স্বপ্নপুরুষ

১.
মুনিরাদের ভার্সিটির ক্যান্টিনে কয়েকদিন ধরে সবচেয়ে মুখরোচক যে বিষয়টি নিয়ে আলাপ হচ্ছে, তা হল “আবরার স্যার”। সদ্য আমেরিকা ফেরত ইয়াং, আনম্যারেড এই স্যার কে ঘিরে মেয়েদের আগ্রহের শেষ নেই। প্রচুর মেয়ে তার জন্য ইতোমধ্যে দিওয়ানা হয়ে গিয়েছে। 

একজন স্যারের জন্য মানুষ কিভাবে দিওয়ানা হয়, তা ভাবতেও অবাক লাগে মুনিরার। এই সেমিস্টারে তাদের একটি ক্লাস নেবেন এই ভদ্রলোক। ক্লাসের বাঁধন তো আগে থেকেই এই লোকের জন্য ফিদা। তাই এ সেমিস্টারে স্যার কেন মাত্র একটি সাবজেক্টের ক্লাস নেবেন, সবগুলো সাবজেক্ট নেবেন না, এই ব্যাপারে তাকে বেশ দুঃখিত মনে হচ্ছে। 

ওদের ক্লাসে ওরা অল্প কিছু মেয়ে, তাই ক্লাসের ছেলেরা সব সময়েই বেশ আগ্রহ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে, কোন স্যার কোন মেয়ের দিকে বেশিক্ষণ তাকাচ্ছে। আর স্যার চলে গেলেই এই নিয়ে তাদের ক্ষ্যাপানো শুরু হয়ে যায়।

এবার কি হবে ভাবতেই মুনিরার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে, বাঁধন এমনিতেই স্যারের জন্য পাগল, ক্লাসের ছেলেরা টের পেলে খবর হয়ে যাবে। টিচার্স রুমে ব্যাপারটা পৌঁছলে খুবই লজ্জাজনক হবে।

অতএব বাঁধনকে চোখে চোখে রাখতে হবে। তাছাড়া ওই স্যারের কথা চিন্তা করেও সে অবাক হলো। সব মেয়েরা কেনো তার জন্য এমন করে, সে কি এমন আহামরি হতে পারে, মুনিরা ভেবে পেলো না। 

২.
প্রথম ক্লাসে সবাই শিক্ষক আসার অপেক্ষায় আছে, ক্লাসের সব মেয়েরা আজ বেশ সাজগোজ করে এসেছে। এদের মাঝে মুনিরাই একমাত্র মাথায় কাপড় দিয়ে সাধারণ বেশভূষায় আছে। 

স্যার ক্লাসে এলেন, ব্লু জিন্সের ওপর একটা সাদা শার্ট পড়ে, দেখতে তেমন বিশেষ কিছু মনে হলো না মুনিরার। তাছাড়া পুরো সময়েই তিনি বেশ ব্যক্তিত্ব নিয়ে গম্ভীর ভাবে রইলেন। মেয়েদের সাথে পারতপক্ষে কথা বললেন না। ক্লাসের মাঝে মুনিরাকে দাঁড় করিয়ে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, সে থতমত খেয়ে যাওয়ায় একরকম অপমানই করলেন বলা যায়।

ক্লাস শেষে চূড়ান্ত মেজাজ খারাপ নিয়ে বের হলো মুনিরা, প্রায় রেগে গিয়ে বাঁধনকে বললো, “এই তোর বিখ্যাত স্যার? অহেতুক এতো মানুষের সামনে অপমান করলো আমাকে! জানি তো, এইসব আমেরিকা ফেরত মানুষের হিজাব পড়া মেয়ে দেখলেই জ্বলুনি শুরু হয়ে যায়, অহেতুক তাদের পেছনে লাগে তখন”। 

বাঁধন মিটিমিটি হেসে বললো, “আমার তো কাহিনী অন্যরকম মনে হচ্ছে, স্যার তোর দিকে কিভাবে তাকিয়ে ছিলো, দেখিস নি? 

“ফালতু কথা বলবি না তো! তোর মাথায় এইসব গোবর ভরা আইডিয়া ছাড়া কি আর কিছুই নেই?” 

সেদিন মুনিরা বাসায় এসে অনেক্ষণ কাঁদলো ও এই দীর্ঘ চার মাসের সেমিস্টার কিভাবে কাটাবে তা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো। যদিও সে তখনো জানতো না, এ লোকের সাথে তার জীবন জড়িয়ে গিয়ে, কি অদ্ভুত পরিস্থিতির স্বীকার হবে সে। যদি কল্পনাও করতে পারতো, নির্ঘাত সেদিনই সাবজেক্ট ড্রপ করে ফেলতো। 

এভাবে দু এক সপ্তাহ চলে গেলো। স্যার আজকাল ক্লাসে এসে অনেক গল্প করেন, তার দেশ বিদেশের ঘোরাঘুরির অভিজ্ঞতা মিলিয়ে মিশিয়ে, রিয়েল লাইফ উদাহরণ দিয়ে যথেষ্ট আকর্ষণীয় করেই মার্কেটিং পড়ান। 

আজকাল আর মুনিরাকে অপমান করেন না, কিন্তু মেয়েদের কে মনে হয় প্রশ্ন একটু বেশিই করেন। বাঁধন আর মুনিরাকে সব চেয়ে বেশী করেন। যাই হোক, এখন স্যারকে আর অত অমানবিক লাগে না মুনিরার। 

এর মাঝে এক দিন ক্লাস শেষে দুপুরে বাসায় ফিরে বেশ বড় ধরণের একটা ঝটকা খেলো সে। ভাত খাওয়ার পর, মা তাকে নিয়ে বসলো। বললো, “তোদের ভার্সিটি তে আবরার নামের কেও পড়ায়?”

মুনিরা মোটামোটি আকাশ থেকে পড়ে বললো, “হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কি করে জানো মা?”

“তোর ভার্সিটির সিনিয়র একজন শিক্ষক, অভিভাবকের নাম্বারের লিস্ট থেকে নাম্বার নিয়ে তোর বাবার কাছে ফোন দিয়েছেন, ফোন দিয়ে বলেছেন, আবরার নামের এক স্যার পারিবারিক ভাবে তোর জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে চান।

এ ব্যাপারে তোর মত জানতে চাচ্ছি। আমি আসলে ভাবতে পারছি না, শিক্ষক হয়ে কিভাবে কোন মানুষ স্টুডেন্ট এর জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়! তোর সাথে ডাইরেক্ট কিছু বলেছে? তোদের মাঝে কোন সম্পর্ক নেই তো? সত্য কথা বল।”

“মা, কি বলো এসব? তোমার মেয়ে কখনো তোমাদের বিশ্বাস ভাংবে না। আর এই লোক কে তোমরা মানা করে দাও।” প্রায় কেঁদে ফেললো মুনিরা। ক্লাসের এতো মেয়ে যার জন্য পাগল হয়ে আছে, এমন ব্যাক্তিকে বিয়ে করার কোন শখ নেই ওর। কিন্তু এ কথা তো আর মা কে বলা যাচ্ছে না। 

পরদিন সকালে ক্লাসে যাবার সময় মুনিরার মনে হচ্ছিলো, সে লজ্জায় ও মরমে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। যে মানুষ তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে, তার ক্লাস কিভাবে করবে? আবার না করেও উপায় নেই। একে তো সামনে মিড টার্ম, তার ওপর বাঁধনটা বিরাট বুদ্ধিমতি, দু মিনিটে ওর পেট থেকে আসল কথা বের করে ফেলবে। তখন আরো লজ্জার হবে ব্যাপারটা!

এই প্রথমবারের মতো ওর মনে হলো, ইশ, হিজাবের সাথে যদি বোরকাও পড়তো, তাহলে হয়তো এই মুসিবতে তাকে পড়তে হতো না। বোরকাওয়ালা কারো জন্য নিশ্চয় কোন স্যার বাসায় প্রস্তাব পাঠাতো না!

ক্লাসের চল্লিশ মিনিট, চল্লিশ ঘণ্টার মতো মনে হলো মুনিরার। ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে গেলো। কিন্তু স্যার আজ ওকে কোন প্রশ্নও করলেন না, ওর দিকে তাকালেনও না, যেনো ওর কোন অস্তিত্বই নেই। ক্লাস শেষে মুনিরার ঘাম দিয়ে যেনো জ্বর ছাড়লো আর মনের গহীনে আবরার সাহেবের প্রতি কিছুটা কৃতজ্ঞতাও অনুভব করলো, সবার সামনে কোন ওলোট পালট কথা না বলার জন্য।

এভাবে বেশ কয়েকদিন গেলো, বাসায় কেও আর এই বিষয়ে কোন কথা বললো না, স্যারও এমন ব্যাবহার করে যেতে লাগলেন, যেন মুনিরা একজন অদৃশ্য মানবী।

৩.
হঠাত একদিন বিকেলে মা আবার কামরায় এলেন। আর ঘোষণা দিলেন, তোর বাবার ইমেলে ঐ সিনিয়র শিক্ষক (যিনি ঘটকালি করছেন) আবরারের বায়ো ডেটা পাঠিয়েছেন। আমাদের বেশ ভালো লেগেছে, আমরা খোঁজ খবর নিয়ে দেখবো। সব যদি ভালো হয়, তাহলে এমন সম্বন্ধ হেলায় হারাতে চাই না।”

মুনিরার আজ প্রথম দিনের মতো অতো খারাপ লাগলো না, এ ক’দিন স্যারের মার্জিত ব্যবহারে তার মনটাও কিছুটা অনুকূলে হাওয়া দিচ্ছে। বিয়ে তো এক সময় করতেই হবে। মা বাবা পছন্দ করলে সে আর আপত্তি করবে না। 

সেদিন সন্ধ্যায় অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এলো। 

“হ্যালো, মুনিরা আছে?
-জ্বী বলছি।
-আমি আবরার, আপনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি?

প্রথম মুনিরা কিছুটা আড়ষ্ট বোধ করলেও, একসময় তার নিজেরো ভালো লাগতে লাগলো। জীবনে কোন ছেলের সাথে সম্পর্কতে না জড়ানোর বিষয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ওর মনে হতে লাগলো, ও তো প্রেম করছে না। বাবা মার অমতে তো কিছু করছে না। আর ধর্ম নিশ্চয় অতো কঠিন নয়, বিয়ের নিয়তে একটু জানাশোনা হলে ক্ষতি কি! 

এভাবে প্রেম বিরোধী মুনিরাও ধীরে ধীরে অদ্ভুত এক জালে জড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। আবরার তাকে বোঝালো ক্লাসে কারো সাথে এ বিষয় শেয়ার না করতে, বিশেষ করে বাঁধন কে কিছু না বলতে, কারণ এই মেয়ে, এমন মজাদার খবর পেলে মুহুর্তে সারা দুনিয়া রাষ্ট্র করে দেবে। 

দু/ তিন দিন কথা বলার পর মুনিরার মনের গভীর থেকে কোথায় যেনো খুঁতখুঁত করতে লাগলো তার বার বার মনে হতে লাগলো কিছু একটা ভুল হচ্ছে কোথাও। কারন যতবার আবরার কে বলে দু পরিবারের দেখা করিয়ে দিতে, ততবার সে নানা ছল ছুতোয় এড়িয়ে যাচ্ছিলো। কখনো তার দাদীর অসুখ আবার কখনো বোনের পরীক্ষা ইত্যাদি নানা অজুহাত দেখাতে লাগলো। 

কয়েকদিন এভাবে যাবার পর, একদিন আবরার তাকে প্রস্তাব দিলো, “চলো আমরা ডেটিং এ যাই, একসাথে লাঞ্চ করবো। এভাবে একে অপরকে আরো ভালো ভাবে জানতে পারবো।”

এবার মুনিরার আসল স্বত্বাটি যেনো জেগে উঠলো, সেই স্বত্বা বার বার তাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করতে লাগলো। হঠাত তার মনে হলো, বিয়ে তো এখনো হয় নি, সে কেনো একটি ছেলের সাথে কথা বলছে? ও কি অনুধাবন করতে পারছে না, কি পরিমান গুনাহের সাগরে ডুবে যাচ্ছে দিনে দিনে? যেখানে কথা বলাও পাপ, সেখানে দেখা করতে যাবার তো প্রশ্নই ওঠে না। 

অতএব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো, সে দেখা করতে তো যাবেই না, বরং ফোনেও আর কথা বলবে না। যতই কষ্ট হোক, মানুষটার প্রতি যতই টান অনুভব করুক না কেন, আল্লাহ্‌ এর ভয়ে গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য হলেও তাকে এ সম্পর্ক থেকে সরে আসতে হবে।

যদি ভাগ্যে থাকে, বিয়ে হবে। তা না হলে সবর করবে। 

সেদিনই সে মা কে দিয়ে জানিয়ে দিলো, যদি আবরার তাকে সত্যিই বিয়ে করতে চায়, তবে যেন পুরোপুরি পারিবারিক ভাবে আসে, আলাদা করে যেনো যোগাযোগ না করে।

৪.
এরপরের ঘটনাগুলো বেশ দ্রুত ঘটে গেলো। আবরার তার পরিবার নিয়ে আর এলো না। বোঝা গেলো, শুধু প্রেম করা আর ঘুরে ফিরে বেড়ানোতেই তার আগ্রহ সীমাবদ্ধ ছিলো। বিয়ের প্রস্তাব ছিলো মুনিরা পর্যন্ত পৌঁছানোর ছুতো মাত্র। উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য সে সিনিয়র একজন শিক্ষক কে জড়াতেও দ্বিধা করে নি।

ঘটনা এখানে থেমে গেলেই ভালো হতো। কিন্তু আরো অনেক কিছু দেখার ছিলো ভাগ্যে। কিছুদিনের মাঝে আবিষ্কার হলো, এই লোক মুনিরা, বাঁধন এবং অন্যান্য ক্লাসের বুশরা ও নায়লা নামের আরো দু’জন মেয়ের সাথে একইসাথে ফোনে কথা বলতো। তাদের সাথে ঘুরে বেড়াতো, ডেটিং এ যেতো। একজন মেয়ের সাথে অনেকদিন আনন্দ করার পর, তাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য মেয়ের সাথে জড়াতো। 

সব মেয়েদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতো, কিন্তু মুনিরাকে কিছুতেই বাগে আনতে না পেরে, বিয়ের প্রস্তাবের নাটক সাজিয়েছিলো!

এর মাঝে বাবা খবর আনলেন, আবরার স্যারের দেয়া বায়োডেটায় মিথ্যার ছড়াছড়ি। তার পরিবারের নাম ঠিকানায় খোঁজ নিয়ে কাওকে পাওয়া যায় নি। 

মুনিরা যতো এসব শুনতে লাগলো, ততই তার আতংকে গলা শুকিয়ে যেতে লাগলো। আল্লাহ্‌ তাকে কত ভয়ংকর ফাঁদ থেকে বাঁচিয়েছেন, ভেবে হৃদয়টা কৃতজ্ঞতায় ভরে গেলো। 

চার/পাঁচ দিন কথা বলার পরই বিবেকের দংশনে সে সরে এসেছিলো, তা না হলে অন্য মেয়েদের মতো ব্যবহৃত হবার পর মুখ থুবড়ে পড়তে হতো তাকেও। 

ভাগ্যিস আল্লাহ্‌ এর শাস্তির ভয় অন্তরে দৃঢ় ভাবে গেঁথে ছিলো, ফলে অপমানিত হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেলো ও। 

পরবর্তীতে আবরার স্যারের কীর্তীকলাপ জানাজানি হবার পর ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তাকে বহিষ্কার করেছিলো। 

কিন্তু এক আবরার ধরা পড়লেও, প্রতিনিয়ত কত শত আবরার মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। অভিভাবকেরা যদি কিছুটা সচেতন হতো আর মেয়েরাও যদি অনৈতিক বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতো, তাহলে বুশরা, নায়লাদের মতো মেয়েরা বেঁচে যেতো এসব মিথ্যায় জড়ানো ‘স্বপ্নপুরুষ’ দের কালো থাবা থেকে। 

স্বপ্নপুরুষ
বিনতে হক
(৩ ডিসেম্বর ২০১৭)