হার না মানা জীবন

১।
একটা হালাকা শেষে শোভা, রত্না আর শান্তা তিনজন একসাথে বাড়ি ফিরছিল। রমাদান মাস। শেষ দশ দশক চলছে। লাইলাতুল ক্কদরের ওপর আলোচনা হয়েছে হালাকায়। আল্লাহর নাম আল-‘আফুউ এর অর্থ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা শুনে ওরা কেউই না কেঁদে থাকতে পারেনি এই ভেবে যে ওদের রব কত্ত বেশি দয়াময়! কতটা ভালবাসেন তিনি তাঁর বান্দাদের যে তিনি বান্দাদের গুনাহ ক্ষমা করে দিতে ভালবাসেন, সুবহানআল্লাহ!

ওরা তিনজনই অল্প কিছুদিন হোল হালাকায় যাওয়া শুরু করেছে। এত চমৎকার একটা হালাকা শুনে গাড়িতে উঠে তিনজনই বেশ প্রশান্ত মনে ছিল। এমন সময় হঠাত শোভার ফোন বেজে উঠল।

“হ্যালো আম্মা। … কী?! … কেন হঠাত! … কী জানি এমন তো আগে কখনো দেখিনি ওকে … আচ্ছা আমি আসছি।”

উদ্বিগ্ন শোভা ফোন রাখতেই বাকিরা ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। শোভা শুধু আস্তে করে বলল, “তোদের ভাইয়া রাতে ছিল আমাদের বাসায়, এখনো আছে। কিছু সমস্যা হচ্ছে মনে হয়। আম্মা তাড়াতাড়ি যেতে বলল।”

এরপর আরও কয়েকবার শোভার মা ফোন দিলেন। গাড়ি নিয়ে উড়ে যেতে পারলে তাই করত শোভা। টেনশন আর ভালো লাগছে না!

শোভার বিয়ে হয়েছে বছর খানেক হোল। দুইজনই এখনো পড়াশোনার মাঝে আছে তাই আপাতত ঠিক হয়েছে পড়াশোনা শেষ হলে পরেই ওকে শ্বশুরবাড়ি নেবে। ওর বর এখন মাঝে মাঝে আসা-যাওয়া করে ওদের বাসায়।

২। 
এরপর সারাটা দিন আর শোভার সাথে ওদের কারো যোগাযোগ হয়নি। হোয়াটসঅ্যাপে ওদের তিনজনের একটা গ্রুপ আছে। রাতে সালাত পড়ার আগে রত্না একবার মেসেজ দিয়েছিল কিন্তু শোভার কোন উত্তর নেই। রাত ১২টার সময়ও যখন শোভা মেসেজ সিন করল না তখন শান্তা একবার ফোনও দিয়েছিল, কিন্তু সেটাও শোভা রিসিভ করেনি।

শোভার মেসেজ পাওয়া গেল পরদিন সন্ধ্যায়। ওর বর ওদের বাসায় সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর বেশ অদ্ভূত আচরণ করছিল, নিজের জামা খুলে ফেলে সিন ক্রিয়েট করছিল। ও বাসায় ফেরার পর ওর বাবাসহ ওর বরকে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেছে সারাদিন।

শেষে এক জায়গায় ভর্তি করে রেখে এসেছে মানসিক চিকিৎসার জন্য। এই সময়ের মাঝে ওর বরের আচরণ আরও অসংলগ্ন হয়ে ওঠে। হাসপাতালে একবার ওর গায়ে হাতও তুলতে গিয়েছিল। শেষে ওর চাচা এসে পরিস্থিতি দেখার দায়িত্ব নিলে ওরা বাসায় ফেরে। 
সবার মনের ভেতর একটা মিশ্র অনুভূতি হয় ওর এই মেসেজ দেখে। কেন একটা মানুষ হঠাত এমন করবে!

৩।
“তোরা আমার ফেসবুক একাউন্ট আনফ্রেন্ড করে দে জলদি, হ্যাক হয়েছে।” শোভার মেসেজ দেখে তখনই ফেসবুকে ঢুকল শান্তা। শোভার ওয়ালের লেখাগুলো পরে তো ওর মাথা ঘুরে উঠল! বাজে ভাষায় উলটাপালটা অনেককিছু লেখা। তবে লেখা দেখে মনে হচ্ছে হ্যাকার শোভাকে চেনে। একথা শোভাকে বলতে ও আর না বলে থাকতে পারল না, “হ্যাকার আমার জামাই! আমার জামাই ড্রাগ এডিক্ট!”
স্তব্ধ হয়ে গেল বাকি দুইজন এই মেসেজ দেখে।

৪।
“আমরা তো ওইদিন বুঝতেই পারিনি ওর কী সমস্যা হয়েছিল। ভাবছিলাম কোন মানসিক সমস্যা কি না! পরে আস্তে আস্তে আগের কিছু ঘটনার সাথে মেলাই, ওর এক বন্ধুর থেকেও চাচা জানতে পারে আসল ব্যপার।” শোভা বলে অন্য দুইজনকে।

রত্নাদের বাসার ছাদে বসে কথা হচ্ছিল ওদের মাস দুয়েক পরে। 
“এখন তোদের কোন যোগাযোগ আছে?”
“না রে।”
“ছেলের বাসায় জানত তাদের ছেলে এমন?”
“হ্যাঁ জানত। জেনেই তো বিয়ে দিয়েছে যেন ছেলে বিয়ের পর ভালো হয়ে যায়।”
“হাস্যকর!!” রত্না জোরে বলে উঠল।“
“অমানুষ! একটা মেয়ের জীবন যেন কোন ব্যপারই না!” রাগ আর দমন করতে পারছে না শান্তা।

“আমাদেরও ভুল হয়েছে আসলে। ওই যে আব্বা খুব অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল … এরপর সুস্থ হয়ে তড়িঘড়ি আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলে। আমরাও তেমন খোঁজখবর করিনি। ছেলেদের অবস্থা ভালো, ভালো জায়গায় পড়াশোনা করে এটাই দেখা হয়েছিল। এখন হালাকায় গিয়ে যা জানি তা আগে জানলে আমিও এই বিয়েতে এত সহজে রাজি হতাম না। ছেলের দ্বীন আর চরিত্রই আগে দেখতাম।”

“আঙ্কেল-আন্টি কী বলেন?”
“আমার বাসা থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে ডিভোর্স নেয়া হবে। এই খবর পেয়েই তো আমাকে আরও হ্যারাস করার জন্য আমার ফেসবুক একাউন্ট হ্যাক করল।”

“তুই একদমই ভাববি না এসব নিয়ে, বুঝলি? সামনে তোর পরীক্ষা, মন দিয়ে পড়াশোনা কর। আল্লাহ্‌ সবকিছুর ভালো ব্যবস্থা করে দিবেন।”
“সেই চেষ্টাই করছি রে! আল্লাহ্‌ আমার অস্থির মনটাকে শান্ত করে দিক খুব তাড়াতাড়ি তোরা দুয়া করিস।”
শোভাকে জড়িয়ে ধরল রত্না আর শান্তা। মেয়েটা কখনো শ্বশুরবাড়িই গেল না! একসাথে সংসার করার সুন্দর স্বপ্নটা শুরু না হতেই খান খান করে ভেঙ্গে গেল তার।

৫।
বছর দুয়েক পর।
“তোর ওই বিষয়টা কি ক্লোজ করেছিস তোরা?” টুকটাক মেসেজের ফাঁকে শোভাকে জিজ্ঞেস করল রত্না।
“এখনো না। ছেলের ফ্যামিলি প্রভাবশালী। তাদের সহজে বাগে আনা যাচ্ছে না। তারা আবার মিটমাট করাতে চায়।”
“উফফ! ডিভোর্স নিবে তাতেও এত ঝামেলা!

তাড়াতাড়ি ওই চ্যাপ্টার ক্লোজ করে জীবনটাকে আবার সুন্দর করে সাজা প্লিজ দোস্ত।”
“আমার জীবন তো আমি সুন্দর করেই সাজাচ্ছি রে! আলহামদুলিল্লাহ্‌ পড়াটা শেষ করলাম ভালোভাবেই। এবার লেকচারার হওয়ার চেষ্টা করব। সার্কুলার দিয়েছে। এপ্লাই করব জলদি ইনশাল্লাহ। নিজের পায়ের নিচের মাটিটা আগে শক্ত করব। … বাদ দে তো এই প্রসঙ্গ … দেখ আমি কী কিনেছি …” বলে শোভা একটা ছবি শেয়ার করল।

সমসাময়িক অনেক গুলো ইসলামিক বইয়ের একটা ছবি। ওরা গ্রুপে প্রায়ই নতুন ইসলামিক বই কিনলে ছবি তুলে দেখায় একে অপরকে। বইয়ের কোন জায়গা বিশেষ ভালো লাগলে সেটাও বাকিদের সাথে শেয়ার করার জন্য ওই পাতার ছবি তুলে দেয়। শান্তা বেশি বই পড়ে ওদের মাঝে। আস্তে আস্তে বাকি দুইজনও আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

আগের মতো আর সময় কাটানোর জন্য অযথা গল্প, উপন্যাস পড়ে না ওরা। এখন ভালো মানের অনেক ইসলামিক বই পাওয়া যায়, যেগুলো পড়ে কিছু জানাও যায় আবার সময়টাও ভালো কাটে। চলতি সাহিত্য এখন যথেষ্টই অশালীন হয়ে গেছে, ওগুলো পড়তে আর ভালোও লাগে না। শান্তা খুব খুশি হয়ে গেল শোভার নতুন বই কেনা দেখে।

৬।
“দোস্ত আজকে চাকরির রেজাল্ট দিয়েছে … আলহামদুলিল্লাহ্‌ আমার চাকরিটা হয়েছে।”
“আলহামদুলিল্লাহ্‌ খুবই খুশির খবর। উই আর সো হ্যাপি ফর ইউ দোস্ত!”

“তোদের মনে আছে, ইন্টারভিউ বোর্ডে এক স্যারের আচরণে খুব বিরক্ত হয়েছিলাম? এই স্যার আমার ব্যপারে জানে তারপরও ইচ্ছা করে আমার হাজব্যান্ডকে ঘিরে নানা প্রশ্ন করছিল। তাকে আমি তেল দিয়ে চলতাম না তো তাই এমন করেছিল। কিন্তু দেখ, আল্লাহ্‌ ঠিকই আমার চাকরিটার ব্যবস্থা করে দিলেন।”

“সেটাই, আল্লাহ্‌ আছেন তোর সাথে।”
“আই ক্যান অলওয়েজ ফিল ইট দোস্ত। তোদেরও আল্লাহ্‌ উত্তম জাযা দিন আমাকে সবসময় সাপোর্ট দেয়ার জন্য।”
“আমরা সবসময় আছি তোর সাথে।”

“আলহামদুলিল্লাহ্‌ আমি খুব সাপোর্টিভ ফ্যামিলিও পেয়েছি। কষ্ট দিয়ে কথা বলা অল্প কিছু আত্মীয় বাদে আমার চাচা, ফুপু, মামা, খালাসহ নিজ পরিবারের অফুরন্ত সহযোগিতা পেয়েছি। আল্লাহর কাছে অনেক অনেক শুকরিয়া।”

“আল্লাহ্‌ উনার শুকরিয়া আদায়কারী বান্দার নিয়ামত আরও বাড়িয়ে দেন!”
“শোন না, ‘ফেরা’ বইটা পড়ে শেষ করলাম। এত অন্যরকম সুন্দর একটা অনুভূতি হোল! কী অসম্ভব এক অ্যাডভেঞ্চার, অথচ বাস্তব! সম্পূর্ণটা বাস্তব! এমনও হয়, সুবহানআল্লাহ!”

“সেটাই দেখ, এই আপুটা অমুসলিম পরিবারে থেকে নিজে উদ্যোগী হয়ে ইসলামকে খুঁজে বের করেছে। দ্বীনের জন্য স্যাক্রিফাইস করেছে। আমাদেরও আসলে আরও চেষ্টা করা উচিত।”

“হুম … আমি কয়েকদিন থেকেই ভাবছিলাম হিজাবটা আরও ভালমতো শুরু করব। সেদিন হঠাতই একটা রিয়েলাইজেশন হোল। এই যে সেজে বাইরে বের হলে ছেলেরা আমার দিকে তাকায়, আমিই তো তাদের তাকানোর পথ করে দিচ্ছি আসলে। আমাকে আকর্ষণীয় না দেখালে তারা তো আমার দিকে তাকাতো না!”

“একজাক্টি দোস্ত! হিজাবের মূল ব্যপারটাই হচ্ছে অনাকর্ষণীয় লাগা। আর সাজগোজ করার জন্য তো আমরা আছিই, শুধু নিজেরা একসাথে হলে খুব সাজব … আরও ভালো হয় তুই এবার বিয়েটা করেই ফেল … ওদিকেও ফাইনালি সব চুকে গেছে, তোর লেকচারারের চাকরিটাও হয়েছে … তাহলে বরের সামনে যত খুশি সাজতে পারবি ইনশাল্লাহ!”

“আমি এখন আর মানুষকে বিশ্বাস করতে পারি না রে … বাদ দে এই কথা।”

৭।
আরও এক বছর পর।
হঠাতই শোভার সাথে রত্না আর শান্তা সব যোগাযোগ হারিয়ে ফেলল। না ফেসবুক, না ফোন কোথাওই ওরা শোভাকে পেল না। চিন্তিত হয়ে ওরা ওর বোনের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারল যে শোভা ভালো আছে। এখন বাসাতেই আছে।

অনেকদিন ধরেই ওর ফ্যামিলির সবাই ওকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে চাচ্ছিল কিন্তু ও এই নিয়ে কোন কথাই শুনতে চাইত না। একসময় ওর চাচা শক্ত ভূমিকা নিলেন। জোর করে শখের চাকরিটা ছাড়ালেন। নিজের জীবন নিয়ে আরও সিরিয়াস হতে বললেন। 
রত্না আর শান্তা শোভার জন্য কিছুটা চিন্তিত হলেও ও ভালো আছে শুনে নিজেদের শান্ত রাখল।

৮।
আরও মাস ছয়েক পর।

একদিন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ফিরে আসল শোভা। ওকে অনেকটাই প্রশান্ত মনে হচ্ছে। ঘরে থেকে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওর মতামত নিয়েই ওর বাসা থেকে বিয়ের জন্য দেখা হচ্ছে। ততদিনে রত্না আর শান্তা দুইজনেরই বিয়ে হয়েছে। ছেলের পড়াশোনা, ফ্যামিলি দেখার পাশাপাশি ওরা দ্বীনদারিতা দেখেও বিয়ে করেছিল।

মাশাল্লাহ দুইজনই নতুন জীবনে ভালো আছে। এইসবকিছু দেখে আর পরিবারের সহায়তায় শোভা আবারও নতুন করে কারো সাথে জীবন শুরু করতে আগ্রহী হয়েছে। এবার ও অবশ্যই দ্বীন আর চরিত্র প্রাধাণ্য দিয়েই বিয়ে করবে।

৯।
সুখবরটা দুই বান্ধবীকে একসাথে দেয়ার জন্য হোয়াটসঅ্যাপেই গুছিয়ে একটা মেসেজ লিখল শোভা, “আজ তোদের আমার নতুন জীবন শুরুর সময় উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। ইন শা আল্লাহ আগামী ২১ তারিখ আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।

ছেলের সাথে আমি নিজে কথা বলেছি। উনারও আমার মতো একটা অতীত ঘটনা আছে। উনি চান আমি যেন দ্বীনের পথে আরও এগিয়ে যাই। আলহামদুলিল্লাহ্‌ এটাই আমার খুব ভালো লেগেছে। ইস্তিখারা করেছি। আমার মন সামনে এগিয়ে যেতে সায় দিচ্ছে।”
মেসেজটা পড়ে মন থেকে শোভার জন্য দুয়া করল ওর দুই বান্ধবী।

১০।
তিন মাস পর।

শোভার বিয়ের পর এই প্রথম ওদের তিনজনের দেখা হয়েছে শোভার নতুন সংসারে। কথায় কথায় শোভা বাকি দুইজনকে বলল, “আসলে কি জানিস, খুব বেশি স্বাধীনতাও ভালো না রে … আমি যেমন ভাবতাম, নিজে রোজগার করব, নিজের জীবন একাই চালাব এই ভাবনাটাও ঠিক না। জীবন মানেই তো পরীক্ষা। একা একা পরীক্ষা দেয়ার চেয়ে কাউকে সাথে নিয়ে পরীক্ষা ফেস করা অনেক বেশি স্বস্তির। আর সে যদি আল্লাহ্‌ ভীরু হয় জীবনটা তখন অনেক বেশি আনন্দময় মনে হয়।”

“আলহামদুলিল্লাহ্‌,” একসাথে বলে উঠল রত্না আর শান্তা।

[সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা।]

হার না মানা জীবন
বিনতে খাজা

জুন ২৫, ২০১৯ইং