দরজার ওপারে

ভোর ছয়টা। হসপিটাল এর বেডটার ঠিক বা পাশটাতে টিমটিম করে মৃদু আলো জ্বলছে। লাইটের ঠিক সামনে ঝুলন্ত স্যালাইন টা একবার লাইটটাকে ঢেকে দিচ্ছে আবার সরে দাঁড়াচ্ছে। তিতিরের কাছে অপার্থিব নৃত্য মনে হচ্ছে।

তিতির এই মুহুর্তে কিছুই ওরকম ভাবতে চাচ্ছে না। নাকে ফিনাইল আর ওষুধের গন্ধ ওকে বেশ বিরক্ত করছে। মাথার ভেতর এলোমেলো কিছু ছবি ভেসে আসছে। ছোট ছোট কিছু গল্প মারাত্মকভাবে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ওকে।

ও কিছুক্ষণ মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে ভাবার চেষ্টা করলো।ছোট দুটো মুখ সেই ভাবনার ঠিক সামনে এসে দাঁড়িয়ে প্রবল ভাবে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করছে। তিতির দেখতে পাচ্ছে অপেক্ষাকৃত বড় শিশুটি দুই হাত মুঠ করে ছোট শিশুটির পিঠে সজোরে একটা কিল বসিয়ে দিলো। ছোট শিশুটি কিছুক্ষণ প্রবল অভিমানে তাকিয়ে থেকে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে।” আম্মুউউউউউউ বাউয়া মাছ্ছে”।

তিতির আপ্রাণ চেষ্টা করছে বড়টার পেছন পেছন দৌড়ে গিয়ে কান ধরে একটা টান দিতে। তিতির কিছুতেই পারছে না। অথচ বড় সোফাটার ঠিক পেছনের চিপা জায়গাটাতে বড়টা লুকিয়ে এই লম্বা লম্বা নিশ্বাস ফেলছে এটা ও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। এমনকি নিশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছে। আস্তে আস্তে ছোট মুখ দুটো মিলিয়ে যাচ্ছে।

শুধু ওষুধের ঝাঁঝালো গন্ধ তীব্রতর হচ্ছে। বুকের ভেতর অপার্থিব একটা শূন্যতা বোধ করছে তিতির।

কিছু সময় পার হলো। ঘড়িটা বড় বিচ্ছিরি রকমের শব্দ করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছে। টিক টিক শব্দে মাথার দুপাশ দপদপ করছে তিতিরের। যত চেষ্টা করছে শব্দটা সরিয়ে ফেলবার তত এম্বুলেন্স এর তীক্ষ্ণ শব্দের মত আরো চেপে বসে এক ধরনের আতংক তৈরি করছে। টেকিকার্ডিয়া রোগীর মত বুকটা ধকধক করছে। ও আবার মৃত্যু নিয়ে ভাববার চেষ্টা করছে। মৃত্যুর আতংক ওকে গ্রাস করতে করতেই ওর সামনে ভেসে উঠছে দুইটা স্কুল ব্যাগ। একটা অপেক্ষাকৃত বড় আসমানি নীল রঙের। একটা চেইন হা করে খোলা। এটা বড় শিশুটির স্কুল ব্যাগ। আরেকটা ব্যাগ কালচে খয়েরী কতগুলা হলুদ আর কমলা রঙের স্মাইলি আঁকা। এই ব্যাগটা বেশ পরিপাটি। তিতির এর চিন্তা ব্যাগ দুটোর ভেতরে থাকা ডায়েরী দুটোর দিকে। হোমওয়ার্কগুলো শেষ হয় নি। রাত বাড়ছে। তিতির গলার রগ ফুলিয়ে ওদের ডাকলো। ছোটটা ভদ্র বাচ্চার মত ছোট প্লাস্টিকের চেয়ার আর টেবিল ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে হাজির। “আম্মু পলাউ।আম্মু পলাউ”। কিছুক্ষনের মধ্যেই ছোট পাঁচটা আঙুল পেন্সিলে চেপে ধরে কসরত করে একমনে লিখতে থাকলো ‘ h,h,h,h,h,h’। ছোটটার চোখে মুখে গভীর আত্মতৃপ্তি।
বড়টা ক্রিকেট ব্যাট হাতে দৌড়ে এসে করুণ মুখ করে বলতে লাগলো “ আম্মু টেন মিনিটস আর টেন মিনিটস, প্লিজ আম্মু প্লিজ”।

নোওওওও, তিতির এক চিৎকার দিলো।
বড়টা ছল ছল মুখে ইংরেজি খাতা উঁচু বালিশটার উপরে রেখে লিখতে লাগলো। কা ই খা কা- কিক, ই না গা – ইং কিকিং। লিখা শেষ করে পা উঁচু করে লাত্থি দেখালো।

ক্যাচ করে তিতিরের ছোট্ট ক্যাবিনের দরজা খুলে গেলো। পেন্সিল হাতে ধরা শিশু দুটোর মুখ এক ঝটকায় মিলিয়ে গেলো।

নার্স হাতের নিচে থার্মোমিটার লাগিয়ে একের পর এক কাচের বোতল ভেঙে ভেঙে ইঞ্জেকশন রেডি করতে লাগলো। তিতিরের দৃষ্টি সুঁই এর মাথা থেকে ছিটকে পড়া ওষুধে নিবদ্ধ।নার্সটা বেশ ছটফটে টাইপের। গোলমত সুখী সুখী মুখ। আচ্ছা এর কি কখনো গভীর কোন দুঃখ বোধ হয়েছে এই মুহুর্তে তিতিরের যেমন হচ্ছে? তিতির ভাবলো।

ক্যাচ করে গেইটা বন্ধ হয়ে গেলো আবার। তিতির আবার এলোমেলো চিন্তা গুলোকে গুছিয়ে আনবার চেষ্টা করছে। চেষ্টা করছে কবরের ভেতরটা ভাববার। প্রতিটা মানুষকেই মাটি নাকি সজোরে চেপে ধরবে। এরপর প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হবে। তিতির পারবে তো জবাব দিতে? ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছে না।

চোখের সামনে তীব্র ভাবে একটা খুব চিন্তিত মুখ দেখতে পাচ্ছে ও। চিন্তিত মুখের মানুষটাকে তীব্র ভয় গ্রাস করে রেখেছে। মানুষটা চেষ্টা করছে ভয়টাকে একেবারে গুটিয়ে লুকিয়ে কপালের ভাঁজ গুলোর নিচে ভরে ফেলতে। মানবীয় ইমোশন প্রকাশের ভাষা এর জানা নাই। এগুলো প্রকাশকে মানুষটা ব্যক্তিত্বের প্রবল ঘাটতি মনে করে। দুই কাঁধ ভর্তি করে দায়িত্ব নিয়ে লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। একটু পর পর ঠা ঠা শব্দে তার ফোন বেজে উঠছে। কন্ঠে পরিমিত গাম্ভীর্য রেখে যথাসম্ভব স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে চলছে। গতরাতে ঠিকমত খায় নি হয়তো। পাশে রাখা হলুদ রঙের জুসের বোতল থেকে ঢকঢক করে কয়েক ঢোক জুস দিয়ে গলা ভেজানোর চেষ্টা করলো লোকটি। শুকিয়ে যাওয়া ঠোট জিব্ব দিয়ে চেটে ভেজানোর চেষ্টা চালালো খানিকক্ষণ।

তীব্র ব্যাথাটা ভালোভাবে জানান দিচ্ছে। তিতির কিছুক্ষণ চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলো। দুইদিন ধরে কিছু খায় নি ও। মাথাটাও কিঞ্চিত ঘুরে উঠলো মনে হয়।দুই চোখ জোর করে বন্ধ রাখার চেষ্টা করলো ও। মাথার উপর ষাটোর্ধ একটা মমতাময় হাত এর স্পর্শে কিঞ্চিৎ আরামবোধ হল। মানুষটা তিতিরের অনেক কাছের।

তিতির আবার বিচার দিবস নিয়ে ভাবতে চাইলো। পারবে তো উতরে যেতে? খুব শুদ্ধ জীবন কি ও সেই অর্থে পার করতে পেরেছে? তীব্র আকুতি আর আতংক চেপে ধরতে চাইছে ওকে।

তিতিরের বাবার কমলা রঙ এর গলার কিছুটা নিচ পর্যন্ত দাড়ি চোখের সামনে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। ওর মায়ের খানিক বুড়িয়ে যাওয়া চিন্তাক্লিষ্ট চোখের লেপ্টে থাকা কাজল কেমন কান্না কান্না টাইপ বোধ আনছে। তিতির জোর করে মুখ দুটোকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছে।

তিতিরের গভীর ভালোবাসার একটা ছায়াসংগী বন্ধুকে ভাবতে চাইলো। গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো বুক ফুঁড়ে।

কিছু ভাবতে চায় না তিতির। আর কিছুই না। ভাবনাবিহীন জাগ্রত মাথার অনুভূতি কেমন হয় কে জানে। ও শুধু ভাবনাহীন ভাবে শিশু দুটোকে একটু দেখতে চায়। ছায়াসংগী হয়ে।

বড় শিশুটি ভাতের প্লেটের ভাতগুলোকে ইচ্ছা মত নাড়ছে টিংটিঙে আঙুল গুলো দিয়ে।ভাত ঠান্ডা পানির মত হয়ে গেছে। ভুল করে দুই একটা দানা মুখে দিচ্ছে আবার নাড়াছে।

ছোট শিশুটি প্লেটের কিছুটা ভাত শেষ করেছে। প্লেটের বাম কোনায় একটা ইয়া বড় চিংড়ী নিয়ে বসেছে। খোঁসা ছাড়াতে পারছে না কিছুতেই। তিতির ব্যাকুল হয়ে দেখছে। শিশুটির প্রিয় চিংড়ীর খোসা ছাড়িয়ে দিবে কে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছ না ও…

দরজার ওপারে
সানজিদা সিদ্দীকি কথা

মে ০৩, ২০১৮ইং