রিভার্ট মুসলিমদের অসংখ্য কাহিনী থেকে একটা জিনিস গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি যে যখনই কেউ আল্লাহর পথে চলা শুরু করে, সে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে থাকে। এই ব্যাপারটা অনেকের কাছেই খুব কনফিউসিং লাগে যে বান্দা যখন আল্লাহর ইবাদাতে মনোযোগী হয়, তখন আল্লাহ সেটা সহজ না করে দিয়ে বরং নানা বিপদ আপদের মাঝে কেন ফেলেন।

আমাদের এখানে একটা জিনিস বোঝা খুব জরুরী যে আল্লাহর সাথে আমাদের সম্পর্কের সীমা কিন্তু দুনিয়ার মাঝেই শুধু আবদ্ধ না। This life, by definition is Unjust. তাই আমরা যখন আল্লাহকে চিনবো, তখন আমরা পরকালের প্রয়োজনীয়তা এবং সত্যতা উপলব্ধি করবো। কারণ পরকাল হচ্ছে Justice প্রতিষ্ঠার দিন। তখন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের প্রাপ্তি/ অপ্রাপ্তিগুলোর হিসাবের সীমা পরিব্যপ্ত হবে সেই জীবন পর্যন্ত। যদি দুনিয়ার সীমার বাইরে আমরা চিন্তা করতে না পারি, তাহলে নিচের আয়াতটা আমাদের জন্য একটা সতর্ক বাণী হতে পারে-

মানুষের মধ্যে কেউ কেউ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে জড়িত হয়ে আল্লাহর এবাদত করে। যদি সে কল্যাণ প্রাপ্ত হয়, তবে এবাদতের উপর কায়েম থাকে এবং যদি কোন পরীক্ষায় পড়ে, তবে পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। সে ইহকালে ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত। এটাই প্রকাশ্য ক্ষতি (২২:১১ )

আমাদের যদি মনে হতে থাকে যে আল্লাহর ইবাদাত করছি সেটার বিনিময়ে আল্লাহ দুনিয়াতে সব কিছু সহজ করে দিবেন, তাহলে আমাদের বোঝায় কিছু ভুল আছে। আল্লাহ কোথাও বলেন নি যে দুনিয়াতে সব কিছু সহজ হয়ে যাবে। বরং উলটাটা বলেছেন যে আল্লাহর যে বান্দা যত কাছের, তার পরীক্ষা তত বেশী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন এক্ষেত্রে খুব Iman boosting হতে পারে, যখন আমরা দেখি যে ঊনি কী সীমাহীণ কঠিন সময়ের মাঝ দিয়ে গেছেন! অবশ্য কিছু কিছু বিপদ আমাদের নিজস্ব হাতের কামাইও হতে পারে, কিন্তু কোনটা যে আমাদের পাপের শাস্তি সেটা গায়েবের জ্ঞান, সেটা চিহ্নিত করার সামর্থ্য আমাদের দেয়া হয় নি !

আমার কথাগুলো খাপছাড়া মনে হচ্ছে কী না জানি না, কিন্তু আমরা যারা আল্লাহর পথে অটল থাকতে গিয়ে/ থাকা সত্ত্বেও নানা কঠিন সময়ের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি, তাদের জন্য আল্লাহর এই Merciful দিকটা উদ্ভাবন খুব কার্যকরী হতে পারে। আমার জীবন এমন একজনের দ্বারা ডিজাইন করা যিনি আমাকে সবচেয়ে ভালোবাসেন——-এই বোধটা কি আমাদের একটু স্বস্তি দিতে পারে?

আজকের আমি যখন পিছন ফিরে তাকাই তখন আমি অবাক হয়ে উপলব্ধি করি যে আপাত দৃষ্টিতে যেগুলো আমার জন্য ছিল খুব কঠিন কিছু মুহুর্ত, সেই সময়টাতেই আমি আল্লাহর সবচেয়ে কাছাকাছি যেতে পেরেছিলাম। আমার যেটুকু কুরআন এখন মুখস্ত আছে, সেটার ৯০% হয়েছিলো সেই সময়ে। কুরআন আমাকে তখন জীবনের বাস্তবতা ফেস করার শক্তি যুগিয়েছিলো। আলহামদুলিল্লাহ আমার মুভি, গান, আড্ডা এসব কোনো ‘Escape’ এর দরকার হয় নি, হতাশা আমাকে সাময়িকভাবে আক্রান্ত করলেও handicapped করে দেয়নি। Escape আর Strength এর মাঝে পার্থক্যটা বোঝা খুব দরকার। কারণ আজকাল আমরা অধিকাংশই বড্ড বেশী Escape খুঁজি, ভাবি যে Escape থেকে Strength খুঁজে পাবো। তাই নিজের মনের শান্তি খুঁজে ফিরি সম্পর্ক, বস্তু ইত্যাদির মাঝে। ভুলে যাই যে শান্তির উৎস আস-সালাম যেটা আল্লাহর একটা নাম।আল্লাহ শান্তি পাবার উপায় কুরআনে দ্ব্যর্থহীণ ভাষায় জানিয়ে দিচ্ছেন-
জেনে রাখ, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়। (১৩:২৮)

তাই আজকের আমার মনে হয় যে ওগুলো আসলে পরীক্ষা ছিলো না, বরং আল্লাহর রহমত ছিলো, যেহেতু সেগুলো আমাকে আল্লাহর অনেক কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলো। এখন নানা নিয়ামতের ভিড়ে আল্লাহর সাথে সেই সম্পর্কটা অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে। তখন যেভাবে আল্লাহর উপর ভরসা করতে পারতাম, এখন সেভাবে পারি না, জীবনে একটু অনিশ্চয়তা আসলেই টেনশন লাগতে থাকে!

আবার তখন অনেক কিছু পাইনি দেখে খুব মন খারাপ হয়েছিলো, কিন্তু আজ বুঝি যে আল্লাহ যদি আমাকে ওগুলো দিতেন তাহলে আমার জীবনটা কেমন ভয়ংকর দুঃস্বপ্নে পরিণত হত! সেটা ভাবলেই দমবন্ধ লাগতে থাকে!

তাই আমার যেসব বোনেরা নানা কঠিন সময় পার করছেন, তাদেরকে জড়িয়ে ধরে আমি বলতে চাই যে নিশ্চয়ই আল্লাহ রাহমানুর রাহীম, ঊনি আমাদের নিয়্যত, ঊনার সাথে সম্পর্ক পরিশুদ্ধ করার জন্য দুনিয়াবী কিছু জিনিস কেড়ে নিচ্ছেন। তার বিনিময়ে ঊনি আমাদেরকে হিদায়াত দিয়েছেন যেটার মূল্য পৃথিবীর কোনো সম্পদ দিয়ে মাপা সম্ভব না।
আসুন একবার বুকের গভীর থেকে বলি যে “নিশ্চয়ই আল্লাহকে রাব, ইসলামকে দ্বীন এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাসূল হিসেবে পেয়ে আমি সন্তুষ্ট।” তারপর অবনত চিত্তে বলি যে ইয়া রাব্বি (O my lord), ভালোবাসি তোমাকে……For designing my life in the best possible way

ভালোবাসি তাঁরে
হামিদা মুবাশ্বেরা

#রৌদ্রময়ী_প্রবন্ধ