ঘুষ- একটি সামাজিক ব্যাধি

১.

– “এত বড় সুযোগ পেয়েও যে টাকাটা নিলেন না তোমার বাবা! তিনি তো ভুল করেছেন। এখন কাজটা নিয়ে নিতেন…”

– “কিন্তু আন্টি, ঘুষ নেওয়া তো গুনাহর কাজ!”

– “কী বলে ছেলে, রিটায়ারমেন্টের পর হাজ্জ করলেই তো গুনাহ মাফ! এই পদে চাকরী করেও এত বছরে একটা বাড়ি করতে পারলেন না। আফসোস!”

– “আন্টি, ঘুষ নেওয়া হারাম।”

– “কোন যুগে আছ তুমি?! দেখো, তোমার বাবা যদি ঘুষ খেতেন তুমি আজকে নিজের গাড়িতে চলতে। আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ির গ্লাস নামিয়ে আমাকে সালাম দিতে। আমিও বলতাম, বাহ্ তোমাদের গাড়িটা তো খুব সুন্দর!”

– “আমাদের গাড়ির দরকার নেই আন্টি, মান সম্মানটাই আসল। আল্লাহ্‌কে অবশ্যই ভয় করা উচিৎ আমাদের।”

– “আল্লাহ্‌ কি তোমাকে গাড়িতে চড়তে মানা করেছেন নাকি! তোমার বাবার কলিগরা কি ঘুষ নিচ্ছে না? তোমার এখনও সুযোগ আছে সরকারী চাকরিটা পাওয়ার। তাছাড়া তোমাদের ফ্যামিলির লিংকও তো আছে। এখন ইয়াং এজ, টাকা কামানোর সময়। আমি তো আমার ছেলেকে পারলে এখনই সরকারি চাকরিতে ঢুকাই। যত টাকা হোক, দিতে রাজি আছি — কয় মাসের মধ্যে টাকা উসুল হয়ে যাবে।”

আমি আর তর্ক বাড়ালাম না। কারণ এতে আন্টির চিন্তাধারায় এত সহজে পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না। কিন্তু তিনি একজন শিক্ষিকা হয়ে কী করে এমন ধারণা রাখতে পারেন, মেলাতে পারলাম না। এত দিন তাকে কত ভালো জানতাম। ভেবেছিলাম কত সৎভাবে তিনি তার ছেলেদের বড় করেছেন। আসলে মানুষের সাথে না মিশলে চেনার উপায় নেই।

আমি আরো ভাবতে লাগলাম — কী করে একটা মানুষ এত সহজভাবে হারাম কাজে উৎসাহ দিতে পারেন? কেন তিনি আল্লাহ্‌কে ভয় করেন না? একটুও কি লজ্জা হলো না তার? একজন শিক্ষিকা কিভাবে এমনটা ভাবতে পারেন? যিনি কিনা তার ছাত্রছাত্রীদের সারাজীবন সৎ পথে চলতে শেখান। সব কি তাহলে শুধু বইয়ের পাতায় রয়ে গেল!

একদিন আমাদের চারতলায় এক ভদ্রমহিলার সাথে পরিচয় হলো। আমার গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ হওয়ার কয় মাস পর চাকরি হয়েছে শুনে তিনি তার ছেলের জন্য আফসোস করে বলছিলেন, “আমার ছেলেটা এমবিএ করে ঘরে বসে আছে প্রায় দুই বছর, এখনো চাকরি হচ্ছে না। আল্লাহর কাছে কত দুয়া যে করি। কত যে কাঁদি। তাহাজ্জুদ পড়ে চাই, আল্লাহ যত টাকা লাগবে আমি দিব, কিন্তু আমার ছেলেটাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দাও!”

এই কথাটা তিনি কয়েক বার বলার পর আমি বললাম, “আন্টি একটা কথা বলি কিছু মনে করবেন না প্লিজ। আল্লাহর কি আপনার টাকার দরকার আছে? এই যে আপনি ঘুষ দিতে চাচ্ছেন। তাহলে আপনার দুয়া কিভাবে কবুল হবে? আপনি জানেন তাহাজ্জুদের সময়ে করা দুয়া ফিরে আসে না। আপনি জানেন মায়ের দুয়া আল্লাহ ফিরিয়ে দেন না। আপনি নিশ্চয় এটাও জানেন ঘুষ হারাম। আপনি ‘আর-রাজ্জাক’ এর উপর পুরোপুরি বিশ্বাস রাখছেন না; বরং আপনার টাকার জোর দেখাচ্ছেন, তা-ও আবার যিনি আপনাকে এই টাকা দান করেছেন তার সাথে।”

ভদ্রমহিলা চুপচাপ কথাগুলো শুনলেন। এরপর তিনি বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ বাবা। আমি আসলে ছেলেকে নিয়ে এত চিন্তায় আছি…। আর চারদিকে যাদের চাকরি হচ্ছে তারা হয় বড় লিংক ধরে চাকরি নিচ্ছে না হয় ঘুষ দিয়ে। কিন্তু তোমার কথা সত্যি, আল্লাহ আমার ছেলের রিযক যেখানে রেখেছেন সেখানেই তো হবে।”

২.

“ঘুষ” নামক সামাজিক ব্যাধি মানুষের মনে এমনভাবে ছড়িয়ে গেছে যে যেকোনো কাজে ঘুষ লাগবেই, তার জন্য সবাই পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে রাখে। সেটা বাচ্চাকে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য হোক, আর হজ্জ্বের পাসপোর্টের এড্রেস ভেরিফিকেশনের জন্য হোক।

আর যারা ঘুষ নিচ্ছেন নির্দ্বিধায় — অন্য সেক্টর না হয় বাদ দিলাম — কিন্তু সরকারি চাকরিজীবিদের কত বেতন তা তো সবাই জানে। তাহলে তাদের পরিবার কেন তাদের ঘুষ নিতে বাধা দেয় না? তাদের পরিবারের মানুষ কি তাদের ভালবাসে না? অবশ্যই বাসে! তাদের ভয় হয় না তাদের প্রিয় মানুষটাকে জাহান্নামের আগুনে পুড়তে হবে? তারা টাকাকে সম্মান মনে করে। হয়তো মানুষ তাদের সামনাসামনি সম্মান করে, কিন্তু পিঠপিছে তো ঠিকই ঘুষখোর চোর বলে। এবং তারা সেটা জানেও। এটা তাহলে কেমন সম্মান হলো?

আর পরকাল! তাদের জন্য পরকাল বলতে কী থাকল? সে একদিন এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবে। সে চলে যাওয়ার পরেও কি মানুষ বলবে লোকটা অনেক ভালো ছিল? নাকি বলবে, ঘুষখোরের জন্য দুয়া করে কি লাভ!

ঘুষ হয়তো অনেকে নিচ্ছে না কিন্তু জীবনে অনেক কাজ আদায়ের জন্য মানুষ ঘুষ দিতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ আল্লাহ এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসসাল্লাম ঘুষ দাতা এবং গ্রহীতা — উভয়কেই অভিশাপ দিয়েছেন।
.
‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আস (রা.) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘুষ দাতা ও ঘুষ গ্রহীতাকে অভিশাপ করেছেন।”

[সুনানে আবু দাউদ, ৩৫৮০]
.
আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “এমন এক যুগ আসবে, যখন মানুষ পরোয়া করবে না যে সে কোথা থেকে সম্পদ উপার্জন করল, হালাল থেকে না হারাম থেকে।”

[সহিহ বুখারী, ২০৫৯]

বর্তমানে সে যুগেই আছি আমরা।

ঘুষ- একটি সামাজিক ব্যাধি

আদিনা আমাতুল্লাহ

অগাস্ট ২৯, ২০১৯ইং