উসরি ইউসরা

“কিছু ভুল থেকে আমার রব আমাকে উঠিয়ে এনেছেন। আলহামদুলিল্লাহ্‌। সেসব ভুলগুলোর কথা নাই বা বললাম। কিন্তু ভুলগুলো থেকে যে শিক্ষা পেয়েছি তা তো বলাই যায়। আর সেই ভুলগুলোই যে আমার বদলে যাবার কারণ। হয়তো হাজার কোটি বার আলহামদুলিল্লাহ্‌ বললেও পোষাবে না।

মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। সুরা বাক্বারার ওই আয়াতটা মনে পড়ে যেখানে ফেরেস্তারা বলেছিলো, “আমাদের তুমি যা শিখিয়েছো তার বাইরে তো আমরা কিছুই জানি না।”

আমার অবস্থাও সেই একই রকম। আমার রব আমাকে যা শিখিয়েছেন তাই বারবার বলি। আলহামদুলিল্লাহ্‌। আলহামদুলিল্লাহ্‌। আলহামদুলিল্লাহ্‌”

কথাগুলো খুব আবেগ জড়ানো ভেজা কন্ঠে বলছিলেন আয়েশা আপু। আর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলো আমিনা। এটুকু বলে থেমে চোখ মুছতে লাগলেন তিনি। আমিনা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আপুর দিকে। খুব করে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে কি শিক্ষা পেয়েছেন ভুল থেকে। খুব করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে আপুকে। কিন্তু তা আর হলো না। চোখ মুছে আপু আবার বলতে শুরু করলেন।

“আমার রব আমাকে যা কিছু দিয়েছেন তা আমি গুণে শেষ করতে পারবো না…”

চোখ থেকে গাল গড়িয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু মুক্তোর মত গড়িয়ে গেলো। আপু প্রতি বার এতো আবেগভরে “আমার রব” বলছেন যেন আল্লাহ্‌ একমাত্র আপুর একারই রব। ছোট বাচ্চারা “আমার মা” যেমন করে বলে অনেকটা সেরকম। আমিনারও চোখ ভিজে উঠছে বারেবারে। আয়েশা আপু বলে যাচ্ছে,

“আমি কখনই কল্পনাও করিনি আমার রব আমাকে এতো সম্মান দিবেন। বিশ্বাস করো। কখনোই না। আমার একজনের সাথে সম্পর্ক ছিলো। তাকে ভালোবাসতাম। সত্যি বলতে কি জানো! অনেকটা নিজেকে তার দাসী বানিয়ে রেখেছিলাম। গুনাহের সাগরে ডুবে ছিলাম। অথচ আমার রব…”

বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন আপু। এই কান্নায় ভালোবাসার মানুষ হারানোর কষ্ট বিন্দু মাত্র নেই। কেমন যেন একটা স্নিগ্ধ কৃতজ্ঞতা মিশানো কান্না। আমিনা আপুর একটু কাছে এগিয়ে হাতটা ধরলো শুধু। খুব করে ইচ্ছে করছে জড়িয়ে ধরতে। তা আর হলো না।

“তাকে ছাড়া আমার ভাবনার কিছুই ছিলো না। কিছুই না। সারাদিন তাকে নিয়েই ভাবতাম। কোন কাজ হতো না আমার…”
“আপু, থাক এসব কথা। বলতে হবে না। কি হবে এসব ভেবে।”

“ঠিক বলেছ। তবে কি জানো, এসব আমার জীবনে না ঘটলে হয়তো আমি আমার রবকে চিনতামই না।” কিছু মুক্তো দানা চিকচিক করছে আপুর চোখের কোণে। পলক ফেললেই যেন গড়িয়ে পরার অপেক্ষায়।

আমিনা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো আপুকে। দুজনেই হঠাৎ হু হু করে কেঁদে উঠলো। কত কথা যেন মিশে আছে এই অশ্রুতে।

নিজেকে আমিনার বাহু থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আয়েশা আপু বললেন, “কত কথা বললাম তোমার সাথে। রঙ চা খাবে?”
“হ্যাঁ! খাওয়া যায়।” মাথা ঝাঁকিয়ে বললো আমিনা।
“দেখলে আমাদের অবস্থা! কে বলবে যে আমাদের দু’দিন আগেই পরিচয় হয়েছে।”
কথাটা শুনে আমিনা শব্দ করে হেসে উঠলো।
“না আপু। আমরা রুহের জগৎ থেকেই খুব ক্লোজ কেউ ছিলাম। মাটির উপর তো কিছু সময়ের বিচ্ছেদ ছিলো মাত্র।”

আমিনার কথা শুনে আয়েশাও খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। খুব আপন মনে হয় আমিনাকে। দ্বীনের পথের পরিচয়গুলো হয়তো এমনই হয়।

“আচ্ছা, তুমি কেন কাঁদলে হঠাৎ? আমি তো আমার কথা বলতে বলতে কাঁদলাম।”
“আমিও আমার কথা মনে করে কাঁদলাম, আপু। কি ছিলাম আর আমার রব আমাকে কতটা দিয়েছেন তা ভেবে…” আমিনাও আয়েশার মত করে “আমার রব” বললো।

“গুনাহের কথা না হলে বলতে পারো” রঙ চায়ে একটু লেবু চপে দিতে দিতে বললেন আয়েশা আপু।
“বলছি। আমার চায়ে লেবু দিও না, আপু”

আমিনার বারণ শুনে লেবু দিতে গিয়েও থেমে গেলো আয়েশা আপু। তারপর দু’ কাপ চা সাথে চানাচুর নিয়ে বসে বললো, “হ্যাঁ! এবার বলো।”

“আমার ডিভোর্সের পর হঠাৎ আব্বু অসুস্থ হয়ে যায়।”
“অথচ তোমাকে দেখলে বুঝাই যায় না যে তোমার বিয়েও হয়েছিলো।”

ঠোটের কোনে হালকা হাসির ভাব এনে আবার বলা শুরু করে আমিনা, “আমি তখন খুব জেদি, অহংকারী টাইপ মেয়ে ছিলাম। সত্যি বলতে কি আমাদের ডিভোর্সটাও আমার জেদের কারণেই হয়েছিলো অনেকটা।” ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করার চেষ্টা করে আমিনা।

কিন্তু তা আয়েশা আপুর চোখ এড়াতে পারে না। দীর্ঘশ্বাস মাটিতে পরার আগে আপু বলে উঠে, “দোষ গুনের কিছুই না। ত্বাকদিরে ছিলো হয়েছে। তবে, এই যে তুমি নিজের করা ভুলগুলো বুঝতে পারলে ও ফিরে আসলে এটাই ছিলো আল্লাহ্‌র প্ল্যান।”

আমিনাও পূর্ণিমার চাঁদের মত একটা হাসি দিয়ে বললো, “তা তো অবশ্যই। ক্বাদারাল্লাহু ওয়ামা শা ফা’লা”

“তারপর?”

“ডিভর্সের পর, আব্বু হার্ট এটাক করে।“

“হুম, স্বাভাবিক।”

“সে থেকেই আমার বদলে যাওয়া শুরু বলতে পারো।”

“কিভাবে?”
“তখন ছিলো রামাদান মাস। আমি দিনরাত কাঁদতাম আর দো’আ করতাম”
“আঙ্কেলের জন্য?”
“হ্যাঁ! দো’আ করতাম প্লিজ আল্লাহ্‌ আমার আব্বুকে সুস্থ করে দাও অ্যাট অ্যানি কস্ট। প্রমিস, আমি একেবারে ভালো হয়ে যাবো।”
“ইন্টারেস্টিং তো। তার মানে তুমি বুঝতে যে তুমি এখন ভালো নেই।”

“হ্যাঁ, বুঝতামই তো।”
“তারপর?”
“আলহামদুলিল্লাহ্‌, ঈদের আগেই আব্বু সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরতে পেরেছিলেন।”
“আর তুমিও ফিরেছিলে…”
আয়েশা আপুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আমিনা বললো, “নাহ্‌, আব্বু সুস্থ। রামাদান শেষ। আমি আবার আমার ভুলের সাগরে ডুবে গেলাম।”

“মানে কি!? তুমি না প্রমি…”
“ভুলে গিয়েছিলাম সব।” আবারও আয়েশা আপুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো আমিনা।
“তারপর?”
“তারপরও মাঝে মাঝে মনের কোণে হঠাৎ হঠাৎ নিজের করা প্রমিসের কথা মনে পড়তো। পরক্ষনেই আবার নিজেকে বুঝিয়ে নিতাম।”

“কি বুঝিয়ে নিতে?”
“কি এমন গুনাহ্‌ করছি আমি। আমি যা করছি এমন তো হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিনই করে।”
“হ্যাঁ, এমন আমারও শেষের দিকে এসে মনে হতো। যখন থেকে জেনেছিলাম যে বিয়ের আগের রিলেশন করাটা হারাম।”

“কিন্তু আমার রব আমাকে পথ দেখাতেই চাচ্ছিলেন। আমিই চিনতে অনেকটা দেরি করে ফেলেছি। একের পর এক ঘটনাগুলো এমনভাবে সাজালেন যে … ” এইটুকু বলে একটু থেমে কি যেন ভেবে আবার বলা শুরু করলো আমিনা, “পিংপং বল যেমন এদিক সেদিক বাড়ি খেতে খেতে থাকে অনেকটা সে রকম।” বলে শব্দ করে হেসে নিলো আমিনা।

আমিনার হাসির লেস এসে আয়েশার ঠোটেও লেগেছে কিছুটা কিন্তু আয়েশার চোখ জোড়া কৌতূহলে পূর্ণ।

“তা কি রকম এদিক সেদিক বাড়ি খেলে তুমি?” উৎকণ্ঠাভরা কন্ঠ।
“তার ঠিক চার কি ছয় মাস পরেই আব্বুর ফ্যাক্টরিতে কারা যেন আগুন লাগিয়ে দেয়।”

“কি বল! তারপর?” বিস্ময় জড়ানো দৃষ্টি আয়েশার।
“এই ধ্বাক্কাটা আমাদের পরিবারের সবার গায়ে খুব জোড়ে লাগে।”
“চা তো ঠান্ডা হয়ে গেলো। খেতে খেতে কথা বলো”

হাতে যে একটা চায়ের কাপ আছে তা আয়েশা আপুর কথায় খেয়াল হলো আমিনার। চায়ের কাপে দু’ চুমুক বসিয়ে আবার বলতে শুরু করলো আমিনা।

“এই এক ধ্বাক্কায় আমাদের সব সেভিংস শেষ হয়ে গেলো। তার উপর ঋণের বোঝায় ভারি হয়ে গেলো কাঁধ।”

“তারপর?”

“তারপরের রামাদানে আবারও আব্বু খুব অসুস্থ হয়ে যায়। আসলে আমার ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু হল আমার আব্বু। আব্বুর কিছু হবে তা ভাবাও আমার জন্য দুঃস্বপ্নসম।”

এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আয়েশা।

“আবার এক মাস শুধু আল্লাহকে ডেকে কাটিয়ে দিলাম। সেই পুরনো প্রমিস না রাখার জন্য ক্ষমা চাইলাম। বললাম, ’আল্লাহ্‌ এবারের মত সব ঠিক করে দাও। আমি আর কখনোও কিচ্ছু চাইবো না তোমার কাছে। আর এবার আমি সত্যিই সব গুনাহ্‌ ছেড়ে দিবো। সব সালাত পড়বো’ এমন অদ্ভুত দো’আ করতাম আর কাঁদতাম।”

“তুমি তখন সালাতও পড়তে না?”
“না।”
“কি আর জিজ্ঞেস করবো। জীবনের একটা সময় তো আমিও সালাত পড়তাম না।”
“হ্যাঁ! ছেলেদের তো তাও জুম্মার সালাত পড়তে হবে ভেবেও সপ্তাহে এক ওয়াক্ত হলেও পড়ে।”
“ঠিক বলেছ, আমি যে কত বছর সালাত পড়িনি তার হিসেব নেই।”

“হ্যাঁ, আমারও।”
“যাক, তারপর কি হল বলো।”
“আলহামদুলিল্লাহ্‌। সেবারও আব্বু ঈদের আগেই বাড়ী ফিরে এলো।”
“আর এবার তুমিও…”
“না, আপু। এবারও আমি সব ভুলে নিজের ভুলের সাগরে ডুব দিলাম।”

আয়েশা আপু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। যেন কিছুতেই কথাগুলো বিশ্বাস হচ্ছেনা ওনার।

আমিনা নিজের মত বলে যাচ্ছে, “কিন্তু এর মধ্যে আমার মনের কিছু পরিবর্তন ঘটলো…”
“কি রকম?”
“যেমন, আমার এই সময়টায় বোরকা পরা কাউকে দেখলে ভালো লাগতো।”
“মানে কি? এর আগে লাগতো না?”
“না। এর আগে বোরকা পরা কাউকে দেখলে বিরক্তি লাগতো।”
“কেন?”

“মনে হতো এরা বোরকা পরে বলেই মানুষ আমাদের নিয়ে এতো কথা বলার সুযোগ পায়। এরা না পরলে তো সবাই সমান থাকতো। তখন আর কেউ কিছু বলতো না।”
“আজব তো। আর কি কি পরিবর্তন হল?”
“একেবারে হঠাৎ হঠাতই বলতে পারো আমার কোরআন পড়তে ইচ্ছে হতো।”
“পড়তে পারতে?”
“না।”

“তারপর…?”
“কিন্তু এসব ইচ্ছেকে খুব একটা গা করতাম না।”
“আমারও এমন হতো আমিও পারতাম না। তখন আমার বয়ফ্রেন্ডকে বলতাম বাংলা উচ্চারণ লিখে দিতে।”
“দিতো?”
“হ্যাঁ! যাক তুমি তোমার কথা বলো।”
“কিন্তু আমি এসব হঠাৎ হঠাৎ ভালো হবার ইচ্ছেকে গায়ে লাগাতাম না। সব যেমন বিশৃঙ্খল চলছে চলতে দিতাম।”
“ফিরলে কি করে?”
“ওই যে বলেছিলাম না আমরা ঋণে ডুবে গিয়েছিলাম…”
“হ্যাঁ!”

“সেই ঋণের কারণে আমাদের নিজের বাড়ী থেকেও আমাদের বের করে দেয়া হলো। তাও এক রাতের নোটিশে।”
“কি বলো… কারা এ কাজ করলো?”
“করেছে… কিছু প্রভাবশালী মহল… আর কি…” কেন যেন আমিনা ব্যপারটা গোপন করতে চাইলো।
আয়েশা আপুও খুব একটা ঘাটালেন না। “তারপর?” জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
“আমরা একেবারেই ভিখেরির মত নিজেদের গ্রামের বাড়ী এসে উঠলাম।”

আয়েশা আপু কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না।
আমিনা নিজের মত বলে যেতে লাগলো, “যে আমি মাসে ২/৩টা করে ফোন চেঞ্জ করতাম, যে আমি ভাত খাওয়াকে ফকিরের অভ্যাস ভাবতাম, যে আমি গ্রামের মানুষ শুনলেই নাক উঁচু করে বলতাম ‘অজ পাঁড়া গ্রাম থেকে উঠে এসেছে মনে হয়।’ সেই আমিই দিনের পর দিন শুধু মরিচ পোড়া দিয়ে ভাত খেয়েছি।”

কেমন যেন কঠিন হয়ে গেলো আমিনার চেহারাটা। আয়েশা আপু বলার মত কোনো ভাষা খুঁজে পেলেন না। খুঁজে পেলেন না জিজ্ঞেস করার মত কোনো প্রশ্ন।
“জানো আপু, একটু আগেই তোমাকে বলেছিলাম না আমি খুব জেদি আর অহংকারী টাইপ মেয়ে ছিলাম।”
“হ্যাঁ…”

“কিন্তু আমার রব এক নিমিষে আমার সব অহংকার ধুলোয় মিলিয়ে দিলেন।” কঠিন কন্ঠে বলে একটু থামলো আমিনা। চোখ এপাশ ওপাশ করে কি যেন খোঁজার মত করলো। তারপর আবার বলতে শুরু করলো, “কিন্তু আপু, আজ আমি এখানে বসে এটা খুব অবলীলায় বলতে পারি সেই দিনগুলো আমার লাইফের বেস্ট দিন ছিলো। বেস্ট দিন…” খুব দৃঢ় কন্ঠে নিজের বুকে হালকা চাপড়ে বললো আমিনা।

“তারপর?”

“কিন্তু এই সময়টায় একটা অদ্ভুত ব্যপার ঘটে।”
“কি?”
“আমার কেন যেন আর আল্লাহকে সিজদাহ করতে ইচ্ছে হতো না। মনে হতো কি হবে এসব করে…”
“ফিরলে কি করে তাহলে?”
“ইচ্ছে হতো না দো’আ করতে। তবুও জেদ করেই দো’আ করতাম। আর আল্লাহকে অনেক আজেবাজে কথাও বলেছি। এর মধ্যে একটা কথা পরে বারবার মনে পড়েছে আমার…”
“কি?”

“আমি আল্লাহকে বলতাম, ‘এই হয়েছে, এবার শেষ কর প্লিজ। আমি জানি আমি অনেকবার তোমকে কথা দিয়েও তা রাখিনি। কিন্তু এবার শেষবারের মত কথা দিচ্ছি। এবার সব ঠিক করে দিলে আমি সত্যিই ভালো হয়ে যাবো। আর যদি তা না হই, তাহলে তোমার যা ইচ্ছে তাই কোরো’ এমন আরো অনেক কিছুই…”
আয়েশা আপু অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। যেন কোনো কথা বলার আর সাহসই পেলেন না তিনি।

“… তারপর কিছুটা আজবভাবেই আমাদের আর্থিক আবস্থা ফিরেছিলো আলহামদুলিল্লাহ্‌। যাক সেসব…”
“আর তুমি?” খুব ক্ষীণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন আয়েশা আপু।

“এবারও আমার ফেরা হলো না।”
খুব মন খারাপ করে তাকালেন আপু।
“এর কিছুদিন পরেই রামাদান মাস এলো। ভয়ংকর একটা এক্সিডেন্টে আমার ফ্যামিলির সবাই মারা গেলো। কিভাবে যেন শুধু আমি বেঁচে গেলাম। কিন্তু এ সময়ে আমার পাশে কেউ দাঁড়ালো না। উল্টো আমার চাচারা আমাদের সব সম্পত্তি জালিয়াতি করে নিয়ে নিলো।

আমার যে কি ভাগ্য! একটু আহতও হলাম না।”
এক নিঃশ্বাসে সবটা বলে থামলো আমিনা। চোখ গাল লাল হয়ে খুব হাঁপাচ্ছে ও। দেখে মনে হচ্ছে চিৎকার করা কান্নার গলা চেপে ধরে আটকাতে চাচ্ছে ও।
আয়েশা আপু যেন এমন কথাগুলো শুনতে একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। তিনিও কিছুটা জোরে শ্বাস নিচ্ছেন।

ঠিক এই মুহূর্তে ঠিক কি করা উচিৎ বা বলা উচিৎ কিছুই বুঝতে পারলেন না তিনি। আমিনা একটু জিরিয়ে আবার বলতে শুরু করলো, “নিজের চোখের সামনে এসব দেখেছি। আমি কেমন যেন পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। না খাওয়া না ঘুম। কিছুই করতাম না। সারাদিন রাত বসে থাকতাম।

সারাদিন রাত, মানে ২৪ ঘণ্টার ২৪ ঘন্টাই আমি বসা। ঘুরেফিরে একটাই চিন্তা আসতো। আমি কেন বেঁচে গেলাম। কেন আমিও ওদের সাথে মারা গেলাম না।” চোখ টকটকে লাল করা অশ্রু না অশ্রু বলাটা ঠিক হবে না। রক্তের দানা গাল গড়িয়ে পরতে লাগলো আমিনার। আমিনা তাতে কোনো বাঁধা দিলো না। আর আয়েশা আপুও সমবেদনা প্রকাশ করার সাহস দেখালেন না। কোথা থেকে সমবেদনা প্রকাশ করবেন? এই বেদনা যে কোনো কিছুর সমানই হয় না।

“আর তোমার হাসব্যন্ড?” কিছুটা দ্বিধা জড়ানো প্রশ্ন আয়েশা আপুর।
“কার কথা বলছো, আপু? যে আমার সুখের সময়ই আমার পাশে ছিলো না সে আমার এই অসময়ে কেন আসবে!! তবে…”
“তবে কি?”
“তবে আল্লাহ্‌ এ সময়টায় তাঁর কিছু অসাধারণ বান্দাদের আমার সাহায্য করতে পাঠিয়েছিলেন। যারা আমাকে আইনিভাবে, আর্থিকভাবে, মানসিকভাবে সবভাবেই সাহায্য করছেন।”
“কি রকম?”
“রামাদান মাস ছিলো তো। যাকাতের টাকা ৫০০০ পেয়েছিলাম। তাতেই আমার রব এতো বারাক্বাহ্‌ দিলেন…”
“যাকাতে টাকা ৫০০০ দেয় কেউ? আমি তো জানতাম সাড়ি লুঙ্গী এসব দেয়।”
“সাড়ি লুঙ্গী তো এখন সো অফফ করতে দেয়। কিন্তু ওই যে বললাম না আল্লাহ্‌ তাঁর কিছু বান্দাকে সাহায্যের জন্য পাথিয়েছিলেন। তারাই ব্যবস্থা করে দিলেন।”
“তারপর?”

“তারপর আর কিছু না, আপু। এখন আব্বুর সেই রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকেই দিন কাটে আমার। আর নিজের ছোট খাট একটা কাজ আছে। এই আর কি…”
“ফিরলে কি করে? সেই দ্বীনদ্বার ভাইদের দাওয়াতে?”
“দ্বীনদ্বার ভাই না। দ্বীনদার আপু। ও আচ্ছা আমি আল্লাহ্‌র বান্দা বলেছিলাম তাই বুঝতে ভুল করেছ হয়তো…” মিষ্টি এক চিলতে হাসি মেয়েটার ঠোটে লাগানো।

আয়েশার খুব অবাক লাগলো। এতো কষ্টে থাকা কেউ এতো সুন্দর করে হাসে কেমন করে!!
“না। বরং উল্টোটাই হয়েছে। আমার রব আগে আমার ভেবতটা পরিবর্তন করেছেন তারপর বাইরে থেকে আমার জন্য সাহায্য পাঠিয়েছেন।” আবারও আমিনা ‘আমার রব’ সেই আবেগভরে বললো। যেন আল্লাহ্‌ একমাত্র আমিনারই রব।

“কি রকম?”

“সেই একাকীত্তের সময়টায় আমি সারাদিন শুধু কাঁদতাম। এর বাইরে আমার কিছুই করার ছিলো না। আমাকে বুঝানোর জন্য আশেপাশে কেউ ছিলো না। সেই সময় শুধু কেঁদে কেঁদে সিজদাহ করে একটু শান্তি পেতাম।

আব্বুর বলা কথা মনে পরতো। সাওবার জন্য দো’আ করতাম। আর মনে হতো এতো ভয়ংকর এক্সিডেন্ট থেকে আমার বাঁচাটা মোটেও অযথা হতে পারে না। বার বার মনে হতো গত রামাদানেই তো আমি আল্লাহ্‌কে বলেছিলাম যে এবার যদি ভালো না হই তাহলে আল্লাহ্‌র যা ইচ্ছা তাই যেন করেন। কোনো ভাষা খুঁজে পেতাম না বলার মত। শুধু বলতাম আমি ভুল করেছি। আর কাঁদতাম।”

“তারপর?”
“শুধু কেঁদেই অনেকটা সময় কেটে গেলো। এর মধ্যে রিলেটিভদের খারাপ ব্যবহার আর আমার সব যে ফাঁকি দিয়ে নিয়ে নিলো সব মিলিয়ে খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম।”
“কেউ তোমাকে একটু সান্ত্বনাও দিত না?”
“হ্যাঁ, মুখে মিষ্টি কথা বলতো। তাই তো বুঝতে খুব দেরি হয়ে গিয়েছিলো। আর আইনের এতো প্যাঁচ তো বুঝতামও না। কিন্তু…” এটুকু বলে থামলো আমিনা।
“কিন্তু… কি?”
“যাক সেসব… এক আপু আমাকে এই সময়টা মানসিকভাবে অনেক সাপোর্ট দেন। সেই আপুকে আগে থেকেই চিনতাম। কিন্তু আগে এতো ক্লোজ ছিলাম না।”
“কি রকম সাপ্পোর্ট?”
“দিনে অন্তত কয়েকবার কল দিয়ে খোঁজ নিতেন। সব সমস্যার কথা আল্লাহ্‌কে বলতে বলতেন। বলা যায় এভাবেই আমার আল্লাহ্‌র সাথে একটা কানেকশন তৈরি হয়। বাকি পথটাও আল্লাহ্‌ সহজ করে দনে।”
“তারপর?”
“তারপর, এখন আমাকে যেমন দেখছো আর কি…”
“শুধু ব্যাবসা করেই সময় কাটে?”
“না, একটা অরফানেজ ও ওল্ডহোম এর সাথেও জড়িয়ে আছি আলহামদুলিল্লাহ্‌।”
“বিয়ে করছো না কেন, তাহলে?”
আয়েশা আপুর এমন প্রশ্নে শব্দ করে হেসে উঠে আমিনা। হাসতে হাসতেই বলে “আমার মত এতিম, ডিভোর্সি কাউকে কে বিয়ে করবে।“
“চেষ্টা করে দেখতে পারো তো…”
“যাক বাদ দাও, আপু। আমার রব আমাকে যা দিয়েছেন তাতেই আলহামদুলিল্লাহ্‌। আর যা নিয়েছেন তা আবার জান্নাতে ফিরে পাবো ইনশাআল্লাহ্‌। আজ উঠি, তাহলে…”
“কি বলছো! খেয়ে যাও…”
“না, না। সে সময় আর হবে না।”

কথা বলতে বলতেই বেড়িয়ে পরলো আমিনা। আয়েশা আপুর মনে পরে গেলো সেই আয়াতটা,

“ইন্না মা’আল উসরি ইউসরান।”

রাস্তায় নেমে ছলছল নয়নে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো, “আলহামদুলিল্লাহ্‌।”

আর আয়েশা দড়জা লাগিয়েই বারান্দায় এলো দেখতে আমিনা রিকশা পেয়েছে কিনা। অসংখ স্মৃতি মস্তিষ্কের নিউরনে ভেসে বেড়াচ্ছে। নিজের অজান্তেই চোখের কোনে চিকচিক করছে মুক্তোদানা। একবার শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো, “আলহামদুলিল্লাহ্‌”
আর দু’জনের মনে মনে বলা কথাই আলোর গতি থেকেও দ্রুত গতিতে পৌছে গেলো সেই সাত আকাশের ওপারে আরশে আজীমের মালিকের কাছে।


উসরি ইউসরা”
নুসরাত জাহান মুন

(১৪/৫/২০১৯)