১.
সকাল ৯ টার ক্লাসটা ক্যান্সেল হয়েছে। নিপা ম্যাম মাত্র ফোন করে জানিয়েছেন আজ ক্লাসটা নিতে পারছেন না। মুহূর্তে হইহই করে সবাই ক্যান্টিনে দৌড় দিয়েছে। ক্লাসরুমে গুটিকয়েক অতি সিরিয়াস ছেলেমেয়ে এর লেকচার ওর নোট নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করছে।
শাহেদ আর নীরা অপেক্ষা করছে স্বাতীর জন্য। স্বাতী আসলে ক্যান্টিনে যাওয়া যাবে। খানিক বাদেই কড়া পারফিউমের সুবাস ছড়িয়ে স্বাতী বন্ধুদের পাশে এসে বসলো। মেজাজ প্রচন্ড খারাপ। রাগে কান দিয়ে গরম ভাপ বেরুচ্ছে।
ওর রাগ নীরার চোখ এড়ালো না।
– চোখ মুখ এমন করে রেখেছিস কেন? কিছু হয়েছে?
-হ্যাঁ হ্যাঁ আমাদের সুন্দরীর মুখ পেঁচার মত হল কেন?
শাহেদের স্বভাবসুলভ ফাজলামোতে স্বাতী গা করল না। কিছুক্ষণ জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে ঘটনা খুলে বলল। কমনরুমে “দ্বীনি সিস” উর্মির পাল্লায় পড়েছিল। স্বাতী নাকি আরেকটু ভালমত হিজাব করতে পারে। লিপস্টিক হিজাবের সাথে যায় না। স্কার্ফে এত কারুকাজ মানায় না। নোজ পিন আর এত বড় বড় ব্রোচ খুব বেশি দৃষ্টি কাড়ে!
“চিন্তা করতে পারিস? আমাকে জাজ করছে! বাইরে বাইরে নিনজা সেজে কত মেয়েই তো চিপায় চাপায় ঘুরে। আমি হিজাব করে আর যাই হোক ওর মত জাজমেন্ট করি না। এক্ষেত্রে আমি ফার মোর বেটার দ্যান উর্মি!”
রাগে গা রি রি করছে স্বাতীর।
– আরে উর্মির কথায় তুই রাগ করছিস কেন? ও তো সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে। আমাকেও আগে বলেছে। শুনতে ভালই লাগে। মানতে অনেক দেরি আছে অবশ্য…
– দেখ নীরা, এসব সুন্দর কথাতেই বিষ থাকে। আমাদের হিজাব নিয়ে কথা বলার ও কে? ও কালো ভুত সেজে বসে আছে বলে দল ভারী করতে চায়। লেজ কাটা শেয়াল একটা!
– আমার তো মনে হয় ও জেনে বুঝেই বলে রে। ওর একটা হিজাব শপও আছে জানিস?
– তোর মাথা ওয়াশ করে ফেলেছে এই মেয়ে। শাবনাজ আপুর হিজাব শপের মডেল আমি। উনি ১৮ বছর সৌদি ছিলেন। হিজাবের নিয়ম উনি জানেন না আর উর্মি সব জেনে বসে আছে! যত্তসব!
– ওহে হিজাবি আপুরা, আমি ঘুমালাম! তোমাদের মেয়েলি আলাপ শেষ হলে আমায় ডেকে দিও কেমন?
শাহেদ লম্বা একটা হাই তুলে বেঞ্চে মাথা দিয়ে ঘুমের ভান করল। মেয়েলি আলাপ বেশিক্ষণ চলল না। গরম গরম ফটোকপি শীট হাতে অনিক হাজির হয়ে গেছে।
ফাজলামোতে অনিক শাহেদের চাইতেও এগিয়ে।
আজও ক্লাসে ঢুকেই স্বাতীকে আপাদমস্তক দেখে বলা শুরু করল, “মাথা তার কবেকার হাইরাইজ বিল্ডিং… কী রে স্বাতী মাথায় এটা কী করেছিস?”
– ওসব তুই বুঝবি না রে! এটা শিল্প! শিল্প!
শাহেদও সুযোগ হাতছাড়া করল না।
– সাংঘাতিক শিল্প! বাবুই পাখি ফেইল! তোর তো ব্যাগ আনার দরকার নেই। মাথার স্কার্ফের এক প্যাঁচে খাতা, আরেক প্যাঁচে বই, আরেক প্যাঁচে টিফিন বক্স….
“তোদের দুইজনকে আমি….” কপট রাগ দেখাতে গিয়ে হেসে ফেলল স্বাতী। ওর সাথে বাকীরাও যোগ দিল। এই ছেলে দু’টো ওদের গ্রুপটাকে মাতিয়ে রাখে সারাক্ষণ। একটু আগের মন খারাপ একদম উধাও হয়ে গেছে হাসি ঠাট্টায়।
২.
দুপুরে প্রেয়ার রুমে উর্মি আর নীরার দেখা হয়ে গেল।
– এই নীরা, স্বাতী মনে হয় ভীষণ রাগ করেছে আমার উপর।
– হিজাব নিয়ে? বাদ দাও রে ভাই। ও একটু রগচটা। আস্তে আস্তে বুঝে যাবে সব।
– আমি আসলে ওকে বুঝিয়েই বলতে চেয়েছিলাম..
– ধুর তুমি চিন্তা কোরো না। তোমার শপের কী খবর বল তো? আমি আবায়া পরা শুরু করব ভাবছি। কিন্তু একটু বিপদে আছি।
– কী বিপদ?
– আমার বাসায় কেউ হিজাব পছন্দ করে না। স্কার্ফ পরতেই অনেক স্ট্রাগল করতে হচ্ছে। তাই শুরুতেই ট্র্যাডিশনাল বোরকা ধরার সাহস পাচ্ছি না।
নীরার কথায় অনেক অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেল। আজ থেকে চার বছর আগের উর্মির সাথে যেন কথা বলছে সে! সামান্য একটা স্কার্ফ পরা নিয়ে বাড়িতে সে কী তুলকালাম কান্ড! স্কার্ফ থেকে আবায়া- বাড়িতে মরাকান্না পড়ে গেল। জায়েজের মধ্যে একটু রঙিন আবায়া, তবু সবার ভয় মেয়ে জংগী হয়ে গেছে। কখনো চোখের পানি, কখনো রাগ, কখনো নীরবতায় সময় পার করে দিয়ে আজ সে আগাগোড়া কালো কাপড়ে ঢাকা।
অনেক কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল উর্মি।
– নীরা, আমি নতুনদের জন্য বেশকিছু আবায়া ডিজাইন করেছি। এখনও ছবি তোলার জন্য ম্যানিকিন যোগাড় করি নি। কিছুদিন পর ছবি দেখাতে পারব তোমাকে।
– এত কষ্ট না করে তুমি বিদেশী মডেলদের ছবি দিলেই তো পারো।
– নাহ! ওরা কষ্ট করে নিজেদের বিজনেসের জন্য ছবি তুলেছে। মাগনা মাগনা সেগুলো নিতে মন একদম সায় দেয় না! তাছাড়া অনেক আবায়ার ডিজাইন মডেস্ট কিন্তু পিকচার খুব আপত্তিকর লাগে।
– হ্যাঁ ঠিকই বলেছো। একবার তো একটা ছবিতে দেখলাম গলার ডিজাইন বোঝাতে এত জ্যুম করে ছবিটা তুলেছে…
নীরার আরও কিছু বলার ছিল। কিন্তু স্বাতী ফোন দিয়েছে। লাঞ্চের জন্য তাড়া দিচ্ছে। সবাই বসে আছে ক্যান্টিনে। উর্মিও ওর সাথে ক্যান্টিনের পথ ধরলো। লাঞ্চ কিনে কমনরুমে চলে আসবে।
৩.
– কী রে ঐ নিনজার সাথে তোর কীসের এত কথা?
কিছুটা রাগত স্বরেই স্বাতী প্রশ্ন করল। সকালের স্মৃতি এখনও ভুলতে পারে নি।
– ওর শপ থেকে আবায়া কিনব ভাবছি। তাই কথা বলছিলাম।
– তুই ওর শপ থেকে কী কিনবি? পশ লুক হিজাব থেকে আবায়া নে। রিজনেবল প্রাইসে অনেক গর্জ্যেস আবায়া আছে। শাবনাজ আপুকে আমার কথা বলবি। ডিসকাউন্ট পাবি। ওর শপে কালো আলখেল্লা ছাড়া কিছু আছে নাকি?
– আমার আসলে খুব বেশি জমকালো আবায়া পরার ইচ্ছা নেই। উর্মির শপে কালারফুল কিন্তু সিম্পল আবায়া পাব মনে হচ্ছে।
-হ্যাঁ হ্যাঁ আমিও উর্মির শপ থেকে বোরকা কিনব। ভাইভা বোর্ডে বোরকা পরে যাব। টীচাররা চিনতে পারবে না।
শাহেদের কথায় সবাই হেসে উঠল। এরকম মেয়েলি আলোচনায় প্রায়ই ওদের মেয়ে হয়ে যেতে হয়। তবু সংগ ছাড়তে পারে না। বন্ধু বলে কথা! অনিক ওর সাথে তাল দিল।
– আমিও বোরকা পরব। ভাইদের জন্য বিশেষ কোনো ছাড় আছে? ওর শপের নাম কী?
– আমার মনে হয়…ওর শপের নাম…উম্মম…পর্দা পুশিদা! ঠিক না নীরা?
শাহেদের এমন নামকরণে আবার হাসির রোল। পর্দা পুশিদা একদম পার্ফেক্ট! উর্মির মধ্যযুগীয় চালচলনের সাথে বেশ মানিয়ে যায়।
৪.
উর্মি সকালের ক্লাসটা মিস করেছে। সারারাত টেনশনে ঘুমাতে পারে নি। ফজর পড়ে প্রচন্ড ঘুম পেল। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে ক্লাস মিস। নীরার থেকে খাতা নিয়ে ক্লাসরুমে বসে লেকচার তুলছে এখন। কালকের ঘটনা এখনও ভুলতে পারছে না। নতুন আবায়াগুলোর ছবি আপলোডের পর তুলকালাম হয়ে গেছে।
কত কষ্ট করে আলেমদের সাথে যোগাযোগের পর ও আবায়াগুলো শপে এনেছে। কিন্তু ফেসবুকে ছবি আপলোডের পরপরই প্রতিবাদে কমেন্ট থ্রেড ভেসে গেছে। এক আপু সরাসরি ফোন দিয়ে বলেছেন রঙিন আবায়া এনে ও দ্বীন নিয়ে ব্যবসা করছে।
উর্মি আপুকে বোঝাতে পারে নি কিছুই। উলটো আপু ওর হেদায়েতের দু’আ করে ফোন রেখে দিয়েছেন।
মন ভীষণ বিক্ষিপ্ত। লেকচার তুলতে আর ইচ্ছে করছে না। একটু দূরে নীরারা হৈ হুল্লোড় করছে। স্বাতীর গলায় গোটা ক্লাসরুম গমগম করছে।
কাল পশ লুক হিজাবের এনিভার্সারি উপলক্ষে র্যাম্প শো হবে। স্বাতী এরাবিয়ান মিউজিক ট্র্যাকের সাথে র্যাম্পে হাঁটবে। সেটা নিয়েই কথা হচ্ছে।
অনিক যেতে রাজি হচ্ছে না। নীরা বোঝাচ্ছে, আমাদের ফ্রেন্ডের শো, তুই যাবি না কেন?
শাহেদ মজা করে বলল, ও স্বাতীর র্যাম্প দেখবে না রে… ও পর্দাপুশিদার র্যাম্প শো দেখবে। নিনজা আপু জিকির করতে করতে স্টেইজে…
– আস্তাগফিরুল্লাহ! হে যুবক! দৃষ্টি অবনত কর!
অনিক টিটকারির ষোলকলা পূর্ণ করে দিল।
নীরা অস্বস্তিতে, বাকীরা খিক খিক করে হাসছে।
উর্মি আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না। ‘দ্বীন নিয়ে ব্যবসা’ না করে ও যদি দ্বীন ছেড়ে হিজাব ব্যবসা করত, তাহলে হয়ত চতুর্দিকের আক্রমণে এতটা কোণঠাসা হয়ে পড়ত না!
—————————-
উভয় সংকট
আনা আমাতুল্লাহ
মার্চ ৩১, ২০১৮ইং