মায়ের কাছে খোলা চিঠি

মা,

তুমি সংগ্রামী এক নারী। তোমায় দেখেই শিখেছি নিজের সন্তানের জন্য কিভাবে নিজের শেষতম সুখ, শখ-আহ্লাদ, আরাম-আয়েশটুকুও বিলীন করে দেয়া যায়। সবসময় ভুলগুলো বারবার ধরিয়ে দিয়েছ। হয়ত নিজের মেয়েকে অনেক নিখুঁতভাবে সবকিছুতে দেখতে চেয়েছ। 

আমাদের রেখে যখন সংসারের প্রয়োজন মেটাতে স্কুলে পড়াতে যেতে, তখন কি মা অন্য বাচ্চাদের মুখে আমাদের মুখ ভাসতো? সকালে রাস্তা দিয়ে ওই ভোরে তুমি যখন চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে পড়তে আমিপেছন থেকে সব দেখতে পেতাম মা। 

মাত্র উনিশ বছর বয়সে তোমার বিয়ে, চাকরিতে যেতে হবে এ কথা বলেছিলে তুমি কোন দিনও ভাবোনি! জীবনের কঠিন বাস্তবতা তোমার থেকে আমাদের অনেক দূরে নিয়ে গিয়েছিল। বান্ধবীদের বাড়িতে যখন বেড়াতে যেতাম, সবার মা যখন বাসায় সন্তানদের নিয়ে আনন্দ করতো – তা দেখে আমার মনটা হুহু করে হাহাকার করতো। ওদের পরিপূর্ণ পরিবার দেখে আমি নিজেও সুখ পেতে চেষ্টা করতাম।

কোন দিন লজ্জায় কাউকে বলিনি। বান্ধবীরা যখন বাড়ি ফিরে মার সাথে সব কিছু শেয়ার করতো তখন আমি আমার মনের কথা বলার জন্য তোমাকে পাইনি মা! তুমি ছোট বাচ্চা নিয়ে ঘর – সংসার সামলিয়ে বাসায় প্রাইভেটে পড়াশোনা করেছ। এইচ এস সি পাশ সদ্য তরুনী মেয়েটি একা সংসার সামলে বি.এ, এম. এ, বি.এড পাশ করেছিল। 

বাবাকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য সংসারের হাল ধরেছিলে, আমাদের পড়ার খরচ জুগিয়েছ। আজ আমরা ভাই-বোন যে অবস্থানে আছি তার পিছে অনেক বড় অবদান তোমার মা! আজ ভাইয়া কত বড় পজিশন এ হালাল ইনকাম করছে। আল্লাহর রহমতের পর তোমারই সবর আর sacrifice এর ফল এটা। আলহামদুলিল্লাহ আলা কুল্লি হাল।

বাবার মৃত্যুর পরও আত্মসম্মানবোধের জন্য চাকরিটা আর ছাড়তে পারোনি। এখনো নিজের সন্তানদের জন্য রক্ত পানি করে সঞ্চয় করে চলেছ। বাচ্চা নিয়ে একা এত কষ্ট যখন করি মনে হয় তুমি পাশে থাকলে সব কিছু আরো কত সুন্দর হত মা! খুব মিস করি তোমাকে তুমি কি তা বোঝনা?! এই কষ্টই আজ আমাকে একা চলতে শিখিয়েছে, লড়তে শিখিয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ হি রাব্বুল আলামিন।

যারা তোমার চাকরি করা নিয়ে ভ্রূক্ষেপ করবে তাদের বলতে চাই আজ আমরা যা হতে পেরেছি, যতটুকুন এসেছি তা তোমারই অবদান মা। মানুষতো আর জানে না যেদিন আব্বা মারা গিয়েছিলেন, সবাই একটা চাদর দিয়ে আব্বার নিথর দেহ ঢেকে দিতে বলছিলেন, সেদিন আব্বাকে ঢাকার জন্য একটা চাদরও আমরা দিতে পারিনি। কত অভাব গেছে কষ্ট গেছে, কত ঈদে তোমার পরনে নতুন কাপড় ওঠেনি, তাও আমাদের নতুন কাপড় কোন না কোনভাবে তোমরা দিয়েছ। বাকি কষ্টগুলো লিখতে গেলে হাতের লেখা থেমে যায়। বড় লজ্জা লাগে! থাকুক না জমা সব আমার রবের তরে।

আল্লাহর প্রতি সব কঠিন পরিস্থিতিতে তাওয়াক্কুল করা তোমার থেকেই শিখেছি মা। আজও নামাযের প্রতি তোমার এত সিরিয়াসনেস আমাকে মুগ্ধ করে। নিজের সামান্য বিশ্রাম ভুলে তোমার কুরআন নিয়ে বসা আমাকে এখনো অবাক করে। আল্লাহুম্মা বারিক লাহা।

আল্লাহ এর কাছে তোমার সুস্থতা, নেক হায়াত আর একটু যাতে বিশ্রাম নিতে পারো তার জন্য দুয়া করি। ভয় হয় রিটায়ারমেন্টের আগে জানি না আমার বা তোমার কার ডাক চলে আসে মা! আমাদের একসাথে সময় কাটানোর স্বপ্ন না শুধুই স্বপ্ন থেকে যায়। সান্ত্বনা এটাই যে এই দুনিয়ায় নাইবা হল, ইনশাআল্লাহ জান্নাতে। যেখানে তোমার প্রতিটা চোখের পানি আর শরীরের ঘামের একটি করে নহর বইবে ইনশাল্লাহ। এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায় তোমাকে মিস করা প্রতিটা মুহূর্ত একদিন জান্নাতে আমার রব আমাদের ফিরিয়ে দিবেন আমি বিশ্বাস করি। আল্লাহ আমাদের জান্নাতে একত্রিত করুন।

রব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সগিরা। \

মায়ের কাছে খোলা চিঠি
অপরাজিতা শুভ্রা
(৪ জানুয়ারী ২০১৮)