সালাতে অবহেলা আর নয়

ইফতারের দাওয়াত পড়েছে বেশ কয়েকটা। এর মধ্যে কয়েকটাতে না গেলেই নয়। একটা আছে আরিবের অফিসের বসের দাওয়াত, কোন এক ফাইভস্টার হোটেলে। একটা অজুহাত খুজছে রুপা যদি কোনভাবে এভয়েড করা যায়। আরিব একা গেলেও ভালো, কিন্তু সবাই ফ্যামিলি নিয়ে যাচ্ছে। সব জায়গায় আরিবকে একা যেতে হয়, রুপার এসব গ্যদারিং পছন্দ নয় বলে। আরিব মনেমনে রাগ হলেও কিছু বলেনা, রুপার সমস্যা সে বুঝতে পারে। কিন্তু কর্পোরেট লাইফে তাকে অনেককিছু মেইন্টেইন করতে হয় অনিচ্ছা সত্বেও।

কলিগরা সবাই ওয়াইফ, বাচ্চা নিয়ে আসছে। বসের অনুরোধ, ফ্যামিলি পার্টি; সবাইকে নিয়ে আসা চাই। রুপা ভাবতে থাকে, কি করা যায়? সারাদিন সিয়ামের পর নিজের মনমত ইফতার, এরপর তারাবীহ, রাতের খাবার। আবার ভোররাতে সেহরি। দাওয়াতে গেলে সবকিছুর সময় এদিকওদিক হয়ে যায়।

যখন থেকে নিকাব শুরু করেছে বাইরে খাওয়াটা তার কাছে বড় রকমের এক অস্বস্তির নাম। খুব কষ্টেসৃষ্টে সামান্য খেয়ে ; কখনো না খেয়ে শুধু দাওয়াত এটেন্ড করেই চলে আসে। নিকাবের ভিতর দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস করার চেষ্টা করে। কত খাবার যে পরে যায় ভিতর দিয়ে খাবার সময়, ওর খুব কষ্ট হয়, যখন খাবারগুলো পরে যায়, একেকটা দানা, আল্লাহর দেয়া রিজিক।

বাচ্চাদের রেডি করে বসে আছে। আরিব আসলো বলে।পছন্দের একটা আবায়া বের করে আয়রন করছে। মনে মনে ভাবছে আজকে মাগরিব এর সালাত কোথায় পড়বে? আনমনা হয়ে ভাবতে থাকে, হঠাৎ, আবায়ার একটা অংশ পুড়ে যায়। ইয়া আল্লাহ! মনটা খুব খারাপ হয়ে আসে। ধ্যৎ! কিচ্ছু ভালোলাগছে না। আরেকটা আবায়া বের করে পরে নেয়।

আরিবকে জিজ্ঞাসা করতে ভুলেনা, আচ্ছা, সলাতের জায়গা পাবো তো? আরিব সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়, যদিও সে নিশ্চিত না। অফিসের কলিগরা একে একে আসতে শুরু করেছে। সাথে তাদের পলিশড ওয়াইফ এবং বাচ্চারা। রুপা এক কোণায় কাচুমাচু হয়ে বসে আছে। এমন পার্টি তার মত মেয়েদের জন্য না। আপাদমস্তক কালো আবায়াঘেরা মেয়েটা পারলে এই জাঁকজমক থেকে মাটি ফুঁড়ে ঢুকে যায়!

বসের ওয়াইফের সাথে দেখা করতে একরকম জোড় করেই নিয়ে এল আরিব, বসের জন্য আলাদা একটা ভি আই পি পর্দাঘেরা জায়গা। ভদ্রমহিলা রিতিমত চড়া মেকাপ করে এসেছেন। রুপা সালাম দিতেই হাসি দিয়ে তার সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বসতে বললেন। অনিচ্ছা স্বত্বেও বসে গেল। কথায় কথায় জানা গেল বসের বড় ছেলেটা বাবা মায়ের সাথে আজকের রোজাটা রেখেছে। রুপা ভাবছে, আলহামদুলিল্লাহ্‌ , খুব ভালো তো, তাহলে নিশ্চয়ই সালাহও আদায় করে।কিন্তু ভাবী সালাহ আদায় করবে কিভাবে? ওনার বিশাল নখগুলোতে রঙিন নেইলপলিশের কারুকাজ। রুপা আরেক টেনশনে পড়ে যায়!

এদিকে মাগরিবের আযানের সময় হয়ে যায়। সবাই ইফতার নেয়ায় জন্য লাইন শুরু করে। বুফে খাবার, পছন্দমত তুলে নেয়ার তাড়া দিতে থাকে আরিব। দেরি হলে পছন্দমতো নাও পেতে পারে। রুপার মাথায় ঘুরছে এখন দোয়ার সময়, ইফতারের আগে দুয়া কবুলা হয়। সে কোনমতে সামান্য খাবার নিয়ে দুয়ায় মনোনিবেশ করে। আবির বাচ্চাদের খাবার নিয়ে আসে। বস নিজের জায়গা ছেড়ে আরিবদের সাথে এক টেবিলে বসে। রুপা, বসের ওয়াইফ আর বাচ্চারা ভিতরে। রুপা ভীষণরকম শান্তি অনুভব করে, ভাবীও বেশ আন্তরিকতা দেখান। রুপার মনেমনে দুয়া করছিল এতক্ষণ যেন আল্লাহ কোন সুব্যবস্থা করে দেন।

কোনমতে ইফতার করেই আরিবকে জিজ্ঞাসা করে সালাহ পড়ার ব্যবস্থা কোথায় ? আরিব অপেক্ষা করতে বলে আগে নিজে আদায় করে নেয়। ছেলেদের জন্য আলাদা জায়গা আছে, কিন্তু মেয়েদের জায়গা পাওয়া যায়না। রুপা অবাক হয়ে লক্ষ করে কয়েকশো মানুষের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন যারা সালাহ আদায়ের জন্য জায়গা ছেড়ে উঠে গেলেন, বাকিরা একইভাবে ইফতার করতে করতে গল্প করতে লাগলেন। মহিলাদের সংখ্যা আরো কম। রুপার সাথে মাত্র একজন ছিলেন যিনি সালাহ আদায়ের জায়গা খুঁজছিলেন। শেষমেষ জায়গা দেয়া হল, হোটেলে এক অফিসরুমে, দুটো জায়নামাজ বিছিয়ে দেয়ে হল দুজনাকে। রুপার বিস্ময়ের শেষ হয়না, এত্তবড় হোটেল যেখানে হাজার স্কয়ার ফিট খালি জায়গা, অপ্রয়োজনীয় জায়গা পড়ে আছে; সেখানে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী মহিলাদের সালাত আদায়ের জায়গা নেই। এসব ভেবে লাভ নেই ; আলহামদুলিল্লাহ্‌ বলে রুপা বাচ্চাদের আরিবের কাছে রেখে সালাহ আদায় করে নেয়।

রুপা সালাহ আদায় করে মনেমনে ভাবতে থাকে, বছরে একটা মাত্র মাস রমাদান, কোন ফাকে এসে আবার এত্ত দ্রুত চলেও যায়। আশেপাশে এত্ত লোক যারা এখানে ইফতার উপলক্ষে এসেছেন, যদি ধরেও নেই সবাই সিয়ামরত অবস্থায় আছেন। তাহলে তারা একটা ফরজ আদায় করছেন। কিন্তু সালাহ না আদায়ে দিনে ১৭ টি ফরজ অবহেলাভরে ছেড়ে দিচ্ছেন। সারাদিন ধরে না খেয়ে যেখানে ১ টা ফরজ আদায় হয়, সেখানে কয়েক মিনিট মাত্র লাগে সালাহ আদায়ে। তবুও মানুষ কেন এ ব্যপারে গাফেল?

সাথে থাকে ভাবীদের কয়েকজনকে সালাহর জন্য ডাকছিল রুপা, কিন্তু সবাই একই কথা “সারাদিন রোজা রেখে ভীষণ টায়ার্ড, ওজুও করা নেই, বাসায় গিয়ে রিলাক্স হয়ে একসাথে ঈশার সালাতের সাথে আদায় করে নিব। এখানে কোথায় জায়গা খুঁজবো? ” রুপার অবাক হওয়া ছাড়া কিছুই করার ছিলনা। সময়ের সালাহ সময়েই আদায় করতে হয়, কোন অজুহাতেই এই সময়েরটা অন্য সময়ে, নিজের সুবিধামত আদায়ের সুযোগ নেই। আর সারাদিন বিশেষ করে ঘর থেকে বের হবার সময় ওজু করে নিলে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়।

একটা বিষয় ও ভালোই উপলব্ধি করতে পারে, অনেক মানুষেরই এই ফরজ ইবাদতগুলোর ব্যাপারে স্পষ্ট ধারনা নেই। বছরে একবার সিয়াম যেভাবে গুরুত্ব সহকারে পালন করে বুঝে বা না বুঝে; তার কানাকড়িও সালাহ আদায়ের ব্যাপারে করেননা। এর একটা কারণ হতে পারে সালাহ আদায়ের গুরুত্ব অনুধাবন করতে না পারা। যেহেতু দিনে ৫ বার আদায় করতে হয়, একারনে আলসেমি বা গাফিলতি করা। কারণ যাইহোক, কোন অবস্থাতেই সালাহ বাদ দেয়া যাবেনা।

রুপার বাসায় অনেকদিন ধরে কাজ করে সুফিয়া। মেয়েটা প্রায়ই নফল সিয়াম পালন করে, এমনকি মাঝেমধ্যে অসুস্থ অবস্থায়ও। যেমনঃ আশুরা, শবে মিরাজ, শবে বরাত ইত্যাদি। এসব দিনে সে কাজে আসেনা সারারাত ইবাদত করে, সালাহ আদায় করে। অথচ আশ্চর্য কথা সে পাচ ওয়াক্ত সালাহ রেগুলার আদায় করেনা, জিজ্ঞাসা করলে বাহানা বানায়। বহুবার বলার পরেও তাকে এ ব্যাপারে বোঝানো সম্ভব হয়নি যে, নফল সালাহ/ নফল ইবাদাত পালন না করলে তাকে হিসাব দিতে হবে না। কিন্তু এক ওয়াক্ত সালাহ ইচ্ছাকৃত আদায় না করলে কঠিন হিসাবের সম্মুখীন হতে হবে।

একটা জিনিশ আমাদের মাথায় রাখতে হবে, ইবাদত আমাদের নিজেদের ইচ্ছামত করলে হবেনা। যেভাবে আল্লাহ বলে দিয়েছেন ঠিক সেভাবেই করতে হবে। এখানে নিজের পছন্দ, অপছন্দ বা ইচ্ছা অনিচ্ছার মুল্যহীন। নিজের শরীরকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে এমন ইবাদত করলেন যা আসলে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্যই না অথচ সহজ ফরজ ইবাদাত পালন করলেন না।

এমন বহুমানুষকে দেখেছি যারা সারাবছর সালাত আদায় করেন না, কিন্তু রমাদানে পুরা মাসে সিয়াম ঠিকমত পালন করেন।এক্ষেত্রে মনে রাখা উচিৎ, আমাদের সর্বপ্রথম সলাতের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে। অবশ্যই সিয়াম পালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, কিন্তু একই সাথে এই মাসে আমাদের সলাতের ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে। যারা অবহেলা করেছেন বা এখনো করছেন এই মাস থেকেই শুরু করুন। আগের যেকোন রমাদান থেকে এবারের রমাদান মাস আমাদের সকলেরই অধিক ইবাদত বন্দেগীতে কাটুক যেন আমরা আমাদের আগের সব পাপগুলো এই মাসে আল্লাহ পাকের কাছ থেকে ক্ষমা পাইয়ে নিতে পারি ; হতে পারে এটাই আমাদের শেষ রমাদান।


সালাতে অবহেলা আর নয়
ফাহমিদা হুসনে জাহান

(০৮/০৫/২০১৯)